যেভাবে অবসরে যাওয়া এক বোয়িং ৭৩৭ বিমান হয়ে গেল বিলাসবহুল ভিলা!
যাত্রী পরিষেবা থেকে অব্যহতির পর একটি বিমান অনেক রকম কাজেই ব্যবহৃত হতে পারে। অন্য কোনো এয়ারলাইনের জন্য নতুন রূপে সজ্জিত হয়ে আকাশে ফিরে যাওয়া থেকে শুরু করে যন্ত্রাংশ পুনর্ব্যবহার কিংবা একেবারেই এয়ারক্রাফট বোনইয়ার্ডে পড়ে থাকার সম্ভাবনাও থাকে। কোনো কোনো অব্যবহৃত বিমান আবার রেস্টুরেন্ট, জাদুঘর, এমনকি পার্টি করার ভেন্যু হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার কথাও শোনা গেছে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার বালি প্রদেশের ন্যাং-ন্যাং সমুদ্রসৈকতের পাশে একটি পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিলাসবহুল ব্যক্তিগত ভিলাকে এখন পর্যন্ত বিমানের সবচেয়ে সুন্দর 'রূপান্তর' বললে ভুল হবে না!
একসময় মান্ডালা এয়ারলাইন্সের (যা বর্তমানে বিলুপ্ত) অন্তর্ভুক্ত এই বোয়িং ৭৩৭ বিমানটি ২০২১ সালে কিনে নিয়েছিলেন ডেভলপার ফেলিক্স ডেমিন এবং তিনি এটিকে বালির দূরবর্তী একটি অঞ্চলে নিয়ে আসেন।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দেড়শো মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই 'বিমান ভিলা'র ভেতরে আধুনিক বিলাসব্যসনের কোনো কমতি রাখা হয়নি। বিমানের ভেতরে রয়েছে দুটি বেডরুম, দুটি বাথরুম, রান্নাঘর, একটি সুইমিং পুল এবং এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবস্থা।
যেভাবে বিমান হয়ে গেল বিলাসবহুল ভিলা
হোটেল চেইন বাবল বালি হোটেলের মালিক ফেলিক্স ডেমিন জানান, শুরুতে তিনি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য একটি বিমানই কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার মাথায় নতুন বুদ্ধি আসে; ভেবে দেখেন যে বিমানকেও এমন একটি চমৎকার-বিলাসবহুল বাড়িতে রূপ দেওয়া যায় যা আগে কেউ দেখেনি!
"এই বোয়িং বিমানটি কেনার আগেও আমি এটিকে অদ্বিতীয় কোনো একটা বস্তুতে রূপ দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম; এরপরে এটিকে বাড়িই বানিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম", বলেন ডেমিন। তিনি আরও জানান, অব্যবহৃত বিমানের খোঁজ করার সময় শুধুমাত্র ইন্দোনেশিয়াতেই তিনি ২০টিরও বেশি এ ধরনের বিমানের সন্ধান পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত বোয়িং ৭৩৭ বিমানটি তার মনে ধরে। জানা যায়, ইন্দোনেশিয়ার এক বিনিয়োগকারী বিমানটিকে দেশে নিয়ে এসেছিলেন।
কিন্তু এত বড় একটি বিমানকে কয়েক মাইল দূরে এই পাহাড়ের উপরে নিয়ে আসা সহজ ছিল না। "বোয়িং টিমের সাথে কথা বলে আমরা বিমানটির বিভিন্ন অংশ ভেঙে ভেঙে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেই। এর জন্যে আমাদেরকে প্রায় ৫০,০০০ নাট-বল্টু খুলতে হয়েছিল", বলেন ডেমিন।
গত আট বছর ধরে বালিতে বসবাসরত ডেমিনের ভাষ্যমতে, বিমানটি নিয়ে আসা এবং এটিকে বাড়িতে রূপ দেওয়ার জন্য প্রায় দুই মাসব্যাপী পরিকল্পনা করেছেন তিনি। বিমানটিকে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে আসতে দুটি ক্রেন, একটি বিশাল প্ল্যাটফর্মসহ প্রয়োজন হয়েছিল একাধিক বিশেষজ্ঞ ও একজন পুলিশ এসকর্টের। সব মিলিয়ে বিমানটি নিয়ে আসতে ৫ দিন সময় লেগেছিল তাদের।
ডেমিন জানান, "এই পাঁচদিন আমার জীবনের সবচেয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি, কারণ বিমান বয়ে নিয়ে আসার বেশিরভাগ কাজই হয়েছে রাতের বেলা।"
অনিশ্চিত অবস্থান
"বিষয়টা হলো, বালির রাস্তাগুলো খুবই সংকীর্ণ এবং এখানে অনেক নিচ দিয়ে নানারকম তার ঝুলে থাকে। আমাদের টিমে একদল লোক ছিল যারা বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এই তারগুলোকে উঁচুতে উঠিয়ে দিয়েছিল, যাতে করে বিমানটি নিয়ে আসার সময় এর সাথে তারগুলো জড়িয়ে না যায়", বলেন ডেমিন।
অবশেষে বিমানটি বালির সর্বদক্ষিণ উপকূলে নিয়ে এসে পুনঃসমাবিষ্ট করার পর তিনি নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিমানের ইন্টেরিয়রের দিকে মনোযোগ দেন। ডেমিন তার স্বপ্নে যেভাবে বিমানের ইন্টেরিয়র সাজানোর কথা ভেবেছিলেন, সেটিকে বাস্তবে রূপ দিতে চেষ্টার কোনো কমতি রাখেননি তিনি।
"আমি চেয়েছিলাম এই অসাধারণ ও অদ্বিতীয় জায়গাটায় পা রেখেই যেন মানুষ সেই 'ওয়াও ইফেক্ট'টা বুঝতে পারে", বলেন ডেমিন।
বিমানে একটি সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে ভেতর-বাড়ির প্রধান প্রবেশপথে পৌঁছান যায়। আর বিমানের ভেতরের লিভিংরুমের সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া হয়েছে একটি বার; আরও আছে একটি সোফা বেড ও গ্লাস পোর্টাল। কিছুদূর এগোলেই পাওয়া যাবে দুটি বেডরুম। অন্যদিকে, বিমানের ককপিটকে বড় একটি বাথরুমে রূপান্তর করা হয়েছে...সেই সঙ্গে রাখা হয়েছে বাড়তি পোর্টহোল। এছাড়াও, এই বিমান-ভিলাতে আছে সান লাউঞ্জার, আউটডোর লাউঞ্জ এরিয়া এবং ফায়ারপিট।
ডেমিন জানান, "এই সবকিছুই করা হয়েছে শুধুমাত্র আসল পরিকল্পনাকে একদম বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য।"
সোশ্যাল মিডিয়া সেনসেশান
ফেলিক্স ডেমিনের এই অভিনব প্রকল্প জনসমক্ষে আসার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে; যার ফলে ভিলার ভেতরে কিছু অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডও ঘটেছে।
ডেমিন বলেন, "একদিন আমি এখানে এসে দেখি সুরক্ষাবেষ্টনী ভাঙা এবং প্রায় দেড়শো মানুষ আমাদের বিমানের ভেতরে বসে আছে!" এমনকি এক প্যারাগ্লাইডার বিমানের পাখা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন বলেও জানান তিনি।
তবে নিজের স্বপ্নের প্রজেক্ট সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে ডেমিন আরও জানান, তার এই বিমান ভিলাকে অসংখ্য নিরাপত্তা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সেই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের অনেকের বিমানের পাখার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কিংবা বিমানের দরজা থেকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকার ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর প্রজেক্টটিকে বাঁকা চোখে দেখেছেন কেউ কেউ।
ডেমিন আরও ব্যাখ্যা করে জানান, নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্যেই পাথরের ওপর একটি সুরক্ষা বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের চূড়ার ওপর থাকা বিমানের পাখাতে কাচের সুরক্ষা বেষ্টনী লাগানোর জন্য মানুষ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। কারণ সবাই এই কাজটি করতে ভয় পাচ্ছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে ডেমিন নিজেও চিন্তিত।
তিনি বলেন, "আমাদের কিছু সমস্যা এখনও রয়ে গেছে, বিশেষ করে বিমানের পাখা নিয়ে। কিন্তু তবুও আমরা সাহসী কাউকে খুঁজে পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে সুরক্ষা বেষ্টনী বসাবোই।"
কয়েক বছর টানা এই প্রজেক্টটি নিয়ে কাজ করার পর অবশেষে নিজের 'বিমান বাড়ি'তে অতিথিদের স্বাগতম জানাতে প্রস্তুত ফেলিক্স ডেমিন। চলতি বছরের এপ্রিলেই এটি ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়ার কথা রয়েছে। বিলাসবহুল এই বিমান ভিলাতে রুম ভাড়া শুরু হবে এক রাতে ৭০০০ ডলার থেকে। 'প্রাইভেট জেট ভিলা বাই হ্যাংগিং গার্ডেনস এয়ার' নাম দেওয়া হয়েছে এই ভিলার।
বছরখানেক আগে যুক্তরাজ্যের কটসওলড বিমানবন্দরে পড়ে থাকা একটি অব্যবহৃত বিমানকে নতুন রূপে সাজিয়ে বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। অন্যদিকে, ২০০৯ সালে সুইডেনের অরলান্ডা বিমানবন্দরের কাছে একটি অব্যবহৃত বোয়িং ৭৪৭ বিমানকে 'জাম্বো স্টে হোটেল' নামক একটি হোস্টেল বা হোটেলে রূপান্তর করা হয়েছে।
সূত্র: সিএনএন