উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানোতেও কি কোনো মানসিক সুবিধা আছে?
আনন্দ বা সুখ পাওয়ার একটি দারুণ উপায় হলো বড় শহরের মধ্যে দিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো, নতুন নতুন দৃশ্য আবিষ্কার করা। ফরাসিরা এটাকে ডাকে ফ্লেনো' বলে। সাহিত্যজগতে এই 'ফ্লেনো''র উদাহরণ কম নয়। স্যুরিয়ালিস্ট চিত্রকরেরা প্যারিসের রাস্তায় হঠাৎ করে নেমে গিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতেন।
ভার্জিনিয়া উলফের লেখা মিসেস ড্যালোওয়ে-এর মূল চরিত্রের লন্ডন, জেমস জয়েসের লেখা ইউলিসিস-এর লিওপোল্ড ব্লুমের ডাবলিন কিংবা জে.ডি. স্যালিঙ্গারের লেখা দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই-এর হোল্ডেন কলিফিল্ডের নিউ ইয়র্ক শহর; সর্বত্রই এই ফ্লেনো' চোখে পড়বে। কিন্তু এই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে শহরের পরিবেশ আর মানুষজনকে দেখা — যাকে ভার্জিনিয়া উলফ উল্লেখ করেছেন 'স্ট্রিট হন্টিং' হিসেবে — এর কি কোনো বিজ্ঞানস্বীকৃত উপকার রয়েছে?
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাথেরিন হার্টলি এবং তার সহযোগী গবেষকদের দুটি গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে ফ্লেনো' ব্যক্তির জন্য বেশ ভালো। দুটি গবেষণাতেই তারা জিপিএস উপাত্তের সঙ্গে হ্যাপিনেস রেটিংকে মিলিয়ে দেখেছেন।
তাদের প্রথম গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালে নেচার নিউরোসায়েন্স জার্নালে। নিউ ইয়র্ক এবং মিয়ামি শহরের ১০০ জনেরও বেশি ব্যক্তি অনুমতি দিয়েছিলেন তাদের তিন মাসের জিপিএস ডেটা বিশ্লেষণের জন্য। একইসঙ্গে মোবাইল ফোনের একটি অ্যাপের মাধ্যমে তাদের প্রতিদিনের হ্যাপিনেস বা সুখ মাপা হয়েছিল।
গবেষকেরা জিপিএস ডেটার সাথে মিলিয়ে 'রোমিং এনট্রপি' নামে একটি পরিমাপক তৈরি করেছেন, যার ভিত্তিতে তারা নতুন ও অপ্রত্যাশিত জায়গা ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতার সাথে তাদের সেই মুহূর্তের ভালো-খারাপ লাগার তুলনা করেছেন।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা যত বেশি ঘুরেছেন, তাদের মেজাজ তত বেশি ভালো ছিল বলে ডেটায় উঠে এসেছে। তবে মেজাজ ভালো থাকলেই যে তারা বেশি ঘুরেছেন, এমন দেখা যায়নি। অর্থাৎ, ঘুরে বেড়ানো আপনার মন ভালো করলেও, মন ভালো থাকলেই যে আপনি বেশি ঘুরবেন এমনটি বলা যায় না।
গবেষকেরা আদমশুমারির ডেটাও বিশ্লেষণ করে স্যুরিয়ালিস্টদের ভাবনার সঙ্গে একমত হয়েছেন। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর এই অভিজ্ঞতাকে — হোক সেটি শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ-হিস্প্যানিক কিংবা ধনী-গরীব এলাকা — গবেষকরা নাম দিয়েছেন 'সোশিওডেমোগ্রাফিক এক্সপেরিয়েনশিয়াল ভেরিয়েবিলিটি' হিসেবে। শহুরে জীবনের অন্যতম বড় পাওয়া এই সমাজের বিভিন্ন স্তরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ, যেটিকে সুখ পাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন তারা।
সাইকোলজিকাল সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত দ্বিতীয় গবেষণাটিতে ড. হার্টলি এবং তার সহযোগীরা দেখতে চেয়েছেন, কীভাবে এ ঘুরে বেড়ানো বয়সের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। দেখা গিয়েছে যে, কমবয়সীরাই ঘুরে বেড়ানোর দিকে বেশি আগ্রহী। স্যালিঙ্গারের কলিফিল্ডের বয়সও ছিল মাত্র ১৬।
গবেষকেরা ১৩ থেকে ২৭ বছর বয়সী এমন ৬৩ জন ব্যক্তির তিন মাসের জিপিএস ডেটা সংগ্রহ করেন। অংশগ্রহণকারীরা কতজনকে কল করেছেন কিংবা টেক্সট করেছেন, সেটিও বিশ্লেষণ করেন তারা। ঘুরে বেড়ানো ব্যক্তির মধ্যে সুখ বাড়ায়। তবে বয়স হিসেবে করলে দেখা যায়, ১৩ বছর থেকে রোমিং এনট্রপি বাড়তে বাড়তে ১৮-২০ বছর বয়সে সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে এবং তারপর থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
গবেষণার ফলাফল থেকে বেরিয়ে আসে, কৈশোরের শেষ মুহূর্ত বা যৌবনের প্রথম অংশ ঘুরে বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো সময়। তবে এ রোমিং এনট্রপি বেড়ে যাওয়ার আরও একটি কারণ থাকতে পারে। সদ্য তরুণদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, যে কারণে তারা বানজি জাম্পিং, রক ক্লাইম্বিং থেকে শুরু করে মাদক নেওয়া কিংবা মারামারির মধ্যে জড়িয়ে পড়ে।
তাছাড়া কৈশোরে থাকাকালীন বাবা-মারা তাদের সন্তানদেরকে ঘরে রেখে পড়াশোনা বা ঘরোয়া খেলাধুলার মধ্যে চোখে চোখে রাখতে চান, যা কৈশোরের শেষ পর্যায়ে দেখা যায় না। এটাও ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সীদের রোমিং এনট্রপি বাড়ার কারণ হতে পারে।
তবে দ্বিতীয় গবেষণা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, তরুণ বয়স, নতুন জিনিসের অভিজ্ঞতা নেওয়া আর ঝুঁকি নেওয়া, সবগুলোই একটির সাথে অন্যটি যুক্ত। একইসাথে এটি আনন্দও বাড়ায়। ঘুরে বেড়ানো বাস্তব পৃথিবী ও সমাজ সম্পর্কে ব্যক্তিকে জানায়, তরুণ বয়সে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও। তা-ই আরও বেশি স্ট্রিট-হন্টিং আমাদের জন্য ভালো অনুভূতিই বয়ে আনবে।
সূত্র: দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল