যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র আইন: মানুষ মরলেও কেন কমছে না মার্কিনীদের বন্দুকপ্রীতি?
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক ঘটে যাওয়া গোলাগুলির ঘটনায় মার্কিন মুল্লুকজুড়ে 'আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন' জোরদার করার দাবি আবারও জোরাল হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে পার্লামেন্টে সবসময়ই ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে রয়েছে মতের ভিন্নতা। বন্দুকধারীর গুলিতে কিছুদিন পরপর মানুষ মরলেও বন্দুক আইন নিয়ে দুই রাজনৈতিক দলের মতামত মিলছে না এবারও। কংগ্রেস, সিনেট, সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রায়শই দুই দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক দেখা যায়। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে থাকা শক্তি (ডেমোক্রেট) ক্ষমতায় থাকার পরেও কেনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারছে না এই অত্যাবশ্যকীয় আইন জোরদার করতে? এ এক বড় প্রশ্ন। পুরো বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝতে হলে আগে জানতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস, সংবিধান, বর্তমান রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রেও বিভিন্ন সময়ে জনসাধারণের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নিয়ম ছিল এবং আছে। অনেক দেশে, বিশেষ করে জাপানে অস্ত্র কেনার জন্য কয়েক ধাপে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়; সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ বছর হলেই অনায়েশে অস্ত্র কিনতে পারেন যেকোনো নাগরিক। আবার অনেক দেশই দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন সহিংসতার ঘটনার পর, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে, অনেক ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার পুরোপুরিই বাতিল করে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী কানাডার নোভা স্কটিয়া এলাকায় ২০২০ সালের এপ্রিলে বন্দুকধারীর হামলায় ২৩ জন নিহত হয়। এর কয়েক দিন পরই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন করে ১ হাজার ৫০০ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র নিষিদ্ধ করে দেশটির সরকার। বর্তমানে কানাডার সরকার আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার পুরোপুরি বাতিলের চেষ্টা করছে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে ২০১৯ সালের বন্দুকধারীর গণ হামলার পর সেদেশের সরকারও প্রায় সব আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং আক্রমণাত্মক অস্ত্রসহ সামরিক পর্যায়ের অস্ত্র নিষিদ্ধ করেছে। এদিকে, কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে রব এলিমেন্টারি স্কুলে বন্দুকধারীর হামলার ঘটনার পর নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্র প্রধান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অস্ত্র আইন কঠোর করার অনুরোধ জানান। কিন্তু তাতেও তেমন উল্লেখযোগ্য ফল মেলেনি। ওই হামলার ঘটনার পরেও আরও বেশ কয়েকটি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে গেছে দেশটিতে। সবচেয়ে সাম্প্রতিক হামলার ঘটনাটি ঘটেছে স্থানীয় সময় গেল শনিবার (২১ জানুয়ারি)। এতে লস অ্যাঞ্জেলেসের পার্শ্ববর্তী শহরে জনৈক বন্দুকধারীর গুলিতে কমপক্ষে ১০ জন নিহত হয়েছেন বলে খবর গণমাধ্যমের।
তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্দুক হামলার ভয়াবহ পরিসংখ্যান ও প্রতিবেশীদের অনুরোধ সত্ত্বেও অস্ত্র আইনে তেমন পরিবর্তন আনতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৯ সালে বন্দুকধারীর দ্বারা বড় ধরনের গণ হামলার সংখ্যা ৪১৭টি, যা ২০২০ সালে বেড়ে এক ধাপে ৬১০-এ গিয়ে দাঁড়ায়। ২০২১ সালে সংখ্যাটি আবার এক ধাপে বেড়ে ৬৯২ তে ঠেকে। আর ২০২২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪৮ এ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে মাত্র শুরু হওয়া নতুন বছরে এই সংখ্যা বিগত বছরের মত কিংবা তারচেয়েও বেশি হতে পারে।
২০২১ যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন ৭০৫ জন, যদিও এই সংখ্যা গেল ২০২২ সালে কিছুটা কমে ৬৭২ এ এসে ঠেকে। এছাড়া বন্দুকের মাধ্যমে এলোপাথাড়ি হামলা ছাড়াও আত্মহত্যাসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ডও বেড়ছে দেশটিতে। যেমন- গেল বছর জুনে খেলার সময় অসাবধানতাবশত শিশু সন্তানের হাতে বাবা গুলিবিদ্ধ হন। এমন বিভিন্ন ঘটনায় প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। বন্দুকের ব্যাক্তিগত মালিকানার সুবিধা থাকায় প্রধান ১০টি দেশের মধ্যে হতাহতের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রে। তাই বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হত্যা এবং মৃত্যুর হার অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েই চলেছে।
তো যাইহোক, এত নেতিবাচক দিক থাকার পরেও মার্কিনীদের কেনো এই বন্দুক প্রীতি? এর পেছনে মূল কারণ হল- তাদের সাংবিধানিক অধিকার, রাজনৈতিক ইতিহাস এবং বিশেষ করে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২য় সংশোধনীর মাধ্যমে যোগ্য নাগরিকদের জন্য সাংবিধানিকভাবে বন্দুকের ব্যাক্তিগত মালিকাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়। ২য় সংশোধনীর মূল বক্তব্য ছিল- "যেহেতু একটি মুক্ত প্রদেশের নিরাপত্তার জন্য, একটি সুনিয়ন্ত্রিত মিলিশিয়া প্রয়োজন; তাই জনগণের অস্ত্র রাখার এবং বহন করার অধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না।"
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়ার ১৭৮৭ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৭৮৯ সালে। এই সময়ে (১৭৮৭-৮৮ সাল) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতা কর্তাদের মাঝে ১০টি সংশোধনী নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক চলেছিল যা 'বিল অফ রাইটস' নামে পরিচিত। এই সংশোধনীগুলোর একটিই হল ১৭৯১ সালে অনুমোদন পাওয়া আলোচিত ২য় সংশোধনী। মূলত কখনও স্বৈরাচারী কেন্দ্রীয় সরকারের আবির্ভাব হলে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা রক্ষা করা এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে প্রাদেশিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য। ১৮৮১ থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত চলা গৃহযুদ্ধ এর প্রয়োজনীয়তাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তবে, সম্প্রতি এ ধরনের মিলিশিয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে। ১৯৬০ এর দশকে দলগত সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় এবং প্রেসিডেন্ট কেনেডির হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভন্ন সরকারের আমলে এতে পরিবর্তন আসতে থাকে। কিন্তু ২০০৮ সালে আইনগতভাবে ব্যক্তিগত মালিকানার অংশটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে; এর আগে পর্যন্ত প্রদেশিক মিলিশিয়ার অংশটিকে মূল অংশ হিসেবেই ধরা হত। এখানে জোর দেওয়া হয় যে, অস্ত্রের ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং আত্মরক্ষায় কাজ করবে।
সাংবিধানিক এবং ঐতিহাসিক পটভূমি থাকায় মার্কিনীদের কাছে এই অধিকার মৌলিক অধিকারের সমতুল্য। এর পরিবর্তন তাদের কাছে সংবিধানকে অসম্মান করার মত একটি ব্যাপার। অন্যদিকে, দেশটিতে ক্রমেই বেড়ে চলেছে ছিনতাই, ডাকাতি, দলগত সহিংসতাসহ নানান ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এতে জনগণের মাঝে তৈরি হয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। আর তাদের এই নিরাপত্তাহীনতাকে পুঁজি করেই একদল মুনাফা লোভী অস্ত্র ব্যবসায়ী কিছু রাজনীতিবিদদের মদদে আজকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণকে সমর্থনকারী এবং অস্ত্র অধিকার সমর্থনকারী দুটি পরস্পরবিরোধী দল রয়েছে। অস্ত্র অধিকার সমর্থনকারী রাজনীতিবিদরা পার্লামেন্টে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে যেনো কোনো আইন পাশ না হয়, তা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত। আর এসব রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায় আসতে এবং জনসমর্থন অর্জনে আর্থিক সাহায্য দেয় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। এই প্রক্রিয়াটি 'গান বা অস্ত্র লবিং' নামে পরিচিত। অস্ত্র ব্যবসার মুনাফার অনেক বড় একটি অংশ সরাসরি এই খাতেই ব্যবহার হয়। ১৯৯৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত, বন্দুকপন্থী গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র আইনকে সরাসরি প্রভাবিত করতে লবিংয়ের পিছনে প্রায় ১৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ) শুধু ২০২০ সালেই অস্ত্র অধিকার রক্ষা খাতে ব্যয় করছে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৮ সালের আইন পরিবর্তনেও ছিল তাদের ইন্ধন। যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যবসায়ীরাই বিশ্বের সবেচেয়ে বড় অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক। মূলত ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ অস্ত্র বাজার টিকিয়ে রাখাই তাদের উদ্দেশ্য। অস্ত্র অধিকার সমর্থনকারী রিপাবলিকান রাজনীতিবিদরা ছোট থেকে ছোট অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনেরও বিরোধিতা করে, যার ফলে জনগণের পর্যাপ্ত সমর্থন থাকার পরেও কোনো আইন পাশ হয় না।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় বন্দুক হামলার ঘটনা পুরো দেশকে আবারও সরব করে তুলেছে। গেল ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাচ্চাদের বিভিন্ন স্কুলে এমন ঘটনা ঘটেছে ২৬টিরও বেশি। গতবছরের রব স্কুলের হামলার পর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সমর্থনকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরগুলোতে আন্দোলন শুরু করেছিল। তবে সেই আন্দোলন কোনো কাজে লাগেনি। প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ অন্যান্য ডেমোক্রেটরা উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে তাদের এই অপারগতাকে 'বিব্রতকর' জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিল। অন্যদিকে, কিছু রিপাব্লিকান নেতা স্কুলের দরজার সংখ্যা কমানো, শিক্ষকদেরকে সশস্ত্র করার মত কিছু বিতর্কিত পরামর্শ দিয়ে তোপের মুখে পড়েছিলেন। এতে সে সময়ের আন্দোলন আরও বৃদ্ধি পায়েছিল।
বিনোদন ও খেলার জগতের অনেক তারকাদের জোরাল সমর্থনে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জনসমর্থন আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে কংগ্রেসে তখন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের একটি প্রস্তাব পাশ হয়। কিন্তু দুই দলের সামান অবস্থান থাকা সিনেটে সেই প্রস্তাবের সম্পূর্ণ অংশ ধোপে টেকেনি। অবশেষে, ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও পরিস্থিতির জটিলতার প্রেক্ষাপটে মার্কিন সিনেটে উভয় দলের সদস্যদের একটি অংশের মধ্যে সমঝোতা হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেন, ২১ বছরের কম বয়সী অস্ত্র ক্রেতাদের ক্ষেত্রে কঠোর যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় সিনেটরদের সমর্থন থাকবে। অবৈধ অস্ত্র ক্রয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়েও সিনেটরদের সমর্থন থাকবে। যদিও প্রেসিডেন্ট বাইডেন, ডেমোক্রেট রাজনীতিবিদরা এবং অনেক আন্দলোনকারীর মতে এই পদক্ষেপ পরিস্থিতি অনুযায়ী যথেষ্ট নয়। তবে, পরিবর্তনের পথে যাত্রা শুরু হওয়ায় তারা আশা প্রকাশ করেছিলেন, ভবিষ্যতে আরও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কারণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখার জন্য এই পরিবর্তন এখন অত্যাবশ্যকীয়। যদিও এখনও কিছুদিন পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের আনাচে-কানাচে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক