হলি আর্টিজান হামলা ও কোভিডকে হারিয়ে যেভাবে অসম্ভব একটি বিষয় সম্ভব হলো
দেশের প্রথম মেট্রোরেল এখন দৃশ্যমান। ডিসেম্বরের শেষে আংশিকভাবে চালু হবে এমআরটি পরিষেবা। তবে ঢাকার মতো বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ একটি শহরে মেট্রোরেল নির্মাণ সহজ ছিল না।
প্রকল্পের শুরু থেকেই আমাদেরকে একাধিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে রেলের রাস্তা নির্ধারণ বিতর্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, জঙ্গি হামলা এবং ইউটিলিটি লাইন স্থানান্তরের মতো জটিল কাজ। এছাড়া নির্মাণকাজ চলাকালে সরু রাস্তার কারণে ঢাকাবাসীকেও প্রচণ্ড যানজট সহ্য করতে হয়েছে।
কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন উঠেছে মেট্রোরেল জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার মূল নকশার ক্ষতি করছে কি না। পরবর্তীকালে দেখা যায় আমাদের প্রকল্পের নকশায় খেঁজুরবাগান এলাকা নেই, যেখানে সংসদসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনা রয়েছে।
আমরা আরেকটি বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী রুটের নকশা নিয়ে প্রতিবাদে নামে। তারা দাবি করে মেট্রো রুট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের শান্ত পরিবেশ নষ্ট করবে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেদিকটা সামলাতে হয়েছে।
এসব প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও প্রকল্পের কাজে একটি বড় ধাক্কা ছিল ২০১৬ সালে ঢাকার একটি ক্যাফেতে জঙ্গি আক্রমণ। সেখানে মেট্রো প্রকল্পে কাজ করা সাত জাপানি নাগরিককে হত্যা করা হয়। এরপর কোভিড মহামারিও প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কমিয়ে দেয়।
নিহত জাপানি নাগরিকরা এমআরটি-৫ ও এমআরটি-১-এ কর্মরত ছিলেন। ২০১৬ সালের ১ জুলাই যখন হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার জঘন্য ঘটনাটি ঘটে তখনও আসল অবস্থা পরিষ্কার ছিল না। আমরা বেসরকারি মাধ্যমে মেট্রোর কয়েকজন বিদেশি কর্মীর হতাহতের ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম। কিন্তু পরদিন সকালে বাংলাদেশ আর্মির ১ম প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের পরিচালিত 'অপারেশন থান্ডারবোল্ট' শেষ হওয়ার আগ অবধি আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল না।
ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে জঙ্গি হামলায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ। পরবর্তীকালে কর্মরত জাপানিদের মৃতদেহ তাদের দেশে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু মেট্রোরেল নির্মাণ কাজের ওপর তখন একটি বড় আঘাত আসে যেটা ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়।
এমআরটি-৬, এমআরটি-১ ও এমআরটি-৫ ইত্যাদি অন্যান্য মেট্রোরেল প্রকল্পে যেসব জাপানি নাগরিক কাজ করছিলেন, ঘটনার পরপরই তারাও বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। তারা জানায়, কেবল পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলেই তারা প্রকল্পের জায়গায় ফিরে আসবে।
পরবর্তীতে তাদের জন্য তিন স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে সরকার। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও ঢাকাস্থ জাপান দূতাবাস বিষয়টি প্রচার করার পর জাপানিরা ফিরে আসতে শুরু করে।
মাঝের সময়টিতে আমরা জাপান থেকে হোম অফিস করা কয়েকজন বিদেশি কর্মীর সঙ্গে কাজ চালিয়ে গেছি। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কাজ তদারকি করা ও ভার্চুয়ালি কাজ করার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই পার্থক্য রয়েছে। ধীরে ধীরে কাজের যে গতি এসেছিল তা হারাতে বসে।
এমআরটি-৬ প্রকল্পে কাজ করা কোনো জাপানি জঙ্গি হামলায় নিহত না হলেও, প্রকল্পের কাজে পুরোপুরি ফিরতে এক বছরের মতো সময় লেগেছিল।
দ্বিতীয় ধাক্কাটা আসে কোভিড মহামারি সময়, যা আরও বেশি গুরুতর ছিল। ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড রোগী শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই ভীত হয়ে পড়ে। অনেক জাপানিজ তাদের লাগেজ প্যাক করে দেশে ফেরার ফ্লাইট ধরেন।
কোভিড কতদিন থাকবে কেউ জানত না। ফলে পরিবারের কাছে ফিরে যান বিদেশি নাগরিকরা।
মহামারির শুরুতে, লকডাউন আরোপ করায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সেসময় নির্মাণস্থলে কাজ করার সুযোগ ছিল না। তবে আমরা 'কোভিডের সাথে বাঁচতে শিখুন' ধারণা দাঁড় করিয়ে কাজ অব্যাহত রাখা শুরু করি। এখন পর্যন্ত আমরা নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে কাজ করছি।
আমরা আগের দুই-একশ জনের দল ভেঙে ২০-৩০ জনের দল গঠন করি। কেউ সংক্রমিত হলে তাকে আইসোলেশন সেন্টারে পাঠানো হতো। দলের বাকি সদস্যরা থাকত কোয়ারেন্টাইনে।
আমরা কোভিডের জন্য উত্তরায় ১৪ শয্যা বিশিষ্ট এবং গাবতলীতে ২০ শয্যা বিশিষ্ট দুটি হাসপাতাল স্থাপন করি। হাসপাতালগুলোতে হাইফ্লো অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেও কোনো নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ) ছিল না। আইসিইউ সাপোর্টের জন্য আমরা উত্তরার জাপান বাংলাদেশ হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করি। এই উদ্যোগ কর্মীদের মধ্যে আস্থা বাড়াতে সাহায্য করেছে।
আমাদের জাপানি সহকর্মীরা যখন কর্মক্ষেত্রে ফিরতে আগ্রহ প্রকাশ করে, তখন দেখা যায় যে জাপানের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত কোনো ফ্লাইট চালু নেই। তাদের জন্য আমাদের বিশেষ ফ্লাইট ও চার্টার্ড ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।
বিদেশি সহকর্মীদের টোকিও, দিল্লি ও ব্যাংককের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দরে জড়ো হতে বলেছিলাম আমরা। সেখান থেকে তাদের ছোট ও চার্টার্ড বিমান দিয়ে ফিরিয়ে এনেছি। এমনকি নির্মাণ কাজ চালিয়ে নিতে আমরা একটি প্লেনে মাত্র ছয়জনকে নিয়ে এসেছি।
ঢাকায় আসার পরে কাজে যোগদানের আগে কোভিড পরীক্ষাসহ তাদের ১৪ দিনের আইসোলেশনে রাখা হতো।
কোভিডের কারণে প্রকল্পে বাধার বিষয়টি নিয়ে সংক্ষেপে বললে মহামারির আগে আমরা দৌড়াচ্ছিলাম। অন্যদিকে সংক্রমণের সময় আমাদের সতর্কতার সঙ্গে ধাপে ধাপে পা ফেলে আগাতে হচ্ছিল।
তবে সুসংবাদটি হলো মেট্রো রেলের কোনো স্থানীয় বা বিদেশি কর্মী ও পরামর্শদাতা কোভিডে মারা যাননি। যারা সংক্রমিত হয়েছিলেন তাদের কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলেও সুস্থ হয়ে ফিরেছিলেন।
কোভিডের পরে আমরা ক্ষতিপূরণে শিফটের সংখ্যা দুটি থেকে বাড়িয়ে তিনটিতে আনি।
মেট্রোরেলের সর্বপ্রথম উত্তর-আগারগাঁও অংশ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে উদ্বোধন করা হবে। যদিও মূল প্রকল্প প্রস্তাবনায় পুরো উত্তরা-মতিঝিল অংশ ২০২৪ সালের মধ্যে চালু করার কথা বলা হয়েছে, তবে আমি আশা করি নির্ধারিত সময়ের আগেই ২০২৩ সালের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করতে সক্ষম হব।
[এম এ এন সিদ্দিক ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাঁর বক্তব্য অনুলিখন করেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সিনিয়র ফিচার লেখক আরিফুল ইসলাম মিঠু।]