ভারতবর্ষে জন্ম কিংবা বেড়ে ওঠা বিখ্যাত সব পশ্চিমা তারকা
ভারতবর্ষের সাথে পশ্চিমা দেশ কিংবা মানুষের যোগাযোগ বহুদিনের। একদিকে দীর্ঘ সময় ভারত ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে; অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে নানা কারণে পৃথিবীর এ দুই প্রান্তের মানুষের মাঝে ছিল ক্রমাগত যোগাযোগ।
যার ফলে একদিকে যেমন ভারতবর্ষের অনেকে পশ্চিমা দেশে জন্মেছেন, তেমনি পশ্চিমা বেশ কয়েকজন বিখ্যাত তারকার জন্ম কিংবা বেড়ে ওঠার সাথেও রয়েছে ভারতবর্ষের নিবিড় সম্পর্ক। এমনই কিছু তারকার তথ্য পাওয়া গেল সংবাদমাধ্যম এমএসএন-এ।
ভিভিয়েন লেই (১৯১৩ - ১৯৬৭)
হলিউডের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অভিনেত্রীদের একজন ভিভিয়েন লেই, জন্ম ১৯১৩ সালের ৫ নভেম্বর অবিভক্ত ভারতের দার্জিলিংয়ে। পিতৃসূত্রে ভিভিয়ানের পিতা একজন ব্রিটিশ এবং মা একজন আইরিশ-পারসিক। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে তার শৈশব কাটলেও পরে এ অভিনেত্রী চলে আসেন লন্ডনে। ছোটবেলা থেকেই মঞ্চে অভিনয় করতেন তিনি।
১৯৩৫ সালে 'দ্য মাস্ক অফ ভার্চু' নাটকে অভিনয় করে সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে করে গেছেন একের পর এক বিখ্যাত সিনেমা।
ক্লিওপেট্রা চরিত্রে, 'গন উইথ দ্য উইন্ড' ও 'আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার' সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি দর্শকদের মনে জায়গা করে নেন।
ভিভিয়েন দুইবার সেরা অভিনেত্রী হিসেবে পেয়েছেন বিখ্যাত একাডেমী অ্যাওয়ার্ড। ১৯৬৭ সালের ৮ জুলাই মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই অভিনেত্রী।
ক্লিফ রিচার্ড (১৯৪০ - বর্তমান)
রক সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ক্লিফ রিচার্ডের জন্ম ১৯৪০ সালে, ভারতের লক্ষ্ণৌ শহরে। শৈশবে ভারতে থাকাকালীন ক্লিফ পরিচিত ছিলেন 'হ্যারি রজার ওয়েব' নামে। পরবর্তীতে ১৯৫০ এর দশকে ব্রিটেনে ফিরে গেলে তার নাম পরিবর্তন করে ক্লিফ রিচার্ড রাখা হয়।
২০১০ সালে ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিজের সংগীত ক্যারিয়ারে ২৫০ মিলিয়নেরও বেশি রেকর্ড বিক্রি করেছেন স্যার রিচার্ড। 'মুভ ইট', 'লিভিং ডল', 'দ্য ইয়াং ওয়ান্স', 'সামার হলিডে', 'কনগ্রাচুলেশন্স', 'ডেভিল ওম্যান', 'উই ডোন্ট টক এনিমোর' অথবা 'সেভিয়ার্স ডে'র মত হিট গানের কারণে ১৯৯৫ সালে তিনি 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত হন।
এছাড়াও নিজের অনবদ্য উপস্থাপনার জন্য এ গায়ক 'পিটার প্যান' নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ব্রিটেন তো বটেই, পুরো বিশ্বজুড়েই রয়েছে রিচার্ডের অসখ্য গুণমুগ্ধ ভক্ত৷
জর্জ অরওয়েল (১৯০৩ – ১৯৫০)
১৯০৩ সালের ২৫ জুন ব্রিটিশ ভারতের বিহার রাজ্যের মথিহারিতে জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েল। অরওয়েলের আসল নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার। সাহিত্য জগতে তিনি অরওয়েল নামেই বেশি পরিচিত।
তার সাহিত্যকর্মের মূল অবদান ছিল রাজনৈতিক বিদ্রোহ ও সোচ্চার কণ্ঠস্বর। স্বৈরাচার ও একদলীয় শাসন মতবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখির মাধ্যমে তিনি করেছেন আপোষহীন সংগ্রাম।
'নাইনটিন এইটি ফোর' অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। এ বইটিতে লেখক সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি, যুদ্ধ ও শান্তির প্রেক্ষাপট ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। ২০০৪ সালে 'দি গার্ডিয়ান' এর জরিপে উপন্যাসটি বিশ্বের চিরায়ত গ্রন্থের তালিকায় উঠে আসে সবার উপরে।
'দি রোড টু উইগ্যান পাইয়ার', 'হোমেজ টু ক্যাটালোনিয়া' কিংবা 'এনিমাল ফার্ম' এর মতো কালজয়ী উপন্যাসের এ লেখক ১৯৫০ সালের ২১ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
