পেঁয়াজের অগ্নিপরীক্ষা: দুই বছর ধরে শম্বুকগতিতে এগোচ্ছে ‘গেম চেঞ্জার’ কোল্ড স্টোরেজ তৈরির পরিকল্পনা
২০১৯ সালে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় বাংলাদেশের ভোক্তাদের মধ্যে। শুধু তা-ই নয়, এর প্রভাবে সার্বিকভাবে পণ্যবাজারও অস্থির হয়ে ওঠে। পেঁয়াজের দাম ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। বাজারের অস্থিরতা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তই কাজে আসেনি।
মজার বিষয় হলো, ২০২০ বাংলাদেশের পেঁয়াজ আমদানির পেছনে খরচ হয়েছে ১৭০ মিলিয়ন ডলার। ওই বছর পেঁয়াজের ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি (পোস্ট-হার্ভেস্ট লস) ছিল ৭ লাখ ৮২ হাজার টন। যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন ও আমদানির তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণ করে শিল্পসংশ্লিষ্ট ও স্টেকহোল্ডাররা এ তথ্য দিয়েছেন।
এ সংকট থেকে উত্তরণের একটি ভালো উপায় নিয়ে এগিয়ে আসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যদিও উদ্যোগটি কার্যকর করার জন্য যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে এগোতে পারেনি।
সরকারি পর্যায়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ তৈরির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়। প্রধান মশলাটির সরবরাহ নিশ্চিতে ও আমদানিনির্ভরতা কমাতে পেঁয়াজ উৎপাদনের দুটি বড় কেন্দ্র ফরিদপুর ও পাবনায় কোল্ড স্টোরেজ তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২০ সালের অক্টোবরে মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর সম্ভাব্যতা প্রতিবেদন প্রস্তুতের দায়িত্ব দেওয়া হয় সংস্থাটিকে।
এই সিদ্ধান্তের দুই বছর পর অগ্রগতি এখনও সম্ভাব্যতা সমীক্ষার মধ্যেই আটকে আছে। টিসিবি সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তাদের সমীক্ষাসহ সুপারিশ পাঠিয়েছে। এখন সংস্থাটি অপেক্ষা করছে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরির অনুমতির জন্য।
সমীক্ষায় যে খুব চমকপ্রদ কোনো তথ্য তুলে আনা হয়েছে, তা-ও না। সেই জানা কথাই উঠে এসেছে সেখানে—ফরিদপুর ও পাবনায় স্টোরেজ তৈরি করা যেতে পারে।
টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ করেছি, মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে পেঁয়াজের কোল্ড স্টোরেজ তৈরির প্রকল্পের জন্য ডিপিপির কাজ শুরু করবো।'
তিনি অবশ্য সমীক্ষাটি প্রস্তুত করতে দেরি হওয়ার কারণ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি।
শিল্পসংশ্লিষ্ট ও স্টেকহোল্ডাররা মনে করছেন, কোল্ড স্টোরেজ হলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। কারণ প্রতি বছর শুধু সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার অভাবেই লাখ লাখ টন পেঁয়াজ পচে যাচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য বলছে, পেঁয়াজের ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতির হার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। এর ফলে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। আবার এই ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে আমদানি করে।
পেঁয়াজের ঘাটতির বেশিরভাগ পূরণ করা হয় ভারত থেকে আমদানি করে। আর ভারত যদি স্থানীয় পরিস্থিতি বা নিজেদের বাজারে ঘাটতির কারণে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে পাকিস্তান, মায়ানমার, মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেঁয়াজের কোল্ড স্টোরেজ ব্যবস্থাপনা যদি তৈরি করা যায়, তাহলে আমদানির ওপর থেকে নির্ভরতা একেবারেই কমিয়ে আনা সম্ভব। সেক্ষেত্রে কোল্ড স্টোরেজই হয়ে উঠতে পেঁয়াজের অর্থনীতি পরিবর্তনের গেম চেঞ্জার।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৃষি বিভাগের অর্থায়নে চলমান বাংলাদেশ ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন প্রকল্প বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন খাতে ব্যবসার সম্ভাবনা তুলে ধরে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে তুলতে এবং বিনিয়োগ করতে নানা ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে।
পেঁয়াজ আমদানির জন্য বাংলাদেশ মূলত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদনকারী ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এতে ভারতের পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলে তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারেও। ২০১৯ সালে মৌসুমি অতিবৃষ্টির কারণে পেঁয়াজ সংগ্রহে বিলম্ব ও সরবরাহ সংকুচিত হয়ে গেলে ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এতে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৩০০ টাকায় উঠে যায়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টনের বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ৩৩ লাখ টনের বেশি।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন বলছে, বাংলাদেশকে প্রতি বছর ৬-৭ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। এর প্রধান কারণ পেঁয়াজের ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি।
পেঁয়াজের শেলফ-লাইফ বাড়াতে বিকিরণ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে বিনা
এদিকে কোল্ড স্টোরেজের পাশাপাশি পেঁয়াজের শেলফ লাইফ বাড়াতে বঙ্গবন্ধু গামা ইরেডিয়েশন সেন্টার স্থাপনের কাজ করছে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অভ নিউক্লিয়ার এগ্রিকালভার (বিনা)।
বিকিরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানোর পাশাপাশি জীবাণুমুক্তও করা হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পেঁয়াজের শেলফ লাইফ ৩-৪ মাস পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
২০২১ সালে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করে বিনা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর প্রকল্প প্রস্তাবনাটি এখন পরিকল্পনা কমিশনে আছে।
বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বিকিরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বছরে ১ লাখ টন পণ্যে বিকিরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে। তবে এটি বাস্তবায়ন করলেও ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি লস কমিয়ে আনতে হলে পরের ধাপে স্টোরেজ সিস্টেম গড়ে তোলার বিকল্প নেই।'
১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে গামা ই-রেডিয়েশন সেন্টারটি তৈরি করা হবে গাজীপুরের ভবানিপুর এলাকায়।
বেসরকারি খাতের উদ্যোগ
সরকারি উদ্যোগেরও অনেক আগেই কোল্ড স্টোরেজ তৈরির উদ্যোগ নেয় বেরসকারি খাত।
রাজশাহীর ফজলুর রহমান কোল্ড স্টোরেজ ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন ২০০৪ সালে। গতানুগতিক আলুর কোল্ড স্টোরেজ না করে তিনি বিশেষভাবে তৈরি করেন পেঁয়াজ সংরক্ষণের স্টোরেজ। প্রায় ১৫ কোটি ব্যয়ে তৈরি করা ৩ হাজার টন ধারণক্ষমতার এই স্টোরেজটি মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করতে না পেরে শেষে পেঁয়াজ সংরক্ষণ বন্ধ করে দেন এই উদ্যোক্তা।
কোল্ড স্টোরেজে পেঁয়াজ সংরক্ষণের বিষয়ে মানুষের মধ্যে ধারণা না থাকায় দুই বছরে কেউ পেঁয়াজ রাখতে আসেনি। তখন ফজলুর রহমান নিজেই বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনে সংরক্ষণ করেন। কিন্তু দুই বছরেই পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা থাকায় হঠাৎ দাম পড়ে যাওয়ার কারণে তিনি বড় অঙ্কের লোকসান গোনেন। শেষতক পেঁয়াজের কোল্ড স্টোরেজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ফজলুর রহমান বলেন, 'এখানে প্রযুক্তিগত কোনো দুর্বলতা ছিল না। পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে অনায়াসেই ৭-৮ মাস পর্যন্ত রাখা যায়। এর প্রসেস লসও ৫ শতাংশের বেশি না।'
বাংলাদেশ ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, পেঁয়াজের বাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে হবে। স্টোরেজ ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদনকারী ও পাইকারি বিক্রেতাদের দ্রুত এই পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি করে দিতে হয়, বেশি সময় রেখে দেওয়া যায় না।
এজন্য প্রথাগত পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ না করে তাপমাত্রা-নিয়ন্ত্রিত লজিস্টিকস (টিসিএল) সাপোর্টের দিকে জোর দিতে হবে। দেশব্যাপী টিসিএল গড়ে তুলতে পারলে পেঁয়াজের ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তারা।
সম্প্রতি উদ্যোক্তারা এই খাতের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। ইতিমধ্যে দেশের ৫টি বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কোল্ড স্টোরেজ ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করে কাজও শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরামর্শদাতা সংস্থা লিক্সক্যাপের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ সাদ এল জাই টিবিএসকে বলেন, 'সংরক্ষণ সক্ষমতা না থাকায় পণ্য তৎক্ষণাৎ বিক্রি করে দিতে হয় বলে বাংলাদেশি কৃষকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি আছে।'
কোল্ড চেইন না থাকায় পণ্যের নিরাপত্তা ও মান বজায় রাখতে পারেন না বলে বাংলাদেশি কৃষকরা বাজারের অবস্থার ওপর নির্ভরশীল বলেও মন্তব্য করেন এল জাই।
ইউএসডিএ বাংলাদেশ ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মাইকেল জে পার টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশের কৃষি রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও বৃদ্ধির জন্য একটি দক্ষ কোল্ড চেইন প্রয়োজন।
'অপচয় কমাতে এবং স্থানীয় ভোক্তাদের জন্য দাম স্থিতিশীল রাখার জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ,' বলেন তিনি।