চিকিৎসক-সংকট, নেই পর্যাপ্ত শয্যা; ভোগান্তিতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগীরা
অধিক রোগীর চাপে বিভিন্ন ওয়ার্ডের শয্যা থেকে বারান্দা পর্যন্ত কোথাও ফাঁকা নেই খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (কেএমসিএইচ)। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কোনোরকমে একটু বিছানা ফেলার জায়গা পেতে ঘুরতে হচ্ছে হাসপাতালের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে।
অন্যদিকে হাসপাতালে রয়েছে চিকিৎসক সংকট। কর্তৃপক্ষ বলছে, দ্রুত শয্যা সংখ্যা না বাড়ালে ভবিষ্যতে হাসপাতালের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে।
১৯৮৯ সালের ১৭ জানুয়ারি নগরীর বয়রা এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট খুলনা হাসপাতাল, ১৯৯২ সালে যা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়।
অধিক রোগীর চাপের কারণে ২০০৮ সালে হাসপাতালটিকে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বর্তমানে সেখানে ১৬টি বিভাগের আওতাধীন ৩১ ওয়ার্ডে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
অধিক রোগীর চাপ
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রেজাউল ইসলাম ভর্তি হয়েছেন হাসপতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে। এক সপ্তাহ তাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে ওই ওয়ার্ডের বারান্দাতে।
তিনি বলেন, 'আমি সড়ক দুর্ঘটনার পরে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলাম বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তবে অবস্থার অবনতি হওয়ায় আমাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। এখানে চিকিৎসা নিতে এসে ভোগান্তি আরও বেশি হয়েছে।'
খুলনাঞ্চলের ১২ জেলার ১২টি জেনারেল হাসপাতাল ও ৭৬টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সেখানে রোগী রেফার করা হয়। যার ফলে হাসপাতালে প্রতিদিনই ১৪০০ থেকে ১৫০০ জনের মত রোগী আন্তঃবিভাগে ভর্তি থাকেন। এছাড়াও হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে প্রতিদিন ১৫০০ থেকে ২০০০ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।
পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে হাসপাতালের আন্তঃবিভাগ থেকে মোট চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৮ হাজার ৩৩৭ জন। এছাড়া ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন ৮০ হাজার ৫৬২ জন।
এছাড়া, ২০২১ সালের হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে মোট চিকিৎসা নিয়েছেন ৩ লাখ ৯ হাজার ৭৩৮ জন। এছাড়া ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন ৩ লাখ ৩১ হাজার ২৮২ জন।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. রবিউল হাসান বলেন, 'সরকারিভাবে এখানে অনুমোদিত রোগীর ধারণক্ষমতা ৫০০ শয্যার। এখানে নিয়মিত ভর্তি থাকেন প্রায় ১৫০০ জনের মতো। যা ধারণক্ষমতার তিনগুণ বেশি।'
'হাসপাতালের বারান্দাসহ কোথাও জায়গা ফাঁকা থাকে না। সবসময় রোগী ভর্তি থাকে। অতি শিগগিরই হাসপাতালের ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে, তাহলে রোগীদের ভোগান্তি কমবে।'
নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেখানে ২৮৮টি পদের চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও, তারমধ্যে ৮১টি পদই এখন ফাঁকা। এই হিসাবে হাসপাতালের ২৮ শতাংশ চিকিৎক নেই।
তাছাড়া, বর্তমানে হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়কও নেই। সিনিয়র কনসালট্যান্ট ৮ জনের বিপরীতে আছেন ৫ জন। অপারেশন থিয়েটারের অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ১০ জনের বিপরীতে আছেন মাত্র ২ জন, আইসিইউর অ্যানেসথেসিওলজিস্টের ৬ পদই শূন্য।
তাছাড়া, রেডিওলজিস্ট ৩ জনের মধ্যে আছেন ২ জন, রেজিস্টার ৪৪ জনের বিপরীতে আছেন ৩১ জন, সহকারী রেজিস্টার ৯১ জনের বিপরীতে আছেন ৬৩ জন, ইনডোর মেডিকেল অফিসার ৫৫ জনের বিপরীতে ৪৩ জন, আউটডোর মেডিকেল অফিসার ৩৬ জনের বিপরীতে ২৯ জন ও ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ৬ জনের বিপরীতে আছেন ৪ জন।
হাসপাতালে রোগীদের অপারেশনের আগে অজ্ঞান করে থাকেন অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের চিকিৎসকরা। ওই বিভাগের মোট ৩৮ পদের বিপরীতে চিকিৎসক আছেন মাত্র ৫ জন। এছাড়া ৩০টি পদ শূন্য রয়েছে। বাকি তিনজন চিকিৎসক অবসরে চলে গেছেন।
অপারেশনের সিরিয়ালে ৫০০ রোগী
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেখানে মাত্র দুইটি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) রয়েছে। যার মধ্যে একটি ব্যবহার করা হয় ইমার্জেন্সি রোগীদের জন্য। অন্যটি ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগীদের জন্য।
ইমার্জেন্সি ওটিতে মাত্র দুইটি বেড রয়েছে। সেখানে একসাথে দুইজনকে অপারেশন করতে পারেন চিকিৎসকরা।
সাধারণত সিজার, সড়ক দুর্ঘটনা, ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া, হামলা বা সংঘর্ষে আহত-এসব জাতীয় রোগীদের সেখানে তাৎক্ষণিক অপারেশন করা হয়।
অপরদিকে রেগুলার বা ভর্তি থাকা রোগীদের যে থিয়েটারে অপারেশন করা হয়, সেখানে বেড রয়েছে ৩টি। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১২টি ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগীদের অপারেশন করার জন্য সেখানে সাপ্তাহিক সিরিয়াল করে দেওয়া হয়েছে।
সাধারণত প্রতি শনিবারে গাইনী ওয়ার্ড, রোববারে সার্জারী-১ ওয়ার্ড, সোমবারে অর্থপেডিক্স, মঙ্গলবারে চোখ ও নাক, কান গলা, বুধবারে সার্জারী-২ ও বৃহস্পতিবারে গাইনী-২ ওয়ার্ডের রোগীদের অপারেশন করা হয়। এছাড়া ইউরোলজি, শিশু সার্জারী, বার্ণ এন্ড প্লাষ্টিক সার্জারী ওয়ার্ডের রোগীদের মাঝে মধ্যে সিডিউল করে ওই ওটিতে অপারেশন করা হয়।
পরিচালকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালের শুরু থেকে অক্টোবর পর্যন্ত হাসপাতালের দুইটি অপারেশন থিয়েটার থেকে অপারেশন করা হয়েছে মোট ৮ হাজার ২০৪ জনকে। যার মধ্যে জেনারেল সার্জারী করা হয়েছে এক হাজার ৭২৩ জনকে, অর্থপেডিক্স সার্জারী ৯৭৭ জনকে, নিউরো সার্জারি ১৫৩ জনকে, শিশু সার্জারী ৩৭১ জনকে, বার্ণ এন্ড প্লাষ্টিক সার্জারি ৮৪ জনকে, গাইনি সার্জারী এক হাজার ৪২৬ জনকে, নাক-কান-গলা সার্জারি ৫২৯ জনকে, চোখের সার্জারি ৪৪৪ জনকে, সিজার ২৩৩২ জনকে। এই হিসেবে সেখানে প্রতিদিন সার্জারি করা হয় গড়ে ২৭ জনকে।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. রবিউল হাসান বলেন, 'একদিকে অপারেশন থিয়েটরের সংকট, অন্যদিকে রোগীদের চাপ বেশি। যে কারণে আপারেশনের অপেক্ষায় থাকে প্রায় ৫০০ রোগী। এছাড়া অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের চিকিৎসক খুবই কম রয়েছে। যার প্রভাবও রোগীদের উপর পড়ছে।'
বাক্সবন্দি চিকিৎসা সরঞ্জাম
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেখানের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের দুটি সিটিস্ক্যান মেশিনের মধ্যে একটি, একমাত্র ৩০০ এম এ এক্সরে মেশিনটি, ৬টি আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিনের মধ্যে ২টি অচল অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া রেডিওথেরাপী বিভাগের ৬ এমভির লিনিয়ার এক্সিলেটর মেশিনটি দীর্ঘ এক যুগ ধরে বাক্সবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
মেশিন থাকা স্বত্ত্বেও স্থাপন না হওয়ায় কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন খুলনাঞ্চলে ক্যান্সারের রোগীরা।
খুমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি এন্ড অনকোলজি বিভাগের তথ্য মতে চলতি বছরের সেখানে থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৬০০ জন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী।
রেডিওথেরাপী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মুকিতুল হুদা বলেন, 'ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের তিন ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তা হলো, কেমো, রেডিওথেরাপী ও সার্জারী। আমাদের এখানে কেমো ও সার্জারী করা হয়। কিন্তু আমরা রেডিওথেরাপী দিতে পারি না।'
তিনি বলেন, 'আমাদের এখানে রোগীদের রেডিওথেরাপী দেওয়ার জন্য লিনিয়ার এক্সিলেটর মেশিন দেওয়া হয়েছিল। এক যুগ ধরে বাক্সবন্দি থাকায় এখন অকোজ হয়ে গেছে। এটা দিয়ে আর কোন কাজ করা সম্ভব নয়।'
'কিছু রোগী আছে যাদের কেমো বা সার্জারীর পর টিউমার ধ্বংস করতে রেডিওথেরাপীর দরকার হয়। আবার কিছু রোগীদের শুধু রেডিওথেরাপীর দরকার হয়। তাদেরকে আমরা ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রেফার করি।'
খুলনা মেডিকলে কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. রবিউল হাসান বলেন, 'আমাদের হাসপাতালে নতুন একটি ৬ তলা বিশিষ্ট রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের ভবন তৈরি করা হচ্ছে। ভবনটি হয়ে গেলে, পর্যাপ্ত জনবল ও যন্ত্রপাতি মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হবে। তখন হাসপাতালের রোগীদের আর বাইরে থেকে বাড়তি সেবা নিতে হবে না।'