এক অখ্যাত, নামহীন মিষ্টির দোকান যখন জিভে জল আনে!
"এদের রসগোল্লা মানে আদতেই রসে ডুবে থাকা মিষ্টি, মুখে দিলে হালকা একটু এলাচ, আর খাঁটি দুধের মিশেলে দারুণ একটা স্বাদ। কেমন একটা শান্তি শান্তিভাব। দুধ না গরম মশলার অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ, তা বুঝে উঠতে উঠতেই কেটে যাবে বেশ খানিকক্ষণ।" এভাবেই প্রায় অখ্যাত এক মিষ্টির দোকানে তৃপ্ত এক খদ্দেরের 'পল্লী ভাই' বর্ণনা, নাম রিক্ত গোমেজ। দোকানের জীর্ণ গ্ৰামীণ রূপ চট করে চোখে পড়ার মতো নয়। সাইনবোর্ড আছে সে, না থাকার মতোই। কষ্ট করে অর্থ উদ্ধার করতে হয়। পল্লী ভাই ভাই মিষ্টি ভাণ্ডার। আশপাশের লোকজন শুধু জানে এই দোকানের জিভে জল আনা মিষ্টির স্বাদ!
নিজের ও কখনো বন্ধুদের নিয়ে সকালের নাশতায় ডাল-ভাজি পর্ব শেষে মিষ্টি ও মিষ্টির রসে ডুবিয়ে হালকা গরম কিন্তু কিছুটা মুচমুচে ভাবের পরোটা একদম তার নেশায় পরিণত হয়েছে, রিক্ত গোমেজের সদর্প দাবি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া রিক্তর মুখ থেকে মিষ্টির বর্ণনা শুনতে শুনতেই কানে এল সত্তরের কাছাকাছি শক্ত-সামর্থগোছের এক ভদ্রলোকের কথা। দোকানে ঢুকেই কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে বললেন, "দাও দেহি, দুইখান মিষ্টি। বসে খাই। একটু পর তো আর থাকবে না। পল্লী ভাই ভাইয়ের দোকানের মিষ্টি তো আবার থাকে না, সকালেই শেষ।" পরের কথাগুলো বোধহয় তার দুই বন্ধুর উদ্দেশ্যেই বলছিলেন। তারা ভেতরে এসে বসতেই হোটেলটির এক কর্মচারী এসে তাদের সামনে দুটি করে মিষ্টি রেখে গেল।
"এত বছর ধরে আছি, এত মিষ্টির দোকান দেখলাম, কই এদের মতো তো লাগে না।" খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল মিষ্টি নিয়ে তাদের কথোপকথন।
বলছিলাম, সাভারের রাজাশনে পলুর মার্কেটে 'পল্লী ভাই ভাই সুইটমিট' নামে এক মিষ্টির দোকানের কথা। সাভার স্ট্যান্ডের অন্ধমার্কেট বা চৌরঙ্গী যেদিকে, সেই পাশ থেকে পলুর মার্কেট বলে ডাকতে থাকা একটা অটোরিকশায় উঠে পড়লে সেখান থেকে মিনিট বিশেকের রাস্তা, রিজার্ভ নিলে ভাড়া ৪০ টাকার মতো, আর কয়েকজন মিলে শেয়ারে নিয়ে খরচ পড়বে ২০ টাকার মতো।
দোকানটিতে ঢুকতেই হাতের ডানে চোখে পড়বে একজন শিঙারা-সমুচা বানাচ্ছে, বাঁ দিকে আরেক কারিগর, এক কড়াই শুকনো মরিচ ডুবো তেলে ভাজছেন। এরপর সামনে এগোতে কাউন্টার। তার উল্টোপাশে তাক তাক করে রাখা মিষ্টির খালি প্যাকেট। পাশেই রাখা বিশাল দুটো ডেকবোঝাই মিষ্টি। একটায় কালোজাম, আর আরেকটায় রাখা সাদা রসগোল্লা।
তখন সকাল ১১টা ছুঁইছুঁই। পল্লী ভাইয়ের ভাইয়ের স্বত্বাধিকারী মফিজউদ্দিনের ছোট ছেলে সানোয়ার হোসেন বসে ছিলেন কাউন্টারে। জানালেন, সকাল ৭টা নাগাদ প্রতিদিন খোলে দোকান। তখন থেকে কাস্টোমারদের চাহিদামাফিক পরোটা-ভাজি আর পাশাপাশি মিষ্টি, শিঙারা, সমুচা বিক্রি চলতে থাকে হরদম। তবে রসগোল্লা আর কালোজাম- কেবল এই দুইধরনেরই মিষ্টি তৈরি হয় দোকানে। সঙ্গে থাকে দই। ২৩০ টাকা দাম প্রতি কেজি মিষ্টির। আর দইয়ের দাম ২১০ টাকা। দিনে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ কেজির মতো মিষ্টি বিক্রি হয়।
"সকাল থেকে শুরু হয় মিষ্টি তৈরি কার্যক্রম। মূলত, ৪টার পর থেকে শুরু হয় গরম গরম মিষ্টি বিক্রি। আর সেই মিষ্টি সকালেও বিক্রি করি। এমনভাবে তৈরি করি যাতে বিকেলে তৈরি মিষ্টি পরদিন সকালের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। পরেরদিন আবার যে মিষ্টি তৈরি হবে তার সঙ্গে যাতে মিলে না যায় আগের দিনের বাসি মিষ্টি, এটাই মূল বিষয়।"
পরোটা দিয়ে মিষ্টিমুখ শেষে পাশের দোকান থেকে আনা গরুর দুধের চা খেতে খেতে কথা বলছিলাম। এরমধ্যেই এক নারী এলেন তার নাতিকে নিয়ে। ৮ কেজি মিষ্টি নিচ্ছিলেন। এই মিষ্টি যাবে বরিশাল। প্রায় ২ হাজার টাকার মিষ্টি নিয়েছেন। আগের থেকে ৫০০ টাকা দেওয়া ছিল। নতুন করে আরও ৫০০ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিলেন সানোয়ার উদ্দিনকে। বাকিটা শোধ করবেন ধীরেসুস্থে।
এবারে জানতে চাওয়া, এভাবে ভেঙে ভেঙে টাকা নেন? সানোয়ার জানালেন, এরা তাদের পুরোনো কাস্টোমার। এই গ্রামেরই। ছোট থেকেই দেখছেন। তার মুখ থেকে শুনলাম, এখন যে এতো বড় এই পলুর মার্কেট, তা কিন্তু তখন ছিল না। জানালেন, পলুর দোকানসহ মাত্র ৪টা দোকান ছিল।
সানোয়ার বলছিলেন, "সাভারে কত ভালো ভালো মিষ্টির দোকান রয়েছে! তবে এই রাজাশনের দিকে তেমন কোনো দোকান ছিল না। আর এইদিককার মানুষ যেহেতু উল্টোদিকে (নামার বাজারের দিকে) যায় না, তাই আমাদের দোকানে আসেন।"
এই দোকানের বয়স তিরিশের কাছাকাছি বলে জানালেন সানোয়ার।
নাম কেন 'পল্লী ভাই ভাই সুইটমিট'?
যেহেতু একদম গ্রামের ভেতর দোকান, আর দুই ভাই মিলে বসেন, তাই দোকানের নাম পল্লী ভাই ভাই সুইটমিট রাখা হয়।
তাদের এই হোটেল কাম দোকানটি দিয়েছিলেন তার বাবা মো. মফিজ উদ্দিন। সারাদিন পালা করে তিনি আর তার বড়ভাই দোকানে বসেন। মিষ্টির দুই কারিগর, পরোটা-শিঙাড়ার আরও দুই কারিগর আর হোটেলে দুই কর্মচারী- এ নিয়েই তাদের দোকান। তবে সকালের দিকে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য দোকানে বসেন তার বাবা। বয়স ৮৫ হলেও এখনও বেশ সচল তিনি।
কথায় কথায় জানা গেল, প্রতিদিন সকালে কাউন্টারে যে শুধু বসেন তাই নয়, কারিগরদের মিষ্টি বানানোর তদারকি এখনও করেন তার বাবা। এরপর থেকে তার বড় ভাই আর সে পালাক্রমে দোকানে বসেন। তারা মিষ্টি বানানোর কাজ করেন। বানানো বলতে একদম দুধ সংগ্রহ থেকে শুরু করে দুধ কেটে ছানা করা। ছানা মথা, শিরা তৈরি এরপরে চুলায় জ্বাল করা, সবকিছুতেই হাত লাগান তারা।
"সকাল-সন্ধ্যা ঠিক নাই, যখন যেরকম প্রয়োজন হলে হাত লাগাই, চাপ কেমন তার ওপর নির্ভর করে।" কোনসময় চাপ বেশি থাকে, এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফল বেরুলে? উত্তরে বললেন, "আমাদের হোটেল তো ছোট, ওইভাবে তেমন কোনো সময় নেই। আর আমরা মিষ্টি তৈরির বিষয়ে কোনো চাপও নেই না। প্রতিদিন যা মিষ্টি বানাই তাই। সেটা যদি শেষ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে আর নতুন করে কাস্টোমারদের জন্য কিছু বানাই না। বিকেলের জন্য আবার নতুন করে মিষ্টি বানানো হয়।"
তবে চাপ যে মন্দ নয়, তা বোঝা গেল সাভারের স্থানীয় বাসিন্দা ফাহাদ হায়দারের কথায়। তার ছোটবেলার স্কুল সেন্ট জোসেফের একদম কাছেই দোকানটি। "ছোটবেলা থেকেই পল্লী ভাই ভাইয়ের মিষ্টি খাই। এদের মিষ্টি নিতে অনেক দূর থেকে প্রতিদিন অনেক কাস্টোমার আসে," জানাচ্ছিলেন ফাহাদ।
এই যে দূর-দূরান্ত থেকে এতো মানুষ আসে পল্লী ভায়েদের মিষ্টি খেতে, এই গ্রহণযোগ্যতা কিন্তু একদিনে হয়নি। শুনছিলাম মিষ্টির দোকানটি তৈরির ইতিবৃত্ত মালিক মফিজ উদ্দিনের মুখ থেকে। তিনি জানালেন, এ এলাকায় বহু আগের থেকেই পাল আর ঘোষদের আধিপত্য থাকায় মৃৎশিল্প আর আর মিষ্টি তৈরিতে এগিয়ে ছিল সাভারের মানুষ।
ঘোষদের আগমন কীভাবে তা জানা না গেলেও পালরা যে অনেক পুরোনো অধিবাসী, তার সত্যতা পাওয়া যায় ভ্রমণবিষয়ক বাংলাদেশি ওয়েবপোর্টাল 'অফরোড বাংলাদেশ'-এও। সেখানে বলা হয়েছে, পাল বংশের রাজা হরিশচন্দ্রের সর্বেশ্বর রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল সম্ভার। আর সেখান থেকেই এখনকার সাভারের নামকরণ।
খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে সাভার এলাকা ছিল এই প্রদেশের রাজধানী। পরবর্তীতে অনেক বৌদ্ধ মূর্তি এ এলাকার মাটির নিচে পাওয়া গেছে। তা থেকে ধারণা করা হয়, বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ বা মৌর্যদের সম্রাট অশোকের সময় এ এলাকার গোড়াপত্তন হয়েছিল। হরিশচন্দ্রের রাজবাড়ি সাভারের রাজাশনে পড়ে আছে বলে ধারণা করা হয়। সেই হিসেবে সাভারের বয়স দুই হাজারের বয়সের বেশি। এসব তথ্য যদি ঠিক থাকে তাহলে সাভার ও আশপাশের স্থানীয়রা যে কত পুরোনো অধিবাসী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যাহোক, মফিজউদ্দিন বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আগের কথা। অত বছর আগেকার ঘটনা এখন আর খুব একটা গুছিয়ে বলতে পারেন না। তাও জানালেন, এখন যেখানে সাভারের মিলিটারি ফার্ম, সেখানে আগে তারা থাকতেন। গ্রামের থেকে দুধ সংগ্রহ করে বিক্রিই ছিল তার পেশা। সেই সময় সাভারের বাজারে ঘোষদের কাছে গরুর খাঁটি দুধ বিক্রি করতেন। তবে তার বাপ-চাচারা কৃষিকাজই করতেন।
"আর এখন যে জায়গায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, তখন সে জায়গায় বিশাল জঙ্গল ছিল। গরু চড়াতে যেতাম আমরা সেইখানে। তবে এরপরে '৬৪ সালের দিকে সরকার আমাদের সেখানে থেকে সরিয়ে দেয়। এই রাজাশনে এসে থাকা শুরু করে আমাদের বাপ-চাচারা," জানালেন একর প্রতি এক হাজার টাকার মতো পেয়েছিলেন সরকার থেকে।
তরুণ বয়সে খাঁটি দুধ বিক্রি করেছেন প্রায় ১১ বছর। "কিন্তু ঘোষরা এক পর্যায়ে কম দামে নেওয়ার জন্য বলতে শুরু করলো, আমরা নাকি দুধে পানি মেশাই। এই ক্ষোভ থেকে দুধ বেচা ছেড়ে দেই। যেহেতু মিষ্টি বানানোর কাজটা ঘোষরাই করতেন, তাই অনেকটা জেদের বশেই শুরু করি মিষ্টি বানানো শেখার কাজ। কারিগরের কাজ করি বহুবছর। দুধ জ্বাল করা, ছানা করা, মিষ্টি তৈরি সবই শিখি। এরপর ১৯৯৩ বা '৯৭ সালের দিকে এই দোকান চালু করি, এখন আর মনে নাই কত সাল ছিল সেটা।"
"মিষ্টি আমি তৈরি করি যেভাবে শিখেছি সেভাবেই। এখন তো সবকিছুর দাম বাড়তি। লাকড়ি এককেজি আগে ছিল দেড়শ' টাকা, এখন হয়েছে ৩শ' টাকা। কিন্তু এরপরও যতটুকু সম্ভব হয়, ওইটুকু তৈরি করি। প্রতিদিন যাই কারিগরদের কাজ দেখতে, এটাও একটা কারণ। দুধে জ্বাল না হলে বা গড়মিল থাকলে মিষ্টির চেহারা দেখেই বুঝি। কোনো ভেজাল মেশাই না। ছেলেদেরও সেই শিক্ষা দিয়েছি। এইজন্যই হয়তো এখনও মানুষ এই মিষ্টি এতোটা পছন্দ করে।"
দিনে ১৫ হাজারের মতো আয় থাকে বলে জানালেন মফিজউদ্দিন। দুই ছেলে আর দুই নাতনি নিয়ে তার সংসার। "কোনোমতে এই মিষ্টি বেচেই দিন পার হয়ে যায়," মফিজউদ্দিনের।