মেট্রোরেল: দেশের ভারী শিল্পের সক্ষমতার প্রতীক
ঢাকা মেট্রোরেল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম এক উচ্চতার প্রতীক। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারী শিল্প সক্ষমতার পরীক্ষায় পাশ করলো বাংলাদেশ। প্রথম আন্তর্জাতিক মানের এ অবকাঠামো তৈরির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল, বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক মানের নির্মাণ সামগ্রী ও পরিষেবা উৎপাদন করতে পারে।
প্রকল্পের মূল কাঠামো নির্মাণে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টন ইস্পাত এবং সাড়ে ৩ লাখ টন সিমেন্টের পুরোটাই সরবরাহ করেছে স্থানীয় কোম্পানি। নির্মাণকাজে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি মূল ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছে স্থানীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড। মেট্রোরেলের সৌন্দর্যবর্ধণে রঙের সরবরাহ নিশ্চিত করেছে স্থানীয় রঙ-নির্মাতা বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড। এছাড়া, মেগা প্রকল্প সংক্রান্ত পরামর্শ, তদারকিসহ সিভিল ওয়ার্কের একটি বড় অংশেও কাজ করছেন বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা।
প্রকল্প কর্মকর্তাদের মতে, স্থানীয় নির্মাণ সহায়তা প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের ইট-বালি সরবরাহ থেকে শুরু করে, সৌন্দর্যায়ন ও অন্যান্য অবকাঠামোগত কাজে সহায়তা করেছে। যা অনেকাংশেই কমিয়েছে প্রকল্পের ব্যয়। এই কাজের অভিজ্ঞতা এবং প্রকৌশল দক্ষতা ভবিষ্যতে আরও বড় মাপের নির্মাণকাজের পথ প্রশস্ত করবে বলে মনে করছেন তারা।
মেট্রোলের মূল দায়িত্ব রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) হাতে। এই সংস্থার ব্যাবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেন, "মেট্রোরেল নির্মাণের বড় অংশই হলো সিভিল ওয়ার্ক। আমাদের ধারণা ছিল, মেট্রোরেলের সিভিল ওয়ার্কের সব নির্মাণ উপাদানই বিদেশ থেকে আমদানি হবে। কিন্তু স্থানীয় কোম্পানিগুলো আমাদের ভুল প্রমাণিত করেছে। তাদের উৎপাদিত রড-সিমেন্ট আন্তর্জাতিক মানের হওয়ায় বিদেশে যেতে হয়নি। ফলে খরচও লেগেছে কম।"
তিনি বলেন, মেট্রোরেলের শুরুর পয়েন্ট- দিয়াবাড়ি ডিপো, স্টেশন, পিলার নির্মাণ, লাইন টানানোসহ প্রায় সবকিছুতে স্থানীয় রড-সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে।
"ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি কাজ শুরু করার আগে স্থানীয় কয়েকটি কোম্পানির পণ্য যাচাই করে দেখেছে; পরীক্ষা-নিরীক্ষিায় গুণগত মান যথেষ্ট হওয়ায় বিদেশে যেতে হয়নি," যোগ করেন এম এ এন সিদ্দিক।
রডের যোগান দিয়েছে বিএসআরএম, একেএস, কেএসআরএম
মেট্রোরেল প্রকল্পে ব্যবহৃত সব রড তৈরিতেই ব্যবহার করা হয়েছে বৈশ্বিক সর্বশেষ প্রযুক্তি। স্থানীয় কোম্পানিগুলো এই প্রযুক্তির সক্ষমতা অর্জন করায় রডের জন্য বিদেশ নির্ভরতায় যেতে হয়নি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কোম্পানিগুলোকে।
প্রকল্পের মোট ১.৭৯ লাখ টন চাহিদার মধ্যে শুধু বিএসআরএমই দিয়েছে ১.১৪ লাখ টন রড। দেশের শীর্ষ ইস্পাত উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম তাদের জনপ্রিয় উচ্চশক্তিসম্পন্ন রড 'এক্সট্রিম ৫০০ ডব্লিউ' সরবরাহ করেছে এই প্রকল্পে। পদ্মা সেতুতেও সবচেয়ে বেশি রড দিয়েছে বিএসআরএম।
"প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় ৬৫ শতাংশ রড সরবরাহ করেছে বিএসআরএম। বুয়েট এবং মেট্রোরেলের আন্তর্জাতিক কন্ট্রাকটররা (ঠিকাদার) পরীক্ষা করে পণ্য ও পরিষেবাগুলোর গুণগতমান এবং পণ্য সরবরাহের সক্ষমতায় দক্ষতার কারণে আমাদের বেছে নিয়েছে," বলেন বিএসআরএম-এর উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত।
তিনি বলেন, "বিএসআরএমের যত পণ্য আমরা দিয়েছি তার কোনোটিরই মান নিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণ কোম্পানি কোনো অভিযোগ দেয়নি। আমাদের বাইরে অন্য কোম্পানি থেকেও যতটুকু নেওয়া হয়েছে সেটিও একই মানের।"
দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ ইস্পাত কারখান আবুল খায়ের স্টিল মিলস (একেএস) ৪৫ হাজার টন রড সরবরাহ করেছে এই মেগা প্রকল্পে। একেস-এর সরবরাহ করা চালানে অত্যাধুনিক উত্পাদন প্রযুক্তি টিএমটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা রাস্তা তৈরির প্রক্রিয়ায় মাইক্রোস্ট্রাকচার পরিমার্জন করার পাশাপাশি রাস্তার কুলিং এবং হিটিং প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত।
মেট্রোরেলের লাইন-৬ এ কেএসআরএম তাদের '৫০০-ডব্লিউ' উচ্চশক্তির ২০ হাজার টনের বেশি রড সরবরাহ করেছে বলে জানান কোম্পানির সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মোঃ জসিম উদ্দিন।
তিনি বলেন, "মেগা প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য কেএসআরএম ৫০০-ডব্লিউ গ্রেড মানের রড উৎপাদন করেছে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে উৎপাদিত এ রড পদ্মা সেতু নির্মাণেও ব্যবহার করা হয়েছে।"
সিভিল ওয়ার্কের সব সিমেন্ট বসুন্ধরার
মেট্রোরেলের ডিপো-স্টেশন নির্মাণ, বেইজ স্থাপন, পিলার এবং স্প্যান বানাতে মূল উপাদান ছিল সিমেন্ট। মূল রেল লাইনের গ্রানাইড এবং স্টোন ইউরোপ থেকে আসলেও, সিভিল ওয়ার্কের সব কংক্রিট তৈরি হয়েছে সিমেন্ট দিয়ে। স্থানীয় সিমেন্ট দিয়েই হয়েছে তৈরি হয়েছে এই রেডিমিক্স। আর এই সিমেন্ট সরবরাহ করেছে দেশিয় কোম্পানি বসুন্ধরা।
ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ বলছে, এখন পর্যন্ত সিভিল ওয়ার্ক শেষ হওয়া উত্তরা-মতিঝিল অংশে সিমেন্টের প্রয়োজন হয়েছে ৩.৪৮ লাখ টন। ব্যবহৃত এ সিমেন্টের সম্পূর্ণটাই বসুন্ধরা সিমেন্ট মিলসের সরবরাহ করা।
বসুন্ধরা সিমেন্টের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা খন্দকার কিংশুক হোসেন বলেন, "জার্মান প্রযুক্তিতে ভার্টিকেল রোলার মিলে সিমেন্ট উৎপাদনে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করে বসুন্ধরা সিমেন্ট। আমাদের পণ্যের গুণগত মান দেখেই এটি নির্বাচন করা হয়েছে।"
পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত সিমেন্টের ৮০ শতাংশের বেশি বসুন্ধরা সরবরাহ করেছে বলেও উল্লেখ করেন কিংশুক হোসেন।
এছাড়া, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের আবাসন ভবনসহ বেশকিছু কাজে আরেক স্থানীয় কোম্পানির পণ্য শাহ সিমেন্টও ব্যবহার হয়েছে বলে জানিয়েছে নির্মাতা কোম্পানিগুলো।
মূল ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছে আব্দুল মোনেম লিমিটেড
যমুনা সেতু, পদ্মা সেতুসহ বড় বড় সব প্রকল্পই বিদেশি নির্মাতা কোম্পানি দিয়ে কাজ করিয়েছে বাংলাদেশ। সক্ষমতা এবং কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় টেন্ডারে অংশগ্রহণের সুযোগই ছিল না দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর। এবার মেট্রোরেলের নির্মাণকাজে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছে বাংলাদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান।
আব্দুল মোনেম লিমিটেড মূল ঠিকাদার হিসেবে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার সিভিল ওয়ার্ক করেছে মেট্রোরেল প্রকল্পের আগারওগাঁও-কারওয়ান বাজার অংশে।
২০ কিলোমিটর সিভিল ওয়ার্কের মধ্যে ৩ কিলোমিটার করেছে টেক্কেন-আব্দুল মোনেম-অ্যাবেনকো জয়েন্ট ভেঞ্চার। এর ডেপুটি অথরাইজড রিপ্রেজেন্টেটিভ মাহমুদ হোসেন বলেন, পদ্মা সেতুতে সাব-কন্ট্রাকটর হিসেবে কাজ করে আন্তর্জাতিক মেগা প্রকল্পের অভিজ্ঞতা হয়েছে আব্দুল মোনেমের। এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক টেন্ডারে প্রতিযোগীতা করে কাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ দুটি প্রকল্পে কাজ করার ফলে দেশে আন্তর্জাতিক মানের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তৈরি হয়েছে বিপুল পরিমাণ প্রকৌশলীও।
তিনি জানান, মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে স্থানীয় কোম্পানি আব্দুল মোনেমের ৫০০ শতাধিক কর্মীর মধ্যে ৮০ শতাংশই বাংলাদেশি।
"অফিস স্টাফ, লেবার এবং জুনিয়ার স্টাফ সবই স্থানীয়। প্রথমদিকে বিদেশি বেশি ছিল। স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর বিদেশি কমেছে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে হিউমেন রিসোর্স গঠনেও বড় ভূমিকা রেখেছে আব্দুল মোনেম," যোগ করেন তিনি।
একমাত্র দেশিয় কোম্পানি হিসেবে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ সরাসরি কন্ট্রাকটর বা ঠিকাদারদের কাছ থেকে রঙ সরবরাহের অর্ডার পেয়েছে; এছাড়া মেট্রোরেল প্রকল্পে অন্যান্য প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানেও অংশ নিয়েছে কোম্পানিটি।
বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী হক চৌধুরী বলেন, বার্জার এত বড় একটি প্রকল্পের নির্মাণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পেরে অত্যন্ত গর্বিত।