তাইওয়ানের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে পঙ্গু করে দেবে: মার্কিন চিন্তক সংস্থা
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক একটি স্বাধীন চিন্তক সংস্থা (থিঙ্ক ট্যাঙ্ক) কম্পিউটারে একটি যুদ্ধাভিযান সিমুলেশনের ফলাফলের ওপর মত দিয়েছে যে, ২০২৬ সালে তাইওয়ানে চীনের আক্রমণের ফলে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান এবং জাপানের সামরিক বাহিনীর হাজার হাজার সেনা হতাহত হবে এবং এতে বেইজিংয়ের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। খবর সিএনএনের
তাইওয়ান নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে যদি যুক্তরাষ্ট্র বিজয়ী হয়ও, তারপরও এই যুদ্ধ তাদেরকে পরাজিত চীনা বাহিনীর মতোই পঙ্গু করে দিতে পারে। যুদ্ধেশেষে কমপক্ষে দুটি মার্কিন বিমানবাহী রণতরী প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে পড়ে থাকবে এবং চীনের আধুনিক নৌবাহিনী, যা বিশ্বের বৃহত্তম, পুরো বিধ্বস্ত হয়ে পড়বে।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)-এর দাবি অনুযায়ী, তাইওয়ান নিয়ে সম্ভাব্য সংঘাতের ওপর পরিচালিত সবচেয়ে বিস্তৃত ওয়ার-গেম সিমুলেশনগুলির মধ্যে এটি সেরা। ২ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার এই ভূখণ্ডের ওপর চীনা কমিউনিস্ট পার্টি দীর্ঘদিন ধরেই তাদের সার্বভৌমত্ব দাবি করে আসছে। চীনের নেতা শি জিনপিং দ্বীপটিকে বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে আনতে সামরিক শক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেননি।
সিএনএন "পরবর্তী যুদ্ধের প্রথম লড়াই" শীর্ষক প্রতিবেদনটির একটি অনুলিপি পর্যালোচনা করেছে, যেখানে তারা দাবি করেছে যে, এই গেমিং প্রকল্পটি প্রয়োজনীয় ছিল কারণ এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে করা যুদ্ধের সিমুলেশনগুলো খুবই অস্বচ্ছ ছিল। তাই তাইওয়ান প্রণালী জুড়ে বিরোধ-সংঘর্ষ কীভাবে হতে পারে– সে সম্পর্কে জনসাধারণ এবং নীতিনির্ধারকদের একটি পূর্ব ধারণা দিতে এই প্রকল্পটি পরিচালনা করা হয়।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একজন সিনিয়র উপদেষ্টামার্ক ক্যানসিয়ান বলেন, মার্কিন-চীনের এই সংঘাত নিয়ে যে ফলাফলগুলো প্রকাশ করা হয়নি, সেগুলো কেবল এক থেকে দুইবার করা হয়েছে। মার্কিন আক্রমণ সফল হবে কিনা এবং তা সফল করতে কী পরিমাণ খরচ করতে হবে– তা বের করতে সিএসআইএস ২৪ বার এই সিমুলেশন চালায়।
সিমুলেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, "যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপান কয়েক ডজন জাহাজ, শত শত বিমান এবং হাজার হাজার সৈন্যকে হারিয়েছে। এই ক্ষতি বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সিমুলেশনে বেশিরভাগ পরিস্থিতিতে, মার্কিন নৌবাহিনী দুটি বিমানবাহী রণতরীসহ ১০ থেকে ২০টি বড় যুদ্ধজাহাজ হারিয়েছে। তিন সপ্তাহের যুদ্ধে আনুমানিক ৩,২০০ মার্কিন সেনা নিহত হয়েছে, যা ইরাক এবং আফগানিস্তানে দুই দশকের যুদ্ধে নিহত মার্কিন সেনা সংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
যুদ্ধে "চীনও প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর নৌবাহিনী নড়বড়ে হয়ে যায়, এর উভচর বাহিনীর মূল অংশ ভেঙে পড়ে এবং হাজার হাজার সেনা যুদ্ধবন্দি হয়েছে।" প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে যে, চীনের প্রায় ১০ হাজার সেনা নিহত হবে, ১৫৫টি যুদ্ধ বিমান এবং ১৩৮টি বড় যুদ্ধজাহাজ হারাবে।
তাইওয়ান ধ্বংস হয়ে যাবে
চীনের অভিযান যদি সফল নাও হয়, তারপরও যুদ্ধ শুরু হলে তাইওয়ানের পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।
সিমুলেশন অনুযায়ী, "যদিও তাইওয়ানের সামরিক বাহিনী টিকে রয়েছে, তাদের অবস্থা প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়বে। বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য মৌলিক সুবিধা দ্বীপটিতে থাকবে না, অবকাঠামো ও অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। দ্বীপটির সেনাবাহিনীর প্রায় ৩,৫০০ জন হতাহতের শিকার হবে এবং এর নৌবাহিনীর ২৬টি যুদ্ধজাহাজ ও ফ্রিগেটের সবগুলোই ডুবে যাবে। জাপানের ১০০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান এবং ২৬টি যুদ্ধজাহাজ হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে, যখন তাদের ভূখণ্ডে থাকা মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো চীনা আক্রমণের মুখে পড়বে।"
তবে সিএসআইএস বলেছে যে, তারা চায় না যে তাদের প্রতিবেদনে তাইওয়ান নিয়ে যে যুদ্ধের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে তা 'অনিবার্য বা সম্ভাব্য' হিসেবে ধরে না নেওয়া হয়। তারা বলেন, "চীনা নেতৃত্ব কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা, সমুদ্রসীমায় চাপবৃদ্ধিসহ তাইওয়ানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বলপ্রয়োগের মতো কৌশল গ্রহণ করতে পারে।"
যুক্তরাষ্ট্রের প্রজেক্ট অন গভর্নমেন্ট ওভারসাইট (POGO)-এর একজন জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা নীতি বিষয়ক ফেলো ড্যান গ্রেজিয়ার অবশ্য তাইওয়ানে সরাসরি চীনা আগ্রাসনকে অত্যন্ত অবশ্যসম্ভাবী বলে মনে করেন। তার মতে, এই ধরনের সামরিক অভিযান আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যকে ব্যাহত করবে- যার ওপর চীনা অর্থনীতি টিকে রয়েছে।
গ্রেজিয়ার সিএনএনকে বলেন, "বাণিজ্যে বাধা দিলে ধীরে ধীরে চীনা অর্থনীতির পতনের ঝুঁকি রয়েছে। চীন তাদের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য খাদ্য এবং জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভর করে, এবং তাদের এই নির্ভরশীলতা পরিবর্তনের খুব কম সুযোগ আছে।"
"আমার ধারণা অনুযায়ী, চীনারা সামরিক সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য যা যা করা যায়, তার সবকিছু করবে," গ্রেজিয়ার জানান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের জন্য তারা সামরিক শক্তির পরিবর্তে শিল্প ও অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করবে বলেই মনে করেন তিনি।
তবে পেন্টাগনের শীর্ষ কর্মকর্তারা চীনকে আমেরিকার জন্য "ক্রমবর্ধমান হুমকি" হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং গত বছর মার্কিন কংগ্রেসের 'চায়না মিলিটারি পাওয়ার রিপোর্টে' বলা হয়েছে "পিএলএ (চীনের গণফৌজ বা সামরিক বাহিনী) তাইওয়ান প্রণালী এবং এর আশেপাশে উস্কানিমূলক ও অস্থিতিশীল কর্মকাণ্ড বাড়িয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে তাইওয়ানের দাবিকৃত বিমান প্রতিরক্ষা অঞ্চলে চীনা যুদ্ধবিমানের অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি এবং তাইওয়ানের দূরবর্তী দ্বীপগুলোর একটিকে কেন্দ্র করে মহড়া চালানো।"
গেল বছরের আগস্টে তাইওয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের তৎকালীন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সফর চীনের সামরিক বাহিনীকে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের প্ররোচনা দেয়। এসময় তাইওয়ানের ওপর দিয়ে জাপানের জলসীমায় ক্ষেপণাস্ত্রও নিক্ষেপ করে তারা।
সামরিক চাপ বাড়াচ্ছে চীন
পেলোসির সফরের পর থেকেি বেইজিং তাইওয়ানের ওপর আক্রমণাত্মক সামরিক চাপ তৈরির কৌশল বাড়িয়েছে: তাইওয়ান প্রণালীতে ফাইটার জেট পাঠিয়েছে।
এছাড়াও অক্টোবরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বিশতম কংগ্রেসে তাইওয়ান সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে চীনা নেতা শি জিনপিং ব্যাপক সাধুবাদ পান। এসময় তিনি বলেন, চীন 'শান্তিপূর্ণ পুনঃএকত্রীকরণের জন্য প্রচেষ্টা চালাবে'।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্ট অনুযায়ী, দ্বীপটির পক্ষে সমর্থন জানাতে অটল রয়েছে। তারা জানিয়েছে যে, ওয়াশিংটন এই প্রতিরক্ষায় মার্কিন সেনা না পাঠিয়ে দ্বীপটিকে আত্মরক্ষা করার সরঞ্জাম সরবরাহ করবে।
