মনে পড়ে? রাজশাহীর সেই 'সুলেখা কালি'!
তখন পুটুর তিন কি চার বছর বয়স। স্লেট-চকের পাট চুকে রুল টানা খাতা আর পেন্সিলে পদার্পণ। কিন্তু পুটুর ইচ্ছে, কলম দিয়ে সাদা কাগজে আঁকিবুঁকি করার। এখনকার বাচ্চারা যেমন কলম হাতে নিয়ে ইচ্ছেমত আঁকিবুঁকি করতে পারে, তখন তেমন ছিল না। কলম হাতে পাওয়া বেশ কসরতের বিষয় ছিল তখন। বিশেষ করে, রঙ মাখামাখি করে ফেলার ভয়ে বাচ্চাদের হাতের নাগালের বাইরে উঠিয়ে রাখা হতো কালি-কলম। আর সেকারণেই বোধহয় কলমের প্রতি বিশাল আগ্রহ কাজ করতো পুটুর।
একদিন দুপুরবেলা সবাই যখন ঘুমুচ্ছে, সেই ফাঁকে পুটু গেল দাদুর ঘরে। এরপর সেই ছোট্ট ছোট্ট দুটো হাত আস্তে আস্তে আলমারি থেকে কলম আর একটি সাদা কাগজ বের করে নিলো। কিন্তু এ তো যে-সে কলম নয়, ঝর্ণা কলম। আর এতে থাকতো সুলেখা কালি।
ঝর্ণা কলম পুটুর হাতে, আর সুলেখা কালি উপরের তাকে। পুটুও নাছোরবান্দা। আজ কলম দিয়ে লেখার সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবেনা! খোঁচাখুঁচি করতে করতে একসময় কালির বয়্যাম পড়লো মাটিতে। বয়্যাম ভেঙ্গে চুরমার হয়ে সেই কালি মাটিতে মেখে একাকার…
সেদিনের সেই পুটু এখন আজ বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের একজন অধাপক। ভালো নাম অধ্যাপক ড. শমসের আলী (ছদ্মনাম)।
শমসের প্রায়ই নিউমার্কেটে আসেন কালি কিনতে। আজও এলেন, দু বোতল ডলার (কালির ব্র্যান্ড) কিনে নিয়ে চলে গেলেন। শুধু তিনি নন, তার দেখাদেখি তার ছাত্ররাও নাকি আসে মাঝে মাঝে কালি-কলম কিনতে।
স্টেশনারি দোকানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বাজারে এখন আবার ঝর্ণা কলমের ব্যবসা বাড়ছে। প্লাস্টিক বর্জন বা শখের জন্যই হোক, মানুষ এখন আবার ঝর্ণা কলমমুখী হচ্ছে। তবে এই কলমগুলোতে ভরা হয় খুব দামী বিলেতি কালি, না হয় চাইনিজ কালি। বিশেষ করে বাজারে এখন পাইলট, ডলার, মাউন্টব্ল্যাক, ডিয়ামাইন প্রভৃতি কালির বেশ নামডাক।
কিন্তু শমসের আলী ব্যতিক্রম। এখনও তিনি বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন সুলেখা কালি আর কলম দিয়ে। বাজারে সুলভ না হওয়ায় বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যেই সুলেখার কালি ও কলম ব্যবহার করেন তিনি। সুলেখার কলমটি তার বাবার ছিল। সেটি দিয়েই এখনো চলছে। আর সুলেখা কালি কিনে আনেন কলকাতায় গেলে। বাংলাদেশেও পাওয়া যায়, তবে শুধু একটি জায়গায়। কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাবার পর বাংলাদেশে এখন আর খুব একটা পাওয়া যায় না এই কালি । অথচ, এই সুলেখা একসময় দুই বঙ্গের মানুষের কাছেই ছিল এক নম্বর কালি।
স্বাধীনতার জন্য যে কালি
১৯৩০-৩৪ সাল। ভারতবর্ষে স্বদেশী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে ভারতবর্ষে একে একে বিদেশি পণ্যের বর্জন চলছে। কিন্তু গান্ধী নিজেই পড়লেন এক মহাবিপদে।
সেসময় দেশীয় কালির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ওদিকে চিঠিপত্র এবং লেখালেখির জন্য তার (গান্ধী) দরকার ভালো মানের কালি ও কলম। ফলে বাধ্য হয়ে তাকে বিদেশি কালির উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু স্বদেশী প্রতিবাদের কালিই যদি হয় বিদেশিদের পণ্য দিয়ে তাহলে কেমন করে হবে? তাই সিদ্ধান্ত নিলেন, দেশেই কালি তৈরি করার। আর এজন্য যোগাযোগ করলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশ চন্দ্র দাস গুপ্তের (যিনি বেঙ্গল কেমিক্যালসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন) সঙ্গে।
সতীশ চন্দ্র দাস গুপ্ত একসময় নিজেই 'কৃষ্ণধারা' নামে একটি কালি তৈরি করেছিলেন। তাই এই সমস্যা দূর করতে তিনি নিজের কালির ফর্মুলা তুলে দেন রাজশাহী নিবাসী দুই ভাই, ননীগোপাল মৈত্র আর শঙ্করাচার্য মৈত্রের হাতে। আর তাদেরকে উৎসাহ দিয়ে বলেন, 'তোমরা একটি কারখানা খোলো, যেখানে কালি তৈরি হবে, আর এই কালির গুণমান হবে বিদেশের থেকেও ভালো।'
জন্ম শহর রাজশাহী
কিন্তু কারখানা খুলতে টাকা লাগে, টাকা তো আর বললেই পাওয়া যায় না। ননীগোপাল মৈত্র আর শঙ্করাচার্য মৈত্রের মা সত্যবতী মৈত্র, যিনি নিজেও ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং একসময় রাজশাহী মহিলা সমিতির সভানেত্রী। মায়ের আশীর্বাদ এবং বাবা অম্বিকাচরণ মৈত্রের সারাজীবনের জমানো পুঁজি দিয়ে এই দুই ভাই কারখানা শুরু করলেন।
'স্বদেশি শিল্পই জাতির মেরুদণ্ড। স্বাধীন ভারতে বিদেশি কারখানা ক্ষতিকর' এই স্লোগান নিয়ে শুরু হলো সুলেখা কালির পথচলা। কিন্তু এই পথচলা খুব মধুর ছিল না। প্রথমদিকে টাকা-পয়সার খুব টান ছিল। যেসব জিনিসগুলো দরকার, সেগুলো যোগাড় হচ্ছে না। এভাবে চলতে চলতে শেষমেশ ঠিক হলো, কালি উৎপাদনের দায়িত্বে থাকবে পরিবারের নারীরা। আর বাইরে দোকানে সুলেখা কালি পৌঁছাচ্ছে কিনা, বিক্রি কেমন হচ্ছে, প্রচার কেমন হচ্ছে এসব দিকে নজর রাখবেন বাড়ির পুরুষ সদস্যরা।
এভাবে চলতে চলতে ১৯৩৪ সালে রাজশাহীতে যাত্রা শুরু 'সুলেখা-ওয়ার্কস'-এর। এরপর ১৯৩৬ সালে অনেক চাপের মুখে কলকাতার মহাত্মা গান্ধী রোডে সুলেখার কালির একটা নতুন শো-রুম খোলা হলো।
ব্যবসা রমরমা ছিল আশির দশকে, তবে বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে যায় দেশভাগের পরই
দু ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই ননীগোপাল মৈত্র শিক্ষকতার চাকরি পেলেন। এই চাকরি থেকে যা টাকা-পয়সা পেতেন, সবটাই তিনি ঢেলে দিতেন এই ব্যবসাকে বড় করার জন্য। একসময় এই চাকরিও ছেড়ে দিলেন। শেষমেশ লক্ষ্মী মুখ তুলে চাইলেন।
১৯৩৮ সালে সুলেখা কালির একটি নতুন কারাখানা খোলা হলো, বৌবাজার অঞ্চলে। তারপর বাজারের গুরুত্ব বুঝে ১৯৩৯ সালে কসবা এবং ১৯৪৬ সালে যাদবপুরে এই কারখানা স্থানান্তরিত হয়। এরপর পুরো অঞ্চলটার নামই পরিচিত হয়ে যায় সুলেখা নামে। যাদবপুর-সহ দক্ষিণ কলকাতার প্রায় সকলেই এখনও সুলেখার মোড় চেনেন।
এই বছরই প্রাইভেট লিমিটেড সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ সুলেখার। ১৯৪৮ সালে বার্ষিক টার্নওভার দাঁড়ায় এক লক্ষ টাকা। তত দিনে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ৬০ এর দশকে সুলেখার আরও দুটো কারখানা খোলা হয় সোদপুর এবং উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে। দীর্ঘদিন দেশের বাইরের বাজারেও ছিল সুলেখার চাহিদা।
কিছুদিনের মধ্যেই ফুলেফেঁপে ওঠে ব্যবসা। ৮০ এর দশকে শুরুর দিকে সুলেখা সবচেয়ে বেশি রমরমা ছিল। পরবর্তী চার দশকে বহুগুণ বৃদ্ধি পায় তাদের বিক্রি। এক সময় কোম্পানির মাসিক বিক্রি ছিল এক মিলিয়ন বোতল। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারের সংখ্যা ছিল ১ হাজারের বেশি। তবে বাংলাদেশে সুলেখা কালি আসা বন্ধ হয়ে যায় দেশভাগের পরেই৷
কেনিয়ায় নিজস্ব কারাখানাও তৈরি হয়েছিল
দেশ-বিদেশ থেকে কারখানা স্থাপনের জন্য সুলেখার কাছে আমন্ত্রণ আসতো। আফ্রিকায় প্রথম দুটো কালির কারখানা সুলেখাই গিয়ে তৈরী করে আসে।
আশির দশকের শেষের দিকে যাদবপুরে অবস্থিত বাঙালীর গর্ব আর অহংকারেরব সেই সুলেখার কারখানার দরজায় লেগে যায় তালা। শুধু সুলেখা নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের শাসনে পয়ষট্টি হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে যায় সেসময়। কিন্তু, তার আগে প্রতিদিন সকাল ছ'টা থেকে বেলা দুটো, আবার দুটো থেকে রাত দশটা দুই শিফটে কাজ চলতো এই কারখানায়।
যা-হোক... অনেক চড়াই-উৎরাই, মামলা মোকদ্দমা, ষড়যন্ত্রের শিকার হয় এই বাঙালি সংস্থা। ১৯৮৪ সালে পূর্ব ভারতের বাজারের ৮৯ শতাংশ দখলে ছিল সুলেখার। অথচ এই সংস্থাই হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় ১৯৮৯ সালে। ১৯৯১ সালে লিকুইডেশনে যায় সংস্থাটি।
নাম কেন 'সুলেখা'?
স্বাধীনতা সংগ্রামী অধ্যাপক ননীগোপাল মৈত্র প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি থাকার সময় পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাশ করেন। কারামুক্তির পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজে মাস্টার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হোন। আর দ্বিতীয় হওয়ার পেছনে কারণটাও ছিল অদ্ভুত। সাহেবী কলম দিয়ে লিখবেন না, তাই পেন্সিল দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি!
এই ননীগোপাল মৈত্রের নামেই বিভিন্ন মহলে সুলেখা কালি 'প্রফেসর মৈত্রের কালি' নামে পরিচিতি পেয়েছিল প্রথমে।
কিন্তু পরবর্তীতে নাম রাখা হয় 'সুলেখা'। এই কালি দিয়ে সুন্দর লেখা যেত, তাই নাম হয়ে গেল 'সু'লেখা। এ নিয়ে পেশায় ব্যারিস্টার ফাল্গুনী মঈদ বলেন, 'আমি যখন ছোটো ছিলাম, তখন বলপয়েন্টের যুগ শুরু হয়ে গেছে। আর সুলেখাও বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার বাবা আমার প্রথম কলমে হাতেখড়ি দেয় সুলেখা কালি আর কলম দিয়ে (বাসায় ছিল)। কারণ এতে নাকি হাতের লেখা সুন্দর হতো।'
তবে এর নামকরণ আসলে কে করেছিলেন তা নিয়ে একটু ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। অনেকের মতে, নাম রেখেছেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। আবার অনেকের মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এই কালির পথচলার সঙ্গে মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের মতো আরও থেকে শুরু করে অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম যুক্ত। গান্ধিজী থেকে শুরু করে, জওরলাল নেহরু, কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, ভারতের প্রাক্তন প্রধান্মন্ত্রী মোরারাজি দেশাই, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধাঞ্চন্দ্র রায় প্রমুখ ব্যবহার করতেন এই কালি।
আবার ফিরে এলো…
১৯৮৯ থেকে ২০০৬ সুলেখা বন্ধ থাকে। ইতিহাসের পাতায় সুলেখার যাত্রা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু শেষ হয়েও হলো না শেষ। সুলেখা আবার ঘুরে দাঁড়ালো ২০০৬ সালে। তবে কালি নয়, সুলেখায় তৈরি হতে শুরু করে হোমকেয়ার প্রোডাক্টস। ২০১১ সাল থেকে শুরু হয় সোলার প্যানেল তৈরি। সুলেখার কালিতে যাদের মন ডুবেছিল, তারা তখনও হতাশ।
কিন্তু হতাশার মেঘ ভেদ করে আলো দেখা দিল করোনার সময়ে। ফেসবুকে 'সুলেখা ইঙ্ক লাভার্স' নামে একটি গ্রুপ খোলা হলো, যেখানে সুলেখা কালি আবার বাজারে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন জনের অনুরোধ আসতে থাকলো। তাদের অনুরোধেই এই কালি ফের বাজারে এল ২০২০ সালে, সুলেখার স্বদেশী কালি মোড়কেই।
কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের হাতেই সুলেখার নবযাত্রা
১৯৩৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সুলেখা গোটা ভারত এবং বিদেশে তাদের দাপট চালিয়েছে। তবে, বাংলাদেশে সুলেখা আসা বন্ধ হয়ে যায় দেশভাগের পরেই। কারখানাও স্থানান্তরিত হয়ে রাজশাহী থেকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এ নিয়ে যমুনা টেলিভিশনের সাংবাদিক আমিন বাবু, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশে কালি ও ফাউন্টেনপেন নিয়ে একটি বই প্রকাশনার কাজে আছেন, বলেন, 'পাকিস্তান ও ভারত দুই রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ায় ভারত থেকে তখন আর পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সুলেখা কালি আসতো না। কিন্তু ষাটের দশকে বাংলাদেশে গড়ে ওঠে একটি সুলেখা কোম্পানি। অনেকেই বাংলাদেশী সেই সুলেখা কালিকেই ভারতীয় সুলেখা কালি ভেবে ব্যবহার করতেন। কিন্তু ভারতীয় সুলেখা আর ছিল না তখন এদেশে। সেই ৪৭ এর পর ২০২০ সালে বাংলাদেশে আবার শুরু হয় সে-ই ঐতিহ্যবাহী সুলেখা কালির বাজার।'
সুলেখা আবার ফিরে আসে তার জন্মশহর রাজশাহীতে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। আর এই নবযাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশি প্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক হাসান আজিজুল হকের শুভেচ্ছাবার্তা দিয়েই। যিনি নিজেও সুলেখা কালি ব্যবহার করতেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে সুলেখা কালি কেবল একজনই আমদানি করেন। তার নাম মিজানুর রহমান মিজান। কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাবার পর ২০২০ সাল থেকে সুলেখা আমদানি শুরু হয় তারই মাধ্যমে। নীলক্ষেতের গাউসুল আজম সুপার মার্কেটের নিচতলায় 'ডলফিন ইন্টারন্যাশনাল' দোকানে এবং তার ফেসবুক পেজ Pen Bazar BD তে বর্তমানে সুলেখা কালি পাওয়া যাচ্ছে। ক্রেতাদের জন্য হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও রয়েছে।
১৯৩৪ সাল থেকে 'সুলেখা কালি'র যে–গৌরব ছিল, তা আবার ফিরেছে নতুন চেহারায়। বিপণনের মোড়কটা শুধু বদলে 'স্বদেশী', 'স্বরাজ' আর 'স্বাধীন' এই তিন নামে মিলছে সুলেখা কালি। 'স্বদেশী'-তে তিনটি, 'স্বরাজ'-এ দশটি ও 'স্বাধীন'-এ দু'টি রঙের কালি পাওয়া যাচ্ছে।
শান্তিনিকেতনে প্রস্তুতকৃত বিশেষ বটুয়াতে কালো (এক্সিকিউটিভ ব্ল্যাক), নীল (রয়্যাল ব্লু) এবং লাল (স্কারলেট রেড) এই তিন রঙের তিনটি দোয়াত থাকছে তাদের লিমিটেড এডিশনে। প্রতিটি দোয়াতে ৬০ এমএল কালি। সবকিছু মিলিয়ে মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০০ টাকা (বাংলাদেশি মূল্যে)।
তবে এখানেই শেষ নয় সুলেখা কালির সংস্করণ। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং আমাদের শহীদ দিবসকে স্মরণ করে সুলেখা তৈরি করে, 'সুলেখা সেলাম'। যার প্যাকেটের গায়ে লেখা আমাদের ভাষাশহীদ সালাম, রফিক,বরকত, জব্বারদের নাম। শহীদদের রক্তের রঙ্গে প্যাকেটের রঙ লাল।
এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষ্যে সুলেখা বাজারে আনে 'গর্বের ৫০ বছর', প্যাকেট বা মোড়কের রঙ করা হয় বাংলাদেশের পতাকার সবুজে। সুলেখার এই দুটি সিরিজ কেবলই বাংলাদেশকে স্মরণ করে। দুটোই পাওয়া যাবে ৩৫০ টাকায়।
