করোনা বিপর্যয় ঠেকাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে একশনএইডের একগুচ্ছ সুপারিশ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চলমান লকডাউনে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ায় বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশ
শুক্রবার প্রতিষ্ঠানটির কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির কর্তৃক পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ পরামর্শের কথা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানায়, বর্তমান পরিস্থিতে এই সকল জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সে বিষয়ে 'বাস্তব অবস্থা' এবং কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে তারা।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, "করোনার প্রাদুর্ভাবে শুধুমাত্র মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মৃত্যুবরণ করছে তা নয়, এর কারণে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। গ্রামের মানুষের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এখনই এটা নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরি।"
"সরকার ইতিমধ্যে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, করোনা সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ডাক্তার, স্বাস্থ্য সেবিকা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, পোশাক শ্রমিক, কৃষিখাত ও ডাক্তারদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা নিয়েছেন। তথাপি এর সংক্রমণ কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় সীমাবদ্ধ না। এর ব্যাপক প্রভাব প্রত্যন্ত অঞ্চল যেমন চর, হাওর, পাহাড় প্রভৃতি অঞ্চলেও এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। একইভাবে দলিত জনগোষ্ঠী, মৎস্যজীবী, ধোপা, নাপিত, চা শ্রমিক, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষও একইরকম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।"
এমতাবস্থায় সমস্যার যে ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে তা মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক শক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা দরকার মন্তব্য করে সেই প্রেক্ষাপটে তৃণমূল পর্যায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে একশনএইড বাংলাদেশ।
পর্যবেক্ষণে তারা বলে, "পরিবহন লকডাউন এবং আঞ্চলিক লকডাউনের কারণে পণ্যের বাজার সংকুচিত হয়েছে, কৃষক তার উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে পারছেন না, আবার উপকরণ সরবরাহে অপ্রতুলতায় আগামী উৎপাদন কমে আসার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যা আগামী দিনে দুর্ভিক্ষ পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। তাই লকডাউন কার্যকর করার পাশপাশি যে বিষয়সমূহ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন তা হলো মানুষের ক্ষুধা, জীবন যাপনের দৈনিন্দন অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলোর নিশ্চয়তার বিধান করা।"
সেখানে বলা হয়, "তা না করে লকডাউন করে মানুষকে বাড়িতে রাখা সম্ভব হবে না। লকডাউনের মেয়াদ ইতিমধ্যে মাসাধিককাল অতিক্রম করেছে। এমতবস্থায় শহর ও গ্রামাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে যারা বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে দিনমজুরের কাজ করে, রিক্সা চালায়, ইটভাটায় কাজ করে, রাজমিস্ত্রি ও যোগালীর কাজ, বদলী শ্রমিক, পেশাক শ্রমিক এবং ড্রাইভারসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বহুমুখি কাজের সাথে যুক্ত তারা বেকার বসে আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দিনমজুর এই জনগোষ্ঠীর জীবনে নেমে এসেছে এক চরম বিপর্যয়। বিপর্যয়ের মধ্যে আছে দলিত জনগোষ্ঠী, মৎস্যজীবী, ধোপা, নাপিত, চা শ্রমিক, তৃতীয়লিঙ্গের মানুষ, আদিবাসী এবং বস্তিবাসীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তাদের পরিবারে দেখা দিয়েছে নিদারুণ খাদ্য সংকট। দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য তাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।"
গণমাধ্যমে পাঠানো এই বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানায়, লকডাউনের কারণে আগের তুলনায় দেশে নারীর প্রতি নিপীড়ন বেড়ে গেছে।
"এই সময় নিজ গৃহে নারী ও কন্যাশিশু বেশি সুরক্ষিত থাকার কথা থাকলেও আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সারাদেশে নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলেছে। এই অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হয়েও অনেক ভুক্তভোগী ঘরের বাইরে যেতে না পারায় থানায়ও অভিযোগ করতে পারছেন না।"
সেখানে আরও বলা হয়, "করোনা যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য চিকিৎসাখাতের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধে মানুষের ইউমিউনিটি সিস্টেম সচল রাখার জন্য খাদ্য প্রবাহ ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু লকডাউন চলার কারণে বোরো ধান কাটা, ঘরে তোলা, চাতালে আনা এবং সরকারি গুদাম পর্যন্ত নিয়ে আসার ক্ষেত্রে চরম সংকট দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে সরকার কিছু কিছু এলাকায় ধান কাটার জন্য শ্রমিক সরবরাহের জন্য যে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে তা অন্যান্য এলাকায় বিস্তৃত করা প্রয়োজন।"
একশনএইড বলছে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে তারা কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরছে। সুপারিশগুলো হলো-
১. জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমিউনিটি রেডিও, টেলিভিশনসহ অন্যান্য গণমাধ্যমকে সঠিক তথ্য সরবরাহে আরো বেশি কাজে লাগাতে হবে, যাতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা দূর হয় এবং আতঙ্ক বিরাজ না করে।
২. সকল জেলার হাসপাতালে করোনা সনাক্তকরণ কীট সরবরাহ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং চর, হাওর, পাহাড় ও বস্তিসহ ভৌগোলিক অঞ্চল বিবেচনায় নিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতা নিশ্চিত করা। তাদের জন্য মাস্ক, সাবান এবং স্যানিটাইজার ইত্যাদির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
৩. করোনা পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে গ্রামসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বাজার ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানো। সেক্ষেত্রে এলাকায় অবস্থিত খোলা মাঠে নির্দিষ্ট দিনে পরিমিত দূরত্ব বজায় রেখে কেনাবেচার ব্যবস্থা করা।
৪. কৃষিপণ্য, দুধ, ডিম ও মাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পরিবহণ, বাজারজাতকরণ ও গুদামজাতকরণের পাশাপাশি পণ্য বিনিময় এবং ত্রাণের তালিকায় এ সমস্ত পণ্য সংযুক্ত করা।
৫. শহর ও গ্রামাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে নারী শ্রমিক যারা বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে দিনমজুরের কাজ করে, রিক্সা চালায়, ইটভাটায় কাজ করে, রাজমিস্ত্রি ও যোগালীর কাজ, বদলী শ্রমিক, পেশাক শ্রমিক, ড্রাইভারসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বহুমুখি কাজের সাথে যারা যুক্ত এবং দলিত জনগোষ্ঠী, মৎস্যজীবী, ধোপা, নাপিত, চা শ্রমিক প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর জন্য কমপক্ষে দুই সপ্তাহের খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিতে হবে। যাতে করে তাদের চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি কার্যকর করতে সক্ষম হয়।
৬. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে করোনা যুদ্ধে নিয়োজিত যুব সমাজকে সুরক্ষায় অনলাইনে সঠিক দিক-নির্দেশনা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং নিরাপত্তা সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
৭. স্থানীয় পর্যায়ে ত্রাণ বিতরণ প্রক্রিয়ায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।
৮. নারী-শিশু নির্যাতন রোধে প্রশাসনিক দায়িত্ব জোরদার করতে হবে। অনলাইনভিত্তিক সহায়তা এবং রেফারেল সার্ভিসসমূহ কার্যকর রাখা। সরকারি সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে নারীপ্রধান পরিবারসমূহকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনায় নেয়া।
৯. আসন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা।