বিয়েতে এখন ছেলেরাও কেন মেকআপ নেয়?
লীলাবালি লীলাবালি, বড় যুবতী সই গো, কী দিয়া সাইজাইমু তরে?
বাঙালির বিয়ের রীতিতে লীলাবালির সাজের জন্য জল্পনা-কল্পনা চলে মাসের পর মাস ধরে। জামাকাপড়ের সাথে মিল রেখে কেমন হবে মেকআপ, কে সাজাবে বিয়েতে, কত দিন আগে বুকিং করতে হবে—এসব নিয়ে থাকে বিস্তর পরিকল্পনা।
কিন্তু আয়োজনের আরেক মধ্যমণি বরের সাজসজ্জা নিয়ে কয়েক বছর আগেও এদেশে মাথা ঘামানো হত কদাচিৎই। বরের পোশাক-আশাক কেনা হয়ে গেলেই তার সাজের চিন্তা শেষ হয়ে যেত। সাধারণ পুরুষেরা বিয়েতে মেকআপ করবে, এমনটা চিন্তাও করা হতো না খুব একটা। ফলস্বরূপ ভারী মেকআপ করা কনের পাশে বিশেষ দিনের অনুষ্ঠানে অনেকটাই ফ্যাকাশে দেখাত বরকে।
তবে সময়ের সাথে সাথে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে মানুষের চিন্তাধারায়। বিয়েতে নিজের মেকওভার নিয়ে বেশ সচেতন আধুনিক বরেরা। জীবনের সবচেয়ে বিশেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে জেন্টস পার্লারের নানা ধরনের সেবার পাশাপাশি সামঞ্জস্যপূর্ণ ওয়েডিং মেকআপও নিচ্ছেন তারা।
ঢাকায় ছেলেদের রূপসজ্জার অন্যতম প্রতিষ্ঠান পারসোনা অ্যাডামসের ধানমন্ডি শাখার ম্যানেজার মাসুম বিল্লাহ খান বলেন, 'এতদিন সবাই মেয়েদের মেকাপেই অভ্যস্ত ছিল। তখন ছেলেরা যেটা করত, বেশিরভাগই ছিল মডেল মেকআপ বা টিভিতে উপস্থাপনার জন্য মেকআপ। এখন বরেরাও মেকআপ করে। কিন্তু সাধারণত বরেরা এখনো চায় না তারা মেকআপ করেছেন সেটা কেউ জানুক বা সাজ দেখে বোঝা যাক। তাই আমরা বরের মেকআপে ন্যাচারাল লুকটাই বজায় রাখি। যেন সরাসরি দেখে বোঝা না যায় আবার ক্যামেরা লুকটাও পারফেক্ট থাকে।'
মাসুম বিল্লাহর মতে, গত চার-পাঁচ বছর ধরে বিয়েতে বরের মেকআপ করার ধারণা বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বরের সাজগোজের ক্ষেত্রে মেকআপের চেয়ে তার ব্যক্তিগত যত্নের প্রতিই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিয়ের কয়েকদিন আগে থেকেই চুল-দাড়ি কাটা, বডি স্পা, হেয়ার স্পা, হেয়ার কালার, বিশেষ ফেসিয়াল, ফেয়ার পলিশ, পেডিকিউর, মেনিকিউর ইত্যাদি সার্ভিস নেওয়ায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন হবু বরেরা। জেন্টস পার্লারগুলো এসব সার্ভিস আর মেকআপসহ বিশেষ ওয়েডিং প্যাকেজ অফার করে থাকে। বিয়ের অনুষ্ঠানের সময়সূচী অনুযায়ী কাস্টমাইজ করে নেওয়া যায় এই প্যাকেজগুলো।
পারসোনা অ্যাডামসে বিয়ের মেকওভার নিতে এসেছিলেন মোহাম্মাদপুরের সাজিদ। তিনি বলেন, 'আগে কখনো মেকআপ করা হয়নি আমার। হবু স্ত্রীর পরামর্শেই এখানে আসা। আসলে বিয়ের দিনের স্মৃতিটা তো সারাজীবন থেকে যায়, তাই ছবিতে যেন ভালো দেখায় তাই একটু টাচ-আপ করতে এলাম। মেনিকিউর, পেডিকিউর, ফেসিয়াল আর ন্যাচারাল লুকের মেকআপ নেব এখানে। বিয়েতে ছেলেদের মেকআপ করা তো এখন বেশ জনপ্রিয়।'
ছেলেদের সাজসজ্জার জন্য ঢাকার আরেক জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান ধানমন্ডির হেয়ারোবিক্স। সেখানকার কর্মচারী আশিস সরকার জানান, শুধু হবু বরেরাই নয়, তার বন্ধু ও অন্যান্য সঙ্গীরাও মেকআপ করে থাকেন অনুষ্ঠানের জন্য। বেশিরভাগ সময় তারা এত হালকা সাজ চান যে, শুধু ফাউন্ডেশন দিয়েই মেকআপ সেরে ফেলা হয়। সাজ দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য দেওয়া হয় সেটিং স্প্রে।
উত্তরার গ্রুমিং লাউঞ্জ মেকওভার সেলুন ফর ম্যান-এর ম্যানেজার বলেন, 'ছেলেরা এখন অনেকটাই সচেতন নিজেদের লুক আর গ্রুমিং নিয়ে। বিয়ের প্রিপারেশনের শুরুতেই তারা মাথায় রাখেন পার্সোনাল কেয়ারের বিষয়টি। বিয়ের সিজনে আমাদের এখানে প্রতিদিনই ভিড় থাকে হবু বরদের।'
বিয়ের অনুষ্ঠান অনুযায়ী বরের সাজ আর ব্যক্তিগত যত্নের প্যাকেজগুলোতে খরচ পড়ে ৬ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। কয়েকদিনের অনুষ্ঠানের জন্য সুবিধাজনক সময়ে ভাগ করে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে প্যাকেজগুলো। প্যাকেজ অনুযায়ী দুই-তিন ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয় পুরো মেকওভারে।
কেউ চাইলে পুরো প্যাকেজ না নিয়ে নিজেদের সুবিধামতো মেকওভার সার্ভিসও নিতে পারেন জেন্টস পার্লারগুলোতে। কনের মেকওভারের মতো এখানে দীর্ঘ সিরিয়াল না থাকলেও অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে পছন্দের জেন্টস পার্লারে বুকিং দিয়ে রাখলে নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে অপেক্ষায় সময় নষ্ট করতে হয় না।
বিশেষ দিনে নিজেকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে জেন্টস পার্লারে না গিয়েও চাইলে ঘরে বসেই সেরে নেওয়া যায় হালকা মেকআপ। সেক্ষেত্রে আগেই সেলুন থেকে কোনো ভালো ফেসিয়াল করিয়ে নিতে হবে। নিত্যদিনের কাজকর্মে চেহারার ক্লান্তির ছাপ কমাতে আর ত্বকের সজীবতা ফিরিয়ে আনতে বিয়ের অনুষ্ঠানের সাজসজ্জার আগে ফেসিয়াল করে নেওয়া জরুরি। তাছাড়া ময়লা ত্বকে মেকআপ ঠিকভাবে বসবেও না।
সাজের শুরুতেই মুখে লাগাতে হবে ময়েশ্চারাইজার। এরপর ত্বকের রঙের সাথে মিলিয়ে ফাউন্ডেশন বা বিবি ক্রিম ভালোমতো ব্লেন্ড করে নিতে হবে মুখে ও গলায়। ত্বকের চেয়ে বেশি হালকা বা গাঢ় শেডের ফাউন্ডেশন হলে তা চেহারার সাথে মানানসই হবে না। তাই ফাউন্ডেশনের শেড নির্বাচনে সতর্ক থাকতে হবে।
চোখের নিচের কালি বা মুখের অন্য কোনো দাগ ঢাকতে কন্সিলার ব্যবহার করা যায়। শেষে হালকা ফেস পাউডার দিতে হবে। মেকআপ দীর্ঘস্থায়ী করতে ব্যবহার করতে হবে সেটিং স্প্রে। ঠোঁট নিষ্প্রাণ না দেখাতে চাইলে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে লিপবামের কথা। হেয়ার জেল ব্যবহার করা যায় চুলের স্টাইল ঠিক রাখতে।
ঘরে বসে বিয়ের সাজ সারতে চাইলে অবশ্যই অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগেই সাজের ট্রায়াল দিয়ে নিতে হবে। সাজসজ্জার ক্ষেত্রে একদমই আনাড়ি হলে সাথে রাখতে হবে অভিজ্ঞ কাউকে। অনলাইনের নানা মেকআপ টিউটোরিয়াল হতে পারে সবচেয়ে বড় সহায়ক।
তবে সাজ যেমনই হোক, বিয়ের অনুষ্ঠানে আত্মবিশ্বাসই বরের ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে পারে সবচেয়ে ভালো।