শীর্ষ ২০ ঋণ খেলাপির অর্ধেকই চট্টগ্রামে
সংসদে প্রকাশ করা শীর্ষ ২০ ঋণ খেলাপির ৯ প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের। যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট ঋণ স্থিতির পরিমাণ ৯ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা।
গত মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে ঋণ খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করেন। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির মোট ঋণ স্থিতির পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে খেলাপি ঋণ ১৬ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। সেই হিসেবে- দেশের শীর্ষ খেলাপির প্রায় অর্ধেকই চট্টগ্রামে।
তালিকার দুই নম্বরে থাকা চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ ইয়ার্ড লিমিটেডের কাছে ১৫৩০ কোটি টাকা, চার নম্বরে থাকা রাইজিং স্টিল লিমিটেডের কাছে ৯৯০ কোটি টাকা, পাঁচ নম্বরে থাকা মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্সের (এমইবি) কাছে ৯৬৬ কোটি টাকা, নয় নম্বরে থাকা সাদ মুসা গ্রুপের কাছে ৭৭৭ কোটি টাকা, ১১ ও ১৪ নম্বরে থাকা এস এ গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে ১৩৫৫ কোটি টাকা, ১৭ নম্বরে থাকা এস এম স্টিলের কাছে ৬৩০ কোটি টাকা, ১৯ নম্বরে থাকা এহসান গ্রুপের কাছে ৫৯০ কোটি টাকা ও মেসার্স সিদ্দিক ট্রেডার্সের কাছে ৫৪১ কোটি টাকা খেলাপি পাওনা রয়েছে।
চট্টগ্রামের নয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নতুন খেলাপি হিসেবে যুক্ত হয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ ইয়ার্ড লিমিটেড। বাকি আটটি দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি হিসেবে তালিকায় রয়েছে। এরমধ্যে রাইজিং স্টিল, এমইবি, এস এ গ্রুপ ও একই গ্রুপের সামান্নাজ সুপার অয়েল আগে থেকেই শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকায় ছিল।
সংসদের তালিকায় এই ২০ প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ স্থিতির পরিমাণ ৯ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা উল্লেখ করা হলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রকৃত ঋণ ১৬ হাজার ৩১২ কোটি টাকার বেশি।
এরমধ্যে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ ইয়ার্ডের কাছে ১৯ ব্যাংকের দুই হাজার কোটি টাকা, রাইজিং গ্রুপের কাছে ১৮ ব্যাংকের দুই হাজার কোটি টাকা, এমইবির কাছে ১২ ব্যাংকের এক হাজার কোটি টাকা, সাদ মুসা গ্রুপের কাছে ১৫ ব্যাংকের তিন হাজার কোটি টাকা, এস গ্রুপের কাছে চার হাজার কোটি টাকা, এসএম স্টিলের (আরএসআরএম) কাছে ১০ ব্যাংকের দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা, এহসান গ্রুপের কাছে তিন ব্যাংকের ৬২৪ কোটি টাকা ও সিদ্দিক ট্রেডার্সের কাছে ১৫ ব্যাংকের এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওনা।
পাওনাদার ব্যাংকের কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশের মোট খেলাপির প্রায় অর্ধেকই চট্টগ্রামে। কারণ একসময় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জই ছিল দেশের ভোগ্যপণ্য আমদানি-রপ্তানির প্রধান কেন্দ্র। এই বাজারে ট্রেডিং দিয়ে শুরু করা প্রতিষ্ঠানগুলোই পরে বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে। ফলে এই বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে সহজেই বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলো। ভোগপণ্য আমদানিতে এলটিআর বা এলএটিআর ক্যাটাগরিতে এই ঋণ বিতরণ হতো খুব সহজ শর্তেই। কোন উদ্যোক্তা কত ঋণ পাবে বা কোলাটেরল সিকিউরিটির বিষয়ে কোন শর্ত না থাকায় সহজে শত শত কোটি টাকার ঋণ পেয়েছে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকরা। এতে চাহিদার তুলনায় সংশ্লিষ্ট পণ্যের আমদানি হয়েছে অনেক বেশি।
এছাড়া ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্য়ন্ত শিপ ব্রেকিং খাতের সুদিনে অনেক নতুন নতুন ব্যবসায়ী এই খাতে ব্যবসায় আসে। ব্যাংকগুলো এই দুই খাতে ওভার ফাইন্যান্স করে।
কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্য়ন্ত ওয়ান ইলেভেনে নায্যমূল্যে ভোগ্যপণ্য বিক্রির জন্য ব্যবসায়ীদের উপর চাপ প্রয়োগ, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারের সাথে দামের সমন্বয় না হওয়ায় বড় অংকের লোকসানে পড়ে ভোগ্যপণ্য ও শিপ ব্রেকিং খাতের ব্যবসায়ীরা।