সম্প্রতি স্বাক্ষরিত ন্যাশনাল ডিফেন্স অথরাইজেশন অ্যাক্ট এর আওতায় তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীকে আধুনিকীকরণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় যুক্তরাষ্ট্র এবং পাঁচ বছরে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিরাপত্তা সহায়তা প্রদান করে, যা দ্বীপটির জন্য দীর্ঘমেয়াদী দ্বিপাক্ষিক সমর্থনের একটি শক্তিশালী লক্ষণ।
বাইডেন অবশ্য একাধিকবার বলেছেন যে, চীনা সামরিক বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে মার্কিন সামরিক সদস্যরা তাইওয়ানকে রক্ষা করবে। তবে পেন্টাগন এটাও জোর দিয়ে বলেছে যে, ওয়াশিংটনের 'এক চীন' নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
'এক চীন' নীতির অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের অবস্থান স্বীকার করে যে তাইওয়ান চীনের অংশ। কিন্তু স্ব-শাসিত দ্বীপটির ওপর বেইজিংয়ের দাবিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি।
সিএসআইএস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, চীন যেন শেষপর্যন্ত তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে সেজন্য সিমুলেশনে মার্কিন সামরিক বাহিনী যা যা করেছে, আর মধ্যে চারটি জিনিস সবসময় উপস্থিত ছিল:
সে অনুসারে, তাইওয়ানের স্থল বাহিনীকে অবশ্যই চীনা স্থলবাহিনীকে থামাতে সক্ষম হবে; যুদ্ধ অভিযানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই জাপানে তাদের ঘাঁটি ব্যবহার করতে হবে; পিএলএ-র নৌবাহিনীকে দূর থেকে আঘাত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই দূরপাল্লার জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র থাকতে হবে; এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের অভিযান শুরুর আগেই তাইওয়ানকে চীনের সামরিক অভিযান ঠেকানোর জন্য প্রস্তুত করতে হবে এবং একইসাথে অবিলম্বে যেকোনো সংঘর্ষে তাদের বাহিনীকে ব্যবহার করতে হবে।
তাইওয়ানের জন্য 'ইউক্রেন মডেল' নয়
সিএসআইএস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, "তাইওয়ানের জন্য কোনো 'ইউক্রেন মডেল' নেই।" যেখানে উল্লেখ করা হয় কীভাবে রুশদের বিরুদ্ধে সরাসরি ন্যাটো জোট বা নিজেদের সেনা না পাঠিয়েই যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য দিয়ে যুদ্ধ চালাচ্ছে।
"একবার যুদ্ধ শুরু হলে, তাইওয়ানে কোনো সেনা বা সরঞ্জাম পাঠানো অসম্ভব, তাই তাইওয়ানের অবস্থা ইউক্রেন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাইওয়ানিজরা যুদ্ধে নামলে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যে অস্ত্র এবং সেনা ছিল- তা দিয়েই লড়তে হবে। নতুন কিছু যুক্ত হবে না," বলে জানান ক্যানসিয়ান।
সিএসআইএস জানায়, তাইওয়ান সংঘাতে সাফল্যের জন্য তাদের সুপারিশ অনুযায়ী ওয়াশিংটনকে শীঘ্রই কাজ শুরু করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে: চীনা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিরুদ্ধে জাপান এবং গুয়ামে মার্কিন ঘাঁটি শক্তিশালী করা; তাদের নৌবাহিনীতে ছোট আকারের কিন্তু টিকে থাকতে সক্ষম আরো বেশি জাহাজ অন্তর্ভুক্ত করা; সাবমেরিনকে অগ্রাধিকার দেওয়া; ফাইটার জেটের চেয়ে টেকসই বোমারু বিমান বহরকে অগ্রাধিকার দেওয়া; সস্তা যুদ্ধবিমান উৎপাদন; এবং একইসাথে তাইওয়ানকেও একটি অনুরূপ কৌশলের দিকে নিয়ে যাওয়া।
এই নীতি প্রবর্তন করলে মার্কিন সেনাবাহিনীর কম ব্যয় করেও জিতবে। সিএসআইএস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি একটি রক্তক্ষয়ী বিজয় হবে, জয়ী হলেও 'পরাজিত' চীনাদের চেয়ে তাদের ক্ষতির মাত্রা বেশি হবে। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়।"