পাঁচ রাত হাঁটার পর যেভাবে দেখা মিলল বিরল বনরুইয়ের
নিশাচর প্রাণীদের প্রতি দুর্বলতা আমার সেই ছোটবেলা থেকেই। পৃথিবী যখন নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন এরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। রাতের আঁধারেই শিকার, আহার ও প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সারে।
নিশাচর প্রাণীরা দিনের আলোতে গাছের কোটরে, মাটির গর্তে বা সুবিধাজনক স্থানে নিজেকে লুকিয়ে বিশ্রাম করে অথবা ঘুমিয়ে থাকে। কেমন একটা রহস্যের চাদরে মোড়ানো এদের জীবন। তাই এদের সম্পর্কে জানার জন্য আমার কৌতূহল বরাবরই অনেক বেশি। নিশাচর প্রাণী দেখার টানে ছোট্ট এ জীবনের অনেকটা সময় এদের পেছনে ছুটেছি। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি বনে-জঙ্গলে।
বেশ কয়েক বছর আগের এক বর্ষা। নিশাচর প্রাণীর জীবযাপন দেখার, এদের সম্পর্কে আরও জানার এবং ছবি তোলার লোভে আমি ও আমার বন্ধু হনুমান গবেষক খাজা জহুরুল ইসলাম বন অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে সিলেট বিভাগের একটি বনে সপ্তাহব্যাপী অবস্থান নিলাম। আমাদের ইচ্ছে, দিনে ঘুমাব, আর সারা রাত বনে ঘুরে ঘুরে দুর্লভ নিশাচর প্রাণী খুঁজে বেড়াব।
দুর্লভ প্রাণীর দেখা পাওয়ার নেশায় টানা পাঁচ রাত কাটিয়ে দিলাম অরণ্যে। কিন্তু মাইলের পর মাইল হেঁটেও বুনো শুকর, মায়া হরিণ, গন্ধগোকুল ও সুলভ প্রজাতির সাপ ছাড়া আর কিছুর দেখা মিলছিল না। একে তো বর্ষাকাল থাকায় প্রতি রাতে বৃষ্টিতে ভিজে কাকভেজা হচ্ছি, এর ওপর আবার শত শত জোঁকের কামড় বোনাস হিসেবে তো আছেই।
পাঁচ রাত ঘুরেও তেমন কিছু না পেয়ে আমরা অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। তাই ষষ্ঠ রাতে আমরা নতুন পরিকল্পনা করলাম। স্থির করলাম, ট্রেইল ধরে না হেঁটে ছড়া (বনে প্রবহমান ঝিরি) ধরে হাঁটব।
নতুন পথে শুরু হলো হাঁটা। ঘণ্টা চারেক হাঁটলাম একটানা। তারপর হঠাৎ দূর থেকে টর্চের আলোয় লক্ষ করলাম ছড়ার ঠিক পাশেই একটা প্রাণী দ্রুতপায়ে পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমাদের দেখে প্রাণীটা শশব্যস্ত হয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ওইদিকে জায়গাটা একেবারে খাড়া ও উঁচু টিলার মতো। সে কারণে প্রাণীটি তা বেয়ে ওপরে উঠতে পারছে না। আমরা একদৌড়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কাছে যাওয়ার পর যা দেখলাম, তাতে তো আমাদের চোখ ছানাবড়া!
এমন দৃশ্য দেখার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কারণ ওই প্রাণীটা ছিল বাংলাদেশের অন্যতম বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণী বনরুই। যার ইংরেজি নাম Chinese Pangolin ও বৈজ্ঞানিক নাম Manis pentadactyla Linnaeus, 1758.
আমরা খুব কাছে চলে যাওয়ায় পালাবার পথ না পেয়ে আত্মরক্ষার জন্য প্রাণীটা কুণ্ডলী পাকিয়ে বলের মতো গোল হয়ে গেল। বিপদের আভাস পেলেই এরা নিজের শরীর গুটিয়ে নেয়। এ কারণে মালয় ভাষায় এদের 'পেঙ্গুলিং' নামে ডাকা হয়, এখান থেকেই এদের ইংরেজি 'প্যাঙ্গোলিন' নামটি এসেছে।
বনরুই ফলিওডোটা বর্গের প্রাণী। ফলিওডোটা অর্থ আঁশযুক্ত। দন্তহীন এই প্রাণীটি স্তন্যপায়ী। দাঁত না থাকায় একটা সময় এদের এডেনস্টা বর্গের প্রাণী মনে করা হতো। এই প্রাণীটির শরীরে রুই মাছের মতো আঁশ রয়েছে বলে একে বনরুই বলা হয়ে থাকতে পারে। এদের শরীর ও লেজ কালচে ছাই রঙের।
বিশ্বে বনরুইয়ের সাতটি প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে চার প্রজাতির বাস আফ্রিকায় ও তিন প্রজাতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দেখা যায়। যদিও সারা পৃথিবীতেই এদের অবস্থা খুবই নাজুক। প্রতিদিনই এদের সংখ্যা মারাত্মক হারে হ্রাস পাচ্ছে।
বনরুই-ই পৃথিবীর সর্বাধিক পাচারকৃত স্তন্যপায়ী প্রাণী। মূলত আঁশের জন্য এদের শিকার করা হয়। চীনে এদের চাহিদা বেশি। চীনারা এদের মাংস খেয়ে থাকে যৌনশক্তি বৃদ্ধির ওষুধ হিসেবে। তাদের বিশ্বাস, বনরুইয়ের মাংস খেলে যৌনশক্তি বাড়ে, যদিও এ বিশ্বাসের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। একটা কুসংস্কারের কারণে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে অপরূপ সুন্দর এই প্রাণীটি।
বনরুইয়ের শরীর ১৭-১৮টি সারিতে আঁশে ঢাকা থাকে। প্রতিটি আঁশের নিচে ৩-৪টি লোম থাকে। শুধু গলায়, পেটের নিচে ও মুখের সামনের অংশে আঁশ থাকে না। এদের সামনের পায়ের নখ অনেক লম্বা, জিভ ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।
উইপোকা ও পিঁপড়ার ঢিবিতে নখ দিয়ে গর্ত করে লম্বা জিভ দিয়ে এদের চেটে চেটে খায় বনরুই। এছাড়া ছোট ছোট পোকামাকড়ও খায়।
বনরুই পুরোপুরি নিশাচর ও গর্তবাসী। রাতে খাবারের সন্ধানে বের হয়, দিনে গর্তে বিশ্রাম করে। স্ত্রী ও পুরুষ বনরুই জোড়া বাঁধার পর একই গর্তে বাস করে।
স্ত্রী বনরুই বছরে ২-১টি বাচ্চার জন্ম দেয়। বাচ্চা বড় না হওয়া পর্যন্ত মায়ের লেজে বসেই চলাফেরা করে। এদের চওড়া লেজ দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে এরা এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল, সিলেট বিভাগীয় বনাঞ্চল ও ময়মনসিংহ, শেরপুরের গারো পাহাড়সংলগ্ন বনাঞ্চলগুলোতে টিকে থাকতে পারে।
- আদনান আজাদ: বন্যপ্রাণী গবেষক ও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার