দেরিতে হাসপাতালে নেওয়ায় শীতকালীন রোগে মৃত্যু বাড়ছে
শীতের তীব্রতা বাড়ায় নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত অসুখ সহ শীতকালীন বিভিন্ন রোগ বাড়ছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে শীতকালীন রোগে আক্রান্তের হার অনেক বেশি।
২৪ ঘণ্টায় দেশে শীতকালীন রোগ অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশনস (এআরআই) এবং ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩,১৫৬ জন ও মারা গেছে চারজন।
রোগে আক্রান্ত হয়েও দেরিতে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে শীতকালীন রোগের তীব্রতা বাড়ছে ও মৃত্যু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
শিশু হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "আমাদের হাসপাতালে ঢাকার বাইরে থেকে যেসব রোগী আসছে তারা একেবারে সিভিয়ার অবস্থায় আসছে। অভিভাবকদের অবহেলার কারণে ঢাকার অনেক রোগীও সিভিয়ার হয়ে হাসপাতালে আসছে। ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে।"
''এছাড়া অন্য রোগ আছে যাদের, সেসব রোগীর নিউমোনিয়া বা শীতকালীন অন্যান্য রোগ হলেও মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। গত রোববার আমাদের হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এক শিশু রোগী মারা গেছে যার কিডনির সমস্যা ছিলো। তাই অন্যান্য রোগ যাদের আছে তাদের শীতকালীন রোগগুলো যাতে না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে", বলেন তিনি।
উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে শিশুদের নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার বাড়ছে বলে জানিয়েছে চিকিৎসকেরা। প্রতিদিন নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া নিয়ে ৬০-৭০টি শিশু হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
তবে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীরা সিভিয়ার অবস্থায় ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাহান নেওয়াজ। তিনি বলেন, "দুই বছরের কম বয়সী শিশুরা নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে বেশি আসছে। তবে সমস্যা হলো একেবারে সিভিয়ার অবস্থা রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসছে। এতে করে রোগীর সুস্থ হতে সময় লাগছে ও মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ছে। শিশুদের সুস্থ রাখতে গরম কাপড় পরিয়ে রাখা, ঠান্ডা না লাগানোর পরামর্শ দেন এ চিকিৎসক।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় মাসে ৩.২৪ লাখ মানুষ ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, প্রাণহানি ঘটেছে ৭৩ জনের।
বাতাসের আর্দ্রতা কম এবং ধূলিকণা বেড়ে যাওয়ায় শীত এলেই ফ্লু, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস এবং ডায়রিয়ার মতো রোগগুলোর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে কথা হয় ৮ মাস বয়সী শাফিতের বাবা-মায়ের সঙ্গে। তারা জানান, "দুইদিন আগে বাচ্চার ডায়রিয়া নিয়ে মহাখালী আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। ডায়রিয়া ভালো হয়েছে কিন্তু রবিবার রাত থেকে জ্বর। সকালে ১০৪ ডিগ্রী জ্বর ছিল এবং শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল। একটা সাপোজিটরি দিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে আসে এই হাসপাতালে। ডাক্তার দেখেছে, টেস্ট দিয়েছে, এখনো টেস্টের রিপোর্ট আসেনি।"
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে প্রতিদিন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গড়ে ২০টি শিশু ভর্তি হচ্ছে। এছাড়া ডায়রিয়া, অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। শিশু হাসপাতালের মতো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ১০টি শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হচ্ছে।
শীতে নিউমোনিয়ার পাশাপাশি 'কোল্ড ডায়রিয়া' বেড়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) হাসপাতালে প্রতিদিন ডায়রিয়া নিয়ে ৩৫০ রোগী ভর্তি হচ্ছে। তার মধ্যে ৬০%-৭০% শিশু রোগী, যাদের বেশিরভাগের বয়স পাঁচ বছরের নিচে।
আইসিডিডিআর,বির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ বছরের নিচে প্রায় ২৪,৩০০ জন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। সে হিসাবে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়ায় প্রতিদিন মারা যায় ৬৭ জন। এদের ৫২ শতাংশ শিশু কোনো চিকিৎসা না পেয়ে বাড়িতেই মারা যায়।
যে লক্ষণগুলোকে অবহেলা নয়
ডা. কামরুজ্জামান বলেন, ২ মাসের কম বয়সী শিশুদের শ্বাস নেওয়ার হার মিনিটে ৬০ বারের বেশি, ২ মাস থেকে ১২ মাস বয়সী শিশুদের মিনিটে ৫০ বারের বেশি এবং ১২ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু মিনিটে ৪০ বারের বেশি শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে তাকে শ্বাসকষ্ট বলা হয়। এর সঙ্গে শিশুর বুকের পাঁজরের নিচের অংশ দেবে গেলে, জ্বর থাকলে, শ্বাস নেয়ার সময় কোন শব্দ হলে, বমি হলে তা নিউমোনিয়ার লক্ষণ। এসব লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।
এখন কোল্ড ডায়রিয়া বেড়েছে তাই ডায়রিয়া হলে শিশুকে স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শিশুকে সুস্থ রাখতে শীতের কাপড় পরাতে হবে, মাথা ঢেকে রাখতে হবে, শিশুর মাথায় ঠান্ডা লাগানো যাবে না, বাসার বাইরে-মার্কেটে অহেতুক বাচ্চাদের নিয়ে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। ৬ মাসের কম বয়সী শিশুদের ঘন ঘন ব্রেস্টফিড করতে হবে। এর বেশি বয়সীদের ব্রেস্টফিডিংয়ের পাশাপাশি মৌসুমি সবজি, ফল খাওয়াতে হবে। শিশুর নাক পরিষ্কার রাখতে হবে সব সময়। ঠান্ডা, কাশি হলেই ফার্মেসি থেকে শিশুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো যাবে না।