রুডইয়ার্ড কিপলিং (১৮৬৫ – ১৯৩৬)
রুডইয়ার্ড কিপলিং ১৮৬৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভারতবর্ষের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। খ্যাতিমান এ লেখক জীবনের শুরুর দিকের কিছু সময় ভারতে কাটান। পরবর্তী জীবনে স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে কিপলিং ভারতকে 'অনেকটা স্বর্গ'-এর মতো বলে অভিহিত করেছেন।
১৮৭১ সালে মাত্র ৬ বছর বয়সে স্বাস্থ্যগত সমস্যার চিকিৎসার জন্য কেপলিং এর পিতা-মাতা তাকে ব্রিটেনে পাঠিয়ে দেন।
তার বিখ্যাত কবিতা 'ইফ', জনপ্রিয় শিশুতোষ ক্লাসিক 'দ্য জাঙ্গল বুক', 'কিম' এবং শিশুতোষ কবিতা ও গল্পের সংকলন 'পাক অব পুক'স হিল' এর জন্য বিশ্ব সাহিত্যে জনপ্রিয় হয়ে আছেন।
১৯০৭ সালে কিপলিং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেও নাইট উপাধি এবং পোয়েট লরিয়েটশিপ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
তার আত্মজীবনী 'সামথিং অব মাইসেল্ফ ফর মাই ফ্রেন্ডস নোন অ্যান্ড আননোন' এ কিপলিং জানান, তার জীবনের প্রথম স্মৃতি হিসেবে ঊষা এবং আলো-আঁধারির কথা; কাঁধসমান উচ্চতায় থাকা সোনালি ও বেগুনি রঙের ফলের কথা। লেখকের শৈশবের এসব স্মৃতিচারণ মূলত ভারতে থাকাকালীন স্মৃতি থেকে অনুপ্রাণিত। এছাড়াও ভারতীয় গৃহপরিচারিকার কাছে বড় হওয়ায় তিনি প্রথমে হিন্দি ভাষাই শেখেন।
জুলি ক্রিস্টি (১৯৪০ - বর্তমান)
ব্রিটিশ অভিনেত্রী জুলি ফ্রান্সেস ক্রিস্টির জন্ম ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ ভারতের আসামের ছবুয়া অঞ্চলে। এ তারকা অভিনেত্রী ১৯৬৩ সালে 'বিলি লায়ার' সিনেমায় অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে 'ডার্লিং' সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে জুলি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেন। একইসাথে সিনেমায় অসাধারণ অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছেন।
পরবর্তীতে জুলি ফারেনহাইট ফোর হান্ড্রেড ফিফটি ওয়ান (১৯৬৬), ফার ফ্রম দ্য ম্যাডিং ক্রাউড (১৯৬৭), পেটুলিয়া (১৯৬৮), দ্য গো-বিটুইন (১৯৭১), ম্যাককেব অ্যান্ড মিসেস মিলার (১৯৭১), ডোন্ট লুক নাও (১৯৭৩) এর মত বিখ্যাত সব সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ সব চরিত্রে অভিনয় করেন।
২০০৪ সালে তিনি ঐতিহাসিক মহাকাব্যিক সিনেমা 'ট্রয়' এ অভিনয় করে দর্শকের মনে আজীবনের জন্য জায়গা করে নেন।
ফ্রেডি মার্কারি (১৯৪৬-১৯৯১)
জাঞ্জিবারের ফারোখ বুলসারাতে জন্ম জনপ্রিয় রক গায়ক ফ্রেডি মার্কারির। 'কুইন' ব্যান্ডের এ ভোকালিস্ট ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।
ফ্রেডির বাবা-মা দুজনই ছিলেন ভারতীয়। এমনকি তিনি তার শৈশবের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন বোম্বাইয়ের (বর্তমান মুম্বাই) নিকটে অবস্থিত পাঁচগনিতে।
১৯৬৪ সালে জাঞ্জিবারে ফিরে আসলেও, সালতানাতের বিরুদ্ধে সহিংস বিদ্রোহ থেকে বাঁচতে পরিবারের সাথে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান তিনি।
'বোহেমিয়ান র্যাপসডি', 'আই ওয়ান্ট টু ব্রেক ফ্রি', 'উই উইল রক ইউ', 'দ্য শো মাস্ট গো অন' এর মতো কালজয়ী গান উপহার দিয়ে গেছে ফ্রেডির ব্যান্ড কুইন।
মার্লে ওবেরন (১৯১১ - ১৯৭৯)
হলিউড তারকা মার্লে ওবেরন প্রকৃতপক্ষে একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। তার জন্ম ১৯১১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারতবর্ষের মুম্বাইতে।
১৯১৪ সালে ওবেরনের পিতা মারা যাওয়ার পর ১৯১৭ সালে তার পুরো পরিবার কলকাতায় চলে আসে।
১৯২০ সালে ক্যালকাটা অ্যামেচার থিয়েট্রিকাল সোসাইটি দিয়ে তার অভিনয় জীবনের শুরু। স্যার আলেকজান্ডার কর্ডার সিনেমা 'দ্য প্রাইভেট লাইফ অব হেনরি এইট' এ (১৯৩৩) অ্যান বোলেইনের চরিত্রের মাধ্যমে প্রথম বড় সুযোগটি পান ওবেরন।
যখন হলিউডে বেশি বেশি কাজ করতে শুরু করেন, তখন পাকাপাকিভাবে আমেরিকা চলে যান তিনি। কিন্তু হলিউডের বিখ্যাত এই তারকা নিজের ক্যারিয়ারের সুবাদে নিজের আসল জন্ম-পরিচয় সবসময় গোপন রেখেছেন। বরং জীবনভর নিজেকে অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়া জন্মগ্রহণ করা একজন শ্বেতাঙ্গ হিসেবে পরিচয় দিয়ে গেছেন।
কারেন ডেভিড (১৯৭৯ - বর্তমান)
কারেন শেনাজ ডেভিড একজন কানাডিয়ান-ব্রিটিশ অভিনেত্রী ও গায়ক। তবে এ তারকার জন্ম ভারতের শিলংয়ে, ১৯৭৯ সালের ১৫ এপ্রিল।
পরবর্তীতে কারেন কানাডায় বেড়ে ওঠেন এবং পড়াশোনার জন্য লন্ডনে স্থানান্তর হন।
তিনি মূলত বিবিসি ওয়ান টেলিভিশনের 'ওয়াটারলু রোড' সিরিজে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'দ্য স্করপিয়ন কিং ২: রাইজ অব আ ওয়ারিয়র' এবং ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'জ্যাক রায়ান: শ্যাডো রিক্রুট' এ অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি।
এছাড়াও বহুমুখী প্রতিবার অধিকারী এ অভিনেত্রী বর্তমানে 'ফিয়ার দ্য ওয়াকিং ডেড' নামের টেলিভিশন সিরিজে গ্রেস চরিত্রে অভিনয় করছেন।
উইলিয়াম ম্যাকপিস থ্যাকারি (১৮১১ - ১৮৬৩)
ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও চিত্রকর উইলিয়াম ম্যাকপিস থ্যাকারি ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় ১৮১১ সালের ১১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। ১৮১৬ সালে মাত্র ৫ বছর বয়সে থ্যাকারি ব্রিটেনে চলে যান এবং সেখানকার সাউদাম্পটন ও চিসউইকের বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ১৮২৮ সালে ট্রিনিটি কলেজ, ক্যামব্রিজে ভর্তি হন।
কিন্তু অধ্যয়নে মনোযোগ না থাকায় ১৮৩০ সালে কোন ডিগ্রি না নিয়েই তিনি ক্যামব্রিজ ত্যাগ করেন।
থ্যাকারি তার ব্যঙ্গধর্মী কাজ, বিশেষ করে ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত 'ভ্যানিটি ফেয়ার' এবং ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত 'দ্য লাক অব ব্যারি লিন্ডন' উপন্যাসের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
স্পাইক মিলিগান (১৯১৮ – ২০০২)
কৌতুক অভিনেতা ও লেখক স্পাইক মিলিগানের জন্ম ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ ভারতের আহমেদনগরে।
স্পাইক তার প্রজন্মের প্রভাবশালী ব্রিটিশ কৌতুক অভিনেতাদের মধ্যে একজন। তিনি পিটার সেলারস, হ্যারি সেকম্বি, মাইকেল বেনটাইনের সাথে নিয়ে 'দ্য গুন শো' নামের একটি কমেডিধর্মী রেডিও শো পরিচালনা করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
১৯৫১ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এ শো করার পর 'কিউ ৫' নামের শো দিয়ে তিনি টিভি পর্দায় আবির্ভূত হন। এছাড়াও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এ তারকার কবিতা ও নাটকের জগতেও পদচারনা রয়েছে।
জেরাল্ড ডুরেল (১৯২৫ - ১৯৯৫)
ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ, চিড়িয়াখানা রক্ষক ও লেখক জেরাল্ড ডুরেলের জন্ম ১৯২৫ সালের ৭ জানুয়ারি, ব্রিটিশ ভারতের জামশেদপুর অঞ্চলে। একজন প্রাণীপ্রেমী হিসাবে নিজের জীবনের উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি বই লেখার জন্য তাকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হয়।
১৯৫৬ সালে তিনি স্মৃতিকথামূলক উপন্যাস 'মাই ফ্যামিলি এন্ড আদার এনিমেলস' প্রকাশ করেন, যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়াও একইবছর তিনি 'ডুরেল ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন ট্রাস্ট' গঠন করেন।
ডুরেলের রচিত 'ম্যানেজারি ম্যানর' বইয়ে খুবই ভিন্ন আঙ্গিকে চিড়িয়াখানার একটি সাধারণ দিন এবং চিড়িয়াখানা শ্রমিকদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করা হয়েছে।