দুর্নীতির কামড়ে সবচেয়ে ধরাশায়ী ব্যবসা খাত: সিপিডি
রোববার প্রকাশিত এক জরিপে উঠে এসেছে, তারল্য সংকট ও ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতিকে ছাপিয়ে দুর্নীতি বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) পরিচালিত ওই যৌথ জরিপে দেখা গেছে, ৬৪.৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন দেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। কর প্রদান, লাইসেন্স নেওয়া ও সরকারি পরিষেবা পাওয়ার জন্য তাদের ঘুষ দিতে হয়।
২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত কৃষি, উৎপাদন ও সেবা খাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৭৪ জন পদস্থ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেয় সিপিডি। সেখানে তারা দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা-সক্ষমতার অবস্থা, ফ্যাক্টর ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নিজেদের মতামত দেন।
প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ সময় এ পরিস্থিতি হয় স্থবির ছিল, অথবা আগের তুলনায় আরও খারাপ হয়েছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জরিপের ফল উপস্থাপন করেন এবং সভাপতিত্ব করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
মোয়াজ্জেম বলেন, ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তা বলেছেন আমদানি-রপ্তানিতে ঘুষ কিছুটা সাধারণ ব্যাপার। ৬১ শতাংশ বলেছেন, সরকারি পরিষেবা নিতে ঘুষ দেওয়া সাধারণ ঘটনা এবং প্রায় ৫৯ শতাংশ বলেছেন কর প্রদানের ক্ষেত্রে ঘুষ দেওয়া সাধারণ ঘটনা।
তিনি বলেন, ব্যবসা করার ক্ষেত্রে দুর্নীতিই এখনও সবচেয়ে বড় বাধা হলেও, এর প্রভাব ধীরে ধীরে অন্যান্য কাঠামোগত ও নতুন উদ্ভূত ইস্যুতে ছড়িয়ে পড়ছে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, অন্যান্য মূল সমস্যার মধ্যে আছে—অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, ঋণপ্রাপ্তির অপর্যাপ্ততা ও অদক্ষ আমলাতন্ত্র। নতুন উদ্ভূত সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিতিশীলতা এবং অস্থায়ী নীতি। এসব নতুন কারণে ব্যবসা করার চ্যালেঞ্জ বহুগুণ বেড়েছে।
২০২২ সালে সরকারের অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি অপরাধ ও চুরি পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'অন্যান্য তুলনীয় দেশের তুলনায় ব্যবসা পরিচালনা ও সুশাসন-সংক্রান্ত প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।'
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'সারাবিশ্ব এখন একটি অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ। যার মধ্যে খাদ্য ও জ্বালানি সমস্যা, মুদ্রাস্ফীতি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং তার পাশাপাশি বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। যার ফলে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার দিয়ে যাচ্ছে।'
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে যে বৃহৎ অর্থনীতিগুলোসহ অনেক অর্থনীতি মন্দায় পড়বে। 'সারা বিশ্ব হিমশিম হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষও খাদ্য ও জ্বালানির চড়া দামের কারণে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ কারণে ব্যক্তি পর্যায়ে ও ব্যবসায়ীরা এক ধরনের চাপে রয়েছে।'
বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ ৩ ঝুঁকি
জরিপের ভিত্তিতে সিপিডি দেখেছে, আগামী দিনে বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ তিন ঝুঁকি হচ্ছে দ্রুত ও টেকসই মূল্যস্ফীতি, ঋণ সংকট এবং পণ্যের দামের তীব্র ধাক্কা বা অস্থিতিশীলতা।
অন্যদিকে,আগামী দিনে বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ তিনটি সামাজিক ঝুঁকি হলো: জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকট, কর্মসংস্থান ও জীবিকা সংকট।
অর্থ পাচার-সংক্রান্ত পদক্ষেপ অত্যন্ত অদক্ষ
জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৪৪.১ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন যে দেশ থেকে বিভিন্ন চ্যানেলে ব্যাপকভাবে অর্থ পাচার হয়।
এছাড়া ৪২ শতাংশ মনে করেন, অর্থনৈতিক কার্যক্রমের একটি বড় অংশ নথিবদ্ধ ও নিবন্ধিত হয় না।
যা করতে হবে
প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা ও দুর্বলতা বৃদ্ধি এবং এর ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোতে (এসএমই) সৃষ্ট নেতিবাচক প্রভাব কমানোর জন্য বড় সংস্কারের প্রয়োজন বলে জানিয়েছে সিপিডি। যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করে, সেগুলোর ক্ষেত্রে সংস্কার বিশেষভাবে প্রয়োজন বলে মনে করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
গত দশকে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিনিয়োগ পাওয়ার পরও ব্যবসায়ীদের এখনো দুর্বল অবকাঠামোগত সমস্যায় ভোগার বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে এ থিংকট্যাংক। এজন্য সিপিডির পরামর্শ হচ্ছে, অবকাঠামোগত দক্ষতার উন্নয়ন, কম দূষণ ও ট্রাফিকসহ নগর উন্নয়ন ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানির উন্নয়ন ইত্যাদি খাতে বেশি করে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
সংঘবদ্ধ অপরাধের কারণে সুরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক সমস্যা, জলবায়ু-সম্পর্কিত ব্যবসায়িক ঝুঁকি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিম্নমানের সেবা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি সমস্যায়—বিশেষত আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগের বছরে—বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন বলেও উঠে এসেছে সিপিডির জরিপে।
সিপিডি বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সেবার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।
বড় সংস্কার দরকার আর্থিক খাতে
দেশের আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণশর্ত মেনে নেওয়ার অংশ হিসেবে এ সংস্কার শুরু করা যেতে পারে বলে জানিয়েছে সিপিডি।
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে বিনিয়োগে অধিগম্যতার নিশ্চয়তা দিতে ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া, ঋণের স্থিতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকরী পর্যবেক্ষকের ভূমিকাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও, বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও ইন্সুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটিকে আরও শক্তিশালী হতে হবে।
সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্পোরেট গভর্ন্যান্সের যথাযথ চর্চার অভাব, দুর্বল নিয়ন্ত্রণমূলক তত্ত্বাবধান ও কর্পোরেট নৈতিকতার অভাবের কারণে দেশে ব্যবসার প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ আরও খারাপের দিকে গেছে।
'প্রতিযোগিতা কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে তাদের যথাযথ ভূমিকার বাস্তবায়ন ঘটানো,' জানিয়েছে সিপিডি। বিভিন্ন কোম্পানির 'প্রভাবশালী মার্কেট প্লেয়ার'-এর ভূমিকাও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা উচিত বলেও যোগ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরবরাহ চেইনে বিভিন্ন সত্তার কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য ব্যবসা-সংক্রান্ত তথ্যকে একটি সমন্বিত তথ্য ও উপাত্ত ব্যবস্থায় প্রকাশ করা দরকার।
সাফল্য অর্জন নিশ্চিতকরণে ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, দক্ষতা উন্নয়ন, উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা সমৃদ্ধকরণে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের (এফডিআইসহ) প্রয়োজন আছে।
বাংলাদেশ কোথায় উন্নতি করেছে
প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ চারটি সূচকে ভালো পারফরম্যান্স করছে—যার মধ্যে শ্রমিক-নিয়োগদাতা সম্পর্কে সহযোগিতা, দক্ষ কর্মচারী খুঁজে পাওয়া সহজকীরণ ইত্যাদি রয়েছে।
তবে উচ্চ কর হার সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের মনোভাব আগের চেয়ে ইতিবাচক হয়েছে। এটি এখন অষ্টম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আগে ছিল চতুর্থ সমস্যাযুক্ত বিষয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্ভবত ডিজিটাল ব্যবস্থার প্রসারের কারণে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ঘুষের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা আগের চেয়ে বেড়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিকে বেশ কিছু বছর ধরে ব্যবসায়ীরা ইতিবাচকভাবে নিচ্ছেন। ব্যবসা-কেন্দ্রিক সরকারি নীতি এবং সেগুলো বাস্তবায়নের কারণে এই দৃষ্টিভঙ্গি আগের চেয়ে ইতিবাচক হয়েছে।