সুলেখা দিয়ে লিখেছেন এপার-ওপার, দুই বাংলারই মানুষ
১৯৩৪ থেকে দেশভাগের আগ পর্যন্ত সুই বাংলার ঘরে ঘরে ছিল এই সুলেখা কালি ও কলম।
কথাসাহিত্যিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিদিন ভোরে স্নান শেষে নিয়ম করে লিখতে বসতেন টেবিলে। নিজের লেখার টেবিলে প্রথমে সাদা কাগজে নীল রঙের সুলেখা কালি দিয়ে খুব ছোট ছোট অক্ষরে এক হাজার বার মা কালীর নাম লিখে তার পরে অন্য লেখার কাজ শুরু করতেন।
বাংলাদেশের প্রধান কথাহাসিত্যিক হিসেবে খ্যাত হাসান আজিজুল হক তার বিখ্যাত 'আগুনপাখি' উপন্যাস লিখেছিলেন সুলেখা কালি দিয়েই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি লিখে গেছেন সুলেখা কালি দিয়ে। তিনি বেঙ্গালুরু থেকে আনাতেন এই কালি।
এছাড়া নির্মলেন্দু গুণ, কবি হেলাল হাফিজ, কাজী আনোয়ার হোসেন, অনুবাদক খসরু চৌধুরীও পছন্দ লিখতেন সুলেখার দিয়ে।
এই কালির জনপ্রিয়তা এতটাই বাড়ে যে, সত্যজিৎ তাঁর ফেলুদার কাহিনিতে একাধিকবার সুলেখা কালির কথা লিখেছেন। 'চিঠিটা পড়ে ফেলুদা খাটের পাশের টেবিলের ওপর রাখা সুলেখা ব্লু-ব্ল্যাক কালিটার দিকে এক ঝলক দেখে নিল। চিঠিটা মনে হয় সেই কালিতেই লেখা'-(সমাদ্দারের চাবি, সত্যজিৎ রায়)
এছাড়া তার পরিচালিত চলচ্চিত্র 'জনঅরণ্য', 'জয় বাবা ফেলুনাথ' এ-ও দেখা গিয়েছে সুলেখা কালির দোয়াত। সুতরাং রায়বাবু যে শুধু লিখতেনই না, বরং একচেটিয়াভাবে পছন্দ করতেন এই কালি তা-ও স্পষ্ট।
বন্ধু হেমেন্দ্র মোহন বোসের অনুরোধে সুলেখা কালির বিজ্ঞাপনের রবীঠাকুর জিংগেলে লিখেছিলেন,'সুলেখা কালি'। এই কালি কলংকের চেয়েও কালো'। আবার কোথাও কোথাও বলা হয়েছে, বিধানচন্দ্র রায়ের মত ব্যক্তিত্ব এই কালির বিজ্ঞাপনে উপস্থিত হয়ে বিক্রি বাড়াতে সহায়তা করেছিলেন।
৪৭ এর দেশভাগের সময় এবং ৭১-এর যুদ্ধের সময়ে ও পরে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের অনেকেরই কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয় সুলেখা।
'বাঙালির গৌরব'
এখন সুলেখা কালি ফিরে এলেও, শৌখিন ছাড়া কেউ কেনেনা বলে জানান নিউমার্কেটের স্টেশনারির দোকান ব্যবসায়ী জাফর। তিনি বলেন, 'সুলেখা একসময় অনেক চলতো। কিন্তু এখন সুলেখার চেয়েও ভালো মানের (পাইলট, ডলার, মাউন্টব্ল্যাক, ডিয়ামাইন) কালি পাওয়া যায়। তাই মানুষ লেখার জন্য ওসব বিদেশি কালিই বেছে নিচ্ছে।'
কিন্তু একমাত্র সুলেখার আমদানিকারক মো মিজানুর রহমান বলেন, 'এখন মানুষ আবার আস্তে আস্তে ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করছে। এই নতুন কাস্টমাররা যখন বাজারে কালি কিনতে আসবে, তখন দেখবে সুলেখার মতো একটি কলমের কালি কীভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। বাঙ্গালির লড়াই সম্পর্কে জানবে তারা।'
প্রথমত স্বদেশি, তার ওপর ইংরেজ জব্দ করে ব্যবসা করেছে, তাই একসময় মৈত্রী ভাইদের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল দুই বাংলার বাঙ্গালিরা। বাঙ্গালিদের কাছে সুলেখা কেবল কালিই নয়, বরং এক জাতীয়তাবাদী প্রতিবাদ।
বহু বরেণ্য ব্যক্তি সুলেখা কালিতে লিখতেন। তাই বাজারে এরচেয়ে ভালোমানের হাজারো কালি থাকার পরও এখনও সুলেখা কালির নাম শুনলে তাদের পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায় যখন দুই বাংলা এক হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এই সুলেখার কালি দিয়ে…