খাবার ডেলিভারি দিয়ে চলছে পড়াশোনা, ধরেছেন সংসারের হাল
সকালে শুরু হওয়া ক্লাস শেষ করে বিকেলে বাড়ি ফেরেন মোহসিনা। এরপর সাইকেল নিয়ে শহরের পথে পথে বেরিয়ে পড়েন। রেস্তোরাঁ ও শপ থেকে খাবার বা গ্রোসারি নিয়ে গ্রাহকের বাড়ির দরজায় পৌঁছে দেন। সকালের নার্সিং শিক্ষার্থী মোহসিনাই বিকেলে হয়ে যান ফুড ডেলিভারি রাইডার। একটি স্মার্টফোন আর সাইকেলই তার পুঁজি। এ নিয়েই স্বপ্নের পেছনে ছুটতে থাকেন অবিরত।
মোহসিনা এখন মিরপুরের একটি নার্সিং কলেজের শেষ বর্ষে পড়াশোনা করছেন। মাকে নিয়ে বসবাস করছেন ঢাকার মিরপুরেই। নিজের পড়াশোনা আর 'মা-মেয়ে'র ছোট্ট সংসারের ভার এখন তার কাঁধে। বিকেল থেকে রাত অবধি খাবার ডেলিভারি দিয়ে যে রোজগার হয়, সেটাই তাকে এ জীবনযুদ্ধে সাহসী বীরের মতো অটল রেখেছে। মোহসিনার এই জীবনযুদ্ধের গল্পটা শুরু হয়েছে বছর দশেক আগে। তখন তিনি সবে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পা রেখেছেন। নিয়তির নির্মম পরিহাসে বাবাকে হারিয়েছেন সেই ছোট্ট বয়সেই। একমাত্র বোনেরও বিয়ে হয়ে যায় তার বাবার মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে। তখন থেকেই মাকে নিয়ে এই শহরে টিকে থাকার যুদ্ধ শুরু হয় মোহসিনার।
বাবাকে হারানোর পর সেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই নিজের আয়েই পড়াশোনা করছেন মোহসিনা। এভাবে শেষ করেছেন মাধ্যমিক, উঠেছেন কলেজেও। কিন্তু পড়াশোনার পরিধি আর দিনক্ষণ যত বেড়েছে, ততই দীর্ঘ হয়েছে খরচের খাতাও। আবার কাঁধে এসেছে 'মা-মেয়ের' সংসার সামলানোর দায়িত্বও। ফলে পড়াশোনার সাথে সাথে কাজ করে ভালো অর্থ আয় করা যায় এমন একটি শোভন পেশায় যোগ দেওয়া লক্ষ্য ছিল তার।
২২ বছর বয়সী মোহসিনা এখন অনলাইন ফুড ও গ্রোসারি ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম ফুডপ্যান্ডায় রাইডার হিসেবে কাজ করেন। নিজের স্বাধীনতামতো বেছে নিতে পারেন কাজের সময়। পরীক্ষার সময় কাজ বন্ধ রাখেন। পড়ালেখা আর কাজ সমানতালে চালিয়ে যেতে কোনো বাধারই সম্মুখীন হতে হয় না মোহসিনাকে। তিনি জানালেন, কলেজের এক বন্ধুর কাছে একদিন ফুডপ্যান্ডায় রাইডার হিসেবে কাজ করার কথা জানতে পারেন। প্রতিদিন তার ক্লাস থাকে। আর এ প্ল্যাটফর্মে নিজের ইচ্ছানুযায়ী সময়ে কাজ করা যায়। এ বিষয়টিই তাকে আগ্রহী করে। এরপর সাইকেল আর স্মার্টফোনকে সম্বল করে কাজ শুরু করেন তিনি।
খাবার ডেলিভারি দেয়ার কাজ শুরুর আগে আরও বিভিন্ন ধরনের খণ্ডকালীন কাজও করেছিলেন। সেলসম্যান থেকে শুরু করে সুপারশপের কাজ, সবই করেছেন। তবে পড়াশোনার পাশাপাশি সুবিধামতো কাজের সেই স্বাধীনতার স্বাদটি আস্বাদন করতে পারেননি। মোহসিনা বলেন, 'এখানে নির্বিঘ্নে পড়াশোনা চালিয়ে কাজ করছি। পরীক্ষা থাকলে কাজ বন্ধ রাখি। আর প্রতিদিন ক্লাস শেষে নিজের সুবিধামতো সময়ে কাজ করি। কিন্তু আগে যে কাজগুলো করেছি সেগুলোর নির্দিষ্ট সময় থাকত। সেই সময়ের বাইরে কাজ করা যেত না। এতে পড়ালেখার ব্যঘাত ঘটত। প্রতি মাসে এখন ২০ হাজার টাকার বেশি আয় হয়। আর সপ্তাহ শেষেই উপার্জিত অর্থ প্রাপ্তির সুযোগটা দারুণ।'
মোহসিনা তার জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে অনেকসময় হোঁচটও খেয়েছেন। আত্মীয়রা বিভিন্ন সময়ই বিয়ের পরামর্শ দিতেন। কিন্তু তিনি তার স্বপ্নে অটুট ছিলেন। এসব বাধাকে উপেক্ষা করেছেন তার দৃঢ় মনোবল আর অসীম সাহস দিয়ে। মোহসিনা জানান, মায়ের অকুণ্ঠ সমর্থনই তার এগিয়ে যাবার মূল প্রেরণা। পাশাপাশি উপার্জন সক্ষমতা ও আর্থিক স্বাবলম্বীতা তাকে এসব বাধা মোকাবিলায় সাহস জুগিয়েছে।
নারী হিসেবে ফুড ডেলিভারির কাজ করার জন্য আত্মীয় ছাড়াও প্রতিবেশী, সমাজের অন্যান্যরাও কটু কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, 'প্রতিবেশীরা ফুড ডেলিভারির এ কাজ ছেড়ে দিয়ে গৃহ-পরিচিকার কাজ করার পরামর্শও দিয়েছেন। আবার রাস্তায় অনেক সময়ই রিকশাচালকরা কটু কথা বলেন। এগুলো শুনে কখনোই হতাশ হইনি। কারণ আমি আমার স্বপ্নটা ছুঁতে চাই।'
আগ্রহীরা পরামর্শ চাইলে তাদের রাইডার হিসেবে যুক্ত হতে উৎসাহিত করেন মোহসিনা। তিনিই জানালেন রাইডারদের সুরক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্ল্যাটফর্মটির নানা উদ্যোগের কথাও। ইন্সুরেন্স সুবিধা যেমন রাইডারদের সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করছে তেমনি তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য রয়েছে অনলাইন শিক্ষার সুযোগও। এছাড়াও স্মার্টফোন বা সাইকেলসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে রয়েছে সহজ শর্তে লোনের সুবিধাও।