ক্লাস শুরুর ৪০ দিনেও সব পাঠ্যবই হাতে পায়নি শিক্ষার্থীরা
ক্লাস শুরুর ৪০ দিনেও পাঠ্যপুস্তকের সম্পূর্ণ সেট, অর্থাৎ সবগুলো পাঠ্য বই হাতে পায়নি দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের হাজার হাজার শিক্ষার্থী। অথচ নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রথম দিন, ১ জানুয়ারিতেই প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে এক সেট করে পাঠ্যপুস্তক দেওয়ার কথা ছিল সরকারের।
প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (পিআইএবি) সূত্র জানায়, ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অন্তত এক কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা বাকি ছিল। তবে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর তথ্য মতে, এই সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি নয়।
সকল পাঠ্যপুস্তক যথাসময়ে বিতরণে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে মুদ্রণে দেরি হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে এনসিটিবি ও ছাপাখানার মালিকরা একে অপরকে দায়ী করছেন।
বই বিতরণ প্রক্রিয়া শেষ করতে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস লেগে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন পিআইএবি নেতারা।
ন্যাশনাল কারিকুলাম অ্যান্ড টেক্সটবুক বোর্ড (এনসিটিবি) অনুসারে, এ বছর সরকার সারাদেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে ৩৪.৬০ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণের আনুমানিক হিসাব করেছিল।
এদিকে, দেশের বিভিন্ন উপজেলার অনেক স্কুলেই নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সব পাঠ্যপুস্তক পৌঁছায়নি বলে জানা গেছে। এমনই একটি স্কুল বগুড়ার শিবগঞ্জের চন্দনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এখনও গণিতের পাঠ্যপুস্তক পায়নি; অন্যদিকে, দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও গণিত এবং বাংলার পাঠ্যপুস্তক হাতে পায়নি।
এছাড়া তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যে ছয়টি বিষয় অধ্যয়ন করে, তারমধ্যে কেবল দুটির পাঠ্যপুস্তক পেয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি শিবগঞ্জের সভাপতি মোঃ জালাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, উপজেলার অন্যান্য স্কুলেও প্রায় একই অবস্থা।
তবে শিবগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এস এম সারোয়ার জাহান বলেন, "আমরা এ উপজেলায় প্রাথমিক স্তরের বই বিতরণ সম্পন্ন করেছি। সামাজিক বিজ্ঞানের বইসহ কিছু বই বিতরণে বিলম্ব হলেও জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের মধ্যে সেগুলোও স্কুলে বিতরণ করা হয়েছে।"
এদিকে, অন্যান্য এলাকার কিছু স্কুলের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা জানায়, এখনও সবগুলো পাঠ্যপুস্তক হাতে পায়নি তারা।
ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলার একটি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র সোহানুর রহমান টিবিএসকে জানায়, "আমাদের কাছে এখন মোট ১২টি বিষয়ের মধ্যে মাত্র পাঁচটি বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক আছে। শিক্ষকরা শুধু এই বিষয়গুলোরই ক্লাস নিচ্ছেন।"
একই উপজেলার একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র ওয়াহিদুর রহমান জানায়, "আমি বিজ্ঞান গ্রুপের ছাত্র। আমি ও অন্যান্য শিক্ষার্থীরা কোনো পাঠ্যবই ছাড়াই পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যার ক্লাস করছি।"
সংশ্লিষ্টরা জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর নতুন শিক্ষাবর্ষের আগে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা এনসিটিবি-এর কাছে জমা দেয়; এই সংস্থা বইয়ের মুদ্রণ ও উপজেলা পর্যায়ে তা বিতরণ প্রক্রিয়া তদারকি করে।
পরে, উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে স্কুলে বই বিতরণ কর্মসূচি তদারকি করে অধিদপ্তর।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর মোঃ ফরহাদুল ইসলাম বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, কয়েকটি উপজেলায় পাঠ্যপুস্তকের ঘাটতি রয়েছে।
"৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩০ লাখ বইয়ের ঘাটতি ছিল। এরপর থেকে প্রতিদিন অন্তত তিন লাখ বই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও যে বইগুলো বিতরণ করা বাকি আছে, সেগুলোর বেশিরভাগই নবম শ্রেণির," যোগ করেন তিনি।
বই বিতরণে বিলম্বের জন্য প্রিন্টারদের দায়ী করে তিনি বলেন, "প্রিন্টিং হাউসগুলোকে ১৭ জানুয়ারির মধ্যে সব বই পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। যে হাউজগুলো তা করতে পারেনি আমরা সেগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করবো। অন্তত ৮ থেকে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। ভবিষ্যতে তারা কাজ পাবে না।"
অন্যদিকে, প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (পিআইএবি) চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাত এ পরিস্থিতির জন্য এনসিটিবির অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন।
তিনি বলেন, "এনসিটিবি এমন কিছু প্রকাশককে কার্যাদেশ দিয়েছে, যাদের সময়মতো মুদ্রণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষমতা নেই। বিভিন্ন প্রেসে এখনও নিম্নমানের কাগজে বিপুল সংখ্যক বই ছাপা হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ছাপাখানার মালিকরা লোডশেডিং, কাগজের স্বল্পতার মতো বড় ধরনের সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন।
পিআইএবির সাধারণ সম্পাদক মোঃ জহুরুল ইসলাম জানান, "এ বছর প্রায় ৮৭টি প্রিন্টিং হাউজ কাজের অর্ডার পেয়েছে। এরমধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০টি প্রতিষ্ঠান বই পৌঁছে দিয়েছে।"