এরপর লোকসানে পড়া বহু ব্যবসায়ী এসব খাত থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। ফলে ঝুঁকিতে পড়ে ব্যাংকগুলো। ঋণগুলো আস্তে আস্তে খেলাপি হয়ে পড়ে।
এছাড়া এসব খেলাপিদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকার সুবাদে অন্যান্য ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ সুবিধা পেয়েছেন। আবার কেউ কেউ ব্যাংক মালিকদের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় ঋণ পেতে বাড়তি সুবিধা নিয়েছেন।
চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় খেলাপি প্রতিষ্ঠান এস এ গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আলম মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যাংকটির রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটির প্রধান ছিলেন। যার ফলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পেয়েছেন। এহসান গ্রুপের আবু আলম ছিলেন পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক।
রাইজিং গ্রুপের কর্ণধার ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী ঋণ পেয়েছেন বিএনপির অপর নেতা ও ওয়ান ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক মোরশেদ খানের প্রভাবে। এছাড়া অন্যান্য খেলাপি ব্যবসায়ীরাও কোনো কোনোভাবে ব্যাংক মালিকদের প্রভাবিত করেছেন বড় অংকের ঋণ পেতে।
তবে ঋণ প্রদানে ব্যাংকগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতার কথা উল্লেখ করেন এনসিসি ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক আলী তারেক পারভেজ। এই কর্মকর্তা বলেন, দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। যে কারণে ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যবসার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। এতে ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ভলিউম কিংবা ঝুঁকির বিষয় বিবেচনায় না নিয়েই বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলো। এভাবে ঋণগুলো ঝুঁকিতে পড়ে যায়।
খেলাপি ঋণের বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, খেলাপি হওয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে জমি কিনেছে। দেশের বাইরে পাচার করেছে কিংবা ভোগ বিলাসে ব্যয় করেছে। ঋণ প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকগুলোকে আরো সতর্ক হতে হবে।
তালিকায় দুই নম্বরে থাকা ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের পরিচালক ক্যাপ্টেন তারেক এম নসরুল্লাহ বলেন, "পাওনাদার ব্যাংকগুলোর সাথে ঋণগুলো সেটেলমেন্ট করার জন্য চেষ্টা চলছে। তার জন্য কয়েকটি ব্যাংকে ইতোমধ্যে ডাউন পেমেন্টও দেয়া হয়েছে। তাছাড়া নতুন বিনিয়োগের মাধ্যেমে জাহাজ নির্মান খাতকে কিভাবে আগের চেয়ে আরো বেশি রপ্তানিকারক খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করে যাচ্ছি আমরা।"
সাদ মুসা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসিন বলেন, "দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে পোষাক রপ্তানি খাতে ব্যবসা করে আসছি। এই সময়ে ঋণ পরিশোধে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে গিয়ে দীর্ঘদিন কারখানাতে গ্যাস-বিদ্যুৎ সুবিধা না পাওয়ায় উৎপাদনে যেতে পারিনি। যে কারণে লোকসান গুনতে হয়েছে। করোনা ও তৎপরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে এখনো লোকসান হচ্ছে।"
তিনি আরো বলেন, "মূলধন সংকটে পুরোদমে কারখানাগুলোতে উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করবো- আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে পুরোদমে উৎপাদন চালিয়ে নিতে পারে, তার জন্য পুনঃবিনিয়োগ সুবিধা দিতে।"
মেসার্স সিদ্দিক ট্রেডার্সের কর্ণধার আবু সাঈদ সম্রাট বলেন, "ব্যবসা করতে গেলে লাভ-লোকসান হয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের উত্থান-পতনের কারণে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ২০০৬-২০১৩ সালে বড় ধরণের লোকসান গুনতে হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো আমাদের রি-ফাইন্যান্স না করে শুধু টাকা এডজাস্ট করে নিয়েছে। এতে আমাদের ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়তে হয়েছে। আমরা এখন জায়গা জমি বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা শোধ করছি। ব্যবসা করতে পারছি না। ব্যাংকগুলো রি-ফাইন্যান্স করলে ব্যবসা করে ব্যাংকের পাওনা শোধ করা যেতো।"