বারবার নীতি পালটানো বিনিয়োগের জন্য সহায়ক নয়: রাইজিং গ্রুপ এমডি
একটি দেশে ঘন ঘন এবং আকস্মিক নীতিগত পরিবর্তন বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। কারণ বিনিয়োগের সিদ্ধান্তগুলো মূলত ক্ষমতায় থাকা সরকারের নীতির ওপর নির্ভরশীল, বলেছেন বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু। রাইজিং গ্রুপের টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, অ্যাক্সেসরিজ, ফাইন্যান্স ও ইকোনমিক জোনসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে।
টিবিএস-এর সঙ্গে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক এ সহ-সভাপতি বলেছেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা ব্যবসার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর জন্য দ্রুত উন্নতি প্রয়োজন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চলমান ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ অবস্থা নিয়ে মাহমুদ হাসান খান কথা বলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রিয়াদ হোসেনের সঙ্গে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য পরিবেশ কেমন দেখছেন?
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য অন্যতম উদ্বেগের জায়গা। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, তবে খুব ধীরে। এ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি দরকার, যাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়ে। এছাড়া নির্বাচন এবং পরবর্তী সরকারব্যবস্থা নিয়ে উদ্যোক্তারা পরিষ্কার পরিকল্পনা দেখতে চান। পরবর্তী সরকারের পরিকল্পনা কী হবে? কেননা অনিশ্চিত পরিবেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তো নয়ই, স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আস্থা পান না।
বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে, ব্যবসা দুই ধরনের: ট্রেডার্স ও উৎপাদনশীল খাত। যদিও ব্যবসায়ীরা যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে কিছুটা খাপ খাইয়ে নিতে পারেন, উৎপাদনশীল খাতের বিনিয়োগকারীদের চ্যালেঞ্জ বেশি।
উৎপাদনে যাওয়ার পর অবকাঠামো, রাজনৈতিক পরিবেশ, সরকারের বিভিন্ন নীতি, গ্যাস-বিদ্যুতের মতো পরিষেবার পরিস্থিতি সহায়ক না থাকলেও চাইলেও তা বন্ধ করে দেওয়া যায় না। ফলে অনেক বিচার-বিবেচনা করে তাদেরকে বিনিয়োগে আসতে হয়।
বিনিয়োগকারীরা কি সহায়ক নীতিমালার জন্য অপেক্ষা করছেন?
এখন আমরা জানি না, এসব পরিস্থিতির উন্নতিতে কত সময় লাগবে? নির্বাচিত সরকার আসতে কত সময় লাগবে? পরবর্তী সরকারের নীতি কী হবে?
একটি সরকার আসার পর তাদের নীতির ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত আসে। এমন নয় যে, আজ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কাল থেকেই উৎপাদন শুরু। বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তা বাস্তবায়নে আরও এক বছরের মতো সময় লেগে যায়। ফলে আমি এখনই যদি বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিই, তা বাস্তবায়ন হতে পুরো ২০২৫ সাল লেগে যাবে।
এ সময়ে স্থানীয়রা কিছু বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। আগামী বছর নতুন সরকার আসার পর যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা বাস্তবায়ন হতে আরও এক বছর লাগবে।
ফলে বলতে পারি, বিনিয়োগকারীরা এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। বিশেষত চলতি বছর, অর্থাৎ ২০২৫ সালে বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা কম।
আমরা দেখতে চাই, ব্যবসার পরিবেশ বা পরবর্তী সরকারের নীতিমালা কী হবে। আমাদের [বাংলাদেশ] বদনাম আছে বার বার 'গোল পোস্ট' [নীতি] পরিবর্তন করার।
বাংলাদেশের পলিসি বিনিয়োগের জন্য কতটা সহায়ক?
উদাহরণ দেওয়া যাক। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য কিছু ট্যাক্স ও ভ্যাট সুবিধা দেওয়া হয়। তবে বিনিয়োগ আসার পর ধাপে ধাপে এসব সুবিধা তুলে নেওয়া হয়, যা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে।
যদি কোনো সুবিধা না দেওয়ার পরিকল্পনা থাকে, তা শুরুতেই স্পষ্ট করা প্রয়োজন। বিনিয়োগ আসার পর সুবিধা প্রত্যাহারে আইনগত বাধা না থাকলেও, এটি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভুল বার্তা দেয়। বিদেশি ও স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, বাংলাদেশে পলিসির স্থায়িত্ব নেই, যেকোনো সময় তা পরিবর্তিত হতে পারে। এমন পলিসি পরিবেশে বিনিয়োগকারীরা স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ হারান।
সম্প্রতি আমরা দেখলাম, অর্থবছরের মাঝপথে বেশ কিছু পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। কিছু শিল্পের কর অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহারের কথাও শোনা যাচ্ছে। বছরের মাঝামাঝিতে এমন হঠাৎ সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন এবং স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ উভয়ই নিরুৎসাহিত করে।
বাংলাদেশ এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েট করছে, প্রস্তুতি কতটুকু?
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর রপ্তানি বাণিজ্যের গতি ধরে রাখা বাংলাদেশের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য কিছু দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা জরুরি। কিন্তু এ বিষয়ে পর্যাপ্ত হোমওয়ার্ক হচ্ছে না।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে পোশাকের ক্রয়াদেশ কি কমছে?
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে পোশাক খাতের ক্রয়াদেশ কমছে বলে অনেকে মনে করছেন। তবে আমি বলব, না। ক্রয়াদেশ কমছে না। কিন্তু চীন থেকে সরিয়ে নেওয়া ক্রয়াদেশ যে বাংলাদেশের পাওয়ার সুযোগ ছিল, তা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। এ ক্রয়াদেশ ভিয়েতনাম, ভারতসহ অন্য দেশগুলোতে যাচ্ছে।
বায়ারের কাছ থেকে কি প্রকৃত দর পাওয়া যাচ্ছে?
অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা থাকলে বিদেশি ক্রেতারা কম দামে পণ্য কেনার সুযোগ নেয়। একইভাবে, নির্দিষ্ট কোনো বায়ারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হলে দর কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এজন্য কোনো রপ্তানিকারকের উচিত নয় তার উৎপাদন সক্ষমতার ২৫ শতাংশের বেশি নির্দিষ্ট একটি বায়ারের ওপর নির্ভর করা।
বায়ারের কাছ থেকে ভালো দর পেতে কিছু কৌশল রয়েছে। এটি কখনো ঘোষণা দিয়ে বাড়ানো যায় না। নতুন স্টাইল ও ফ্যাশন যুক্ত করা, উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাড়তি ব্যয়ের চাপ সামাল দেওয়া সম্ভব।
সাপ্লাই চেইন, কারখানা এবং উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা ধরে রাখা যায়। এ ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।