তিনবার গ্র্যামি জয়ের পর এখন নিজ দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন ভারতীয় রিকি কেজ
এই মাসের শুরুর দিকে মিউজিশিয়ান রিকি কেজ প্রথম ভারতীয় হিসেবে তিনটি গ্র্যামি জিতে নেন। তবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজেদের দেশেই তেমন পরিচিত নন।
ধোপদুরস্ত পোশাক পরা সল্ট-পিপার দাঁড়ি আর লম্বা চুলের কেজ নিজেই একজন গ্ল্যামার আইকন। যারা তাকে কাছ থেকে চেনেন তারা নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন কেজ পার্টি করতে পছন্দ করেন, আর কেজও সে ব্যাপারে একমত। ৪১ বছর বয়সী এই মিউজিশিয়ানের দন্তচিকিৎসার ওপর একটি ডিগ্রি রয়েছে। একইসাথে তিনি একজন পরিবেশ আন্দোলনকারীও বটে, কাজ করেছেন ইউনিসেফ, ইউনেস্কোসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে।
তবে অসাধারণ নিজস্ব সুরের স্টাইলসহ নানা ধরনের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তিনি একজন দক্ষ ডেন্টিস্টও। কেজের মতে তিনি এমন একজন মিউজিশিয়ান যিনি তার কাজের মাধ্যমে পৃথিবীতে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে চান।
"মিউজিক আর পরিবেশ হলো দুটি খুঁটি যেটি আমার জীবনকে সংজ্ঞায়িত করেছে। আর আমার প্রথম গ্র্যামি জেতার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আমার জীবন এবং মিউজিককে বিলিয়ে দেব পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য, আমার এই দুটো আবেগকে একসাথে ব্লেন্ড করে।"
২০১৫ সালে কেজ তার প্রথম গ্র্যামি জেতেন 'উইন্ডস অফ সামসারা' অ্যালবামটির জন্য। সেবারই তিনি সবচেয়ে কম বয়সী ভারতীয় হিসেবে গ্র্যামি জিতে নেন। দক্ষিণ আফ্রিকান বাঁশিবাদক উটার কেলারম্যানের সাথে রচনা করা এই অ্যালবামটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস বিলবোর্ডের নিউ এজ অ্যালবামের এক নম্বরে উঠে যায়।
সাত বছর পর কেজ তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্র্যামি জিতে নেন 'ডিভাইন টাইডস' অ্যালবামের জন্য, যেটি তিনি ব্রিটিশ ব্যান্ড দু পুলিশের ড্রামার স্টুয়ার্ট কোপল্যান্ডের সাথে করেছেন। ২০২২ সালের সেরা নিউ এজ অ্যালবাম এবং সেরা ইমারসিভ অডিও অ্যালবামের খেতাব জিতে নেয় কেজ-কোপল্যান্ডের অ্যালবামটি। অ্যালবামটি হারিয়ে দেয় ক্রিস্টিনা অ্যাগিলেরা এবং দ্য চেইনস্মোকার্সের মতো হেভিওয়েট প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে। সারা বিশ্বের সংগীতপ্রেমীদের কাছ থেকেও প্রশংসা কুড়িয়ে নেয় এটি।
আন্তর্জাতিক সংগীত মহলে পরিচিতি পেলেও কেজ আর তার মিউজিক তার নিজের দেশেই তেমন পরিচিতি পায়নি। এর সাথে একমত কেজ নিজেও: "আমার মিউজিক শ্রোতাদের মধ্যে ভারতীয়দের তুলনায় পশ্চিমা শ্রোতারাই বেশি। তবে শেষ কয়েক বছরে এই ধারার পরিবর্তন হয়েছে বলে আমার মনে হয়।"
ভারতীয় সংগীতকে নতুনভাবে তুলে ধরার কারণে সমালোচকদের কাছেও তিনি জনপ্রিয়। তবে অনেক সংগীতপ্রেমীদের কাছে তিনি একেবারেই পরিচিত নন। গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জেতার আগ পর্যন্ত তারা কখনো রিকি কেজের নাম শোনেননি।
ভারতীয় মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে বলিউডের দাপটের কারণে তার জঁরার সংগীত তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি বলেই জানান তিনি।
"এটি প্রধান কারণ যে আমি আমার ক্যারিয়ার মূলত বাইরের দেশগুলোকে কেন্দ্র করে সাজিয়েছি। পশ্চিমা দেশগুলোর লেবেলের মাধ্যমে আমার মিউজিক প্রকাশ করারও কারন এটি। কারণ আমি দেখেছি এটাই আমার জন্য সফল হওয়ার একমাত্র পথ।"
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনায় জন্ম নেওয়া কেজ বেড়ে উঠেছিলেন ডাক্তারপ্রধান পরিবারে। তবে আট বছর বয়সে তিনি ব্যাঙ্গালোরে ফিরে আসেন এবং তারপর থেকে এই শহরেই কাটিয়েছেন।
কেজের মতে, তিনি সবসময়েই হৃদয় থেকে একজন মিউজিশিয়ান ছিলেন, তবে তার বাবা-মার বিশাল রেকর্ডের সংগ্রহ, যার মধ্যে সব ধরনের জঁরার বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন সংস্কৃতির গান রয়েছে, তাকে পেশাদার মিউজিশিয়ান হিসেবে ক্যারিয়ার গঠনে প্রভাবিত করে।
"যখন আমার বন্ধুরা ভিডিও গেম খেলতে পছন্দ করতো, তখন আমি এই রেকর্ডগুলো শুনতাম, সেগুলোর লাইনার নোটগুলো পড়তাম, জানার চেষ্টা করতাম এই রেকর্ডের গায়করা কারা কিংবা কোন ধরনের বাদ্যযন্ত্র তারা ব্যবহার করেছেন।"
২০ বছর বয়সেই কেজ সিধদান্ত নেন তিনি সংগীতকেই পেশা হিসেবে বেছে নেবেন। এই সিদ্ধান্তে তার পরিবার রেগে গেলেও তিনি তার সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন।
দুই দশক পর অসