দেশের প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে হিন্দি সিনেমা, চলচ্চিত্রাঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত বিষয় বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে বাণিজ্যিকভাবে হিন্দি সিনেমা প্রদর্শন। স্বাধীনতার পর থেকে নানা সময়ে হিন্দি সিনেমা বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শনের চেষ্টা করেছে অনেকেই। কিন্তু সরকারী বিধিনিষেধ এবং নির্দিষ্ট কয়েকটি গোষ্ঠীর আপত্তির কারণে এতদিন হিন্দি সিনেমা এদেশে প্রদর্শনের বিষয়টি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।
দেশে বাণিজ্যিকভাবে ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনের বিষয়টি নিয়ে দেশীয় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই সোচ্চার ছিলেন। ২০১৫ সালে তৎকালীন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি শাকিব খান কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে সহকর্মীদের নিয়ে মিছিলও করেছিলেন একাধিকবার। তাদের আন্দোলন সত্ত্বেও সেসময় সালমান খান অভিনীত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র 'ওয়ান্টেড' আমদানি করে গুটিকয়েক হলে প্রদর্শন করা হয়; কিন্তু দর্শকদের সাড়া ছিল কম। এরপরে প্রবল আপত্তি ও আন্দোলনের মুখে আর কোনো হিন্দি ছবি দেশে আনার উদ্যেগ নেওয়া হয়নি।
কিন্তু গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের অ্যাকশন কাট এন্টারটেইনমেন্টের পক্ষ থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত হিন্দি ছবি 'পাঠান' আমদানি করার জন্য আবেদন জানানোর পর আবারও হিন্দি ছবি দেশে প্রদর্শনের বিষয়টি সামনে চলে আসে। 'পাঠান' বাংলাদেশে প্রদর্শনের অনুমতি প্রদানের আগেই এ নিয়ে চলচ্চিত্রের ১৯টি সহযোগী সংগঠন যৌথভাবে মতামত দেয় এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য সরকারের কাছে সময় চায়।
১২ ফেব্রুয়ারি সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা এক বৈঠকের মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছান যে আগামী দুই বছরে ১৮টি হিন্দি সিনেমা দেশের প্রেক্ষাগৃহে বাণিজ্যিকভাবে চালানো যেতে পারে। তাদের স্বাক্ষর করা পত্র আজ (১৪ ফেব্রুয়ারি) তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বৈঠকে উপস্থিত একাধিক প্রতিনিধি।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, চলতি বছরে ১০টি এবং ২০২৪ সালে ৮টি হিন্দি ছবি আমদানি করে প্রদর্শন করা যাবে। পাশাপাশি, এসব ছবি মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তি না দেওয়ার শর্ত রাখা হয়েছে। এই দুই বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন সবাই।
হিন্দি সিনেমা প্রদর্শনের বিষয়ে ইন্ডাস্ট্রির জ্যেষ্ঠ পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, "আমি ঢালাওভাবে হিন্দি সিনেমা প্রদর্শনের পক্ষে নই। একটি নীতিমালা করে এই সিদ্ধান্তটি নিলে ভালো হতো। তাড়াহুড়ো করে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া ছয়টির বেশি হিন্দি সিনেমা বছরে প্রদর্শিত না হলেই ভালো হতো। সংখ্যা বেশি হলে তা আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তবে আমি বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখছি।"
চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি কাজী হায়াত, যিনি একসময় হিন্দি ছবি আমদানির বিপক্ষে ছিলেন; তিনিও সাম্প্রতিক বৈঠকে হিন্দি ছবি আমদানির পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তবে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, "১৯ সংগঠন এ বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। একটা নিয়মের মধ্যে দিয়ে হিন্দি সিনেমা প্রদর্শন করলে এভাবে অসংখ্য সিনেমা হল বন্ধ হতো না। যেহেতু দেশে সিনেমা নির্মাণের সংখ্যাও কমে গেছে, তাই হল বাঁচানো জরুরি।"
এদিকে গত এক যুগ ধরে দেশের প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছেন চিত্রনায়ক ও শিল্পী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান। তিনি বলেন, "আমি সব সময়ই আমাদের দেশের শিল্পীদের স্বার্থ আগে দেখি। হিন্দি সিনেমা প্রদর্শন করা শুরু হলে দেশীয় প্রযোজকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন নতুন সিনেমা নির্মাণে। তাতে আমরা শিল্পীরা কর্মহীন হয়ে পড়ব। যেসব সংগঠন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের বেশিরভাগেরই মেয়াদোত্তীর্ণ। তাই তারা বৈঠকে বসার নৈতিক যোগ্যতা হারিয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটিকেই হাস্যকর মনে হচ্ছে আমার কাছে।"
তবে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নেতা, চিত্রনায়ক রিয়াজ হিন্দি সিনেমা প্রদর্শনের পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি বলেন, "দেশে এখন মাত্র ৬০টির মতো প্রেক্ষাগৃহ সচল আছে। মধুমিতার মতো আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ দর্শক খরায় বন্ধ হয়ে আছে। আমি মনে করছি সিনেমা হল বাঁচানোর সর্বশেষ উদ্যোগ এটি। দর্শক বিষয়টিকে কিভাবে নেবেন, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এই উদ্যোগটিকে আমি সময়োপযোগী বলে মনে করি।"
শুধু হল মালিকেরাই নন, চলচ্চিত্রাঙ্গনের মানুষদের পাশাপাশি দর্শকরাও আগ্রহী হয়ে অপেক্ষা করছেন বড় পর্দায় হিন্দি সিনেমা দেখার জন্য। প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের উপস্থিতিই বলে দেবে হিন্দি ছবি প্রদর্শনের সিদ্ধান্তটি দেশের জন্য ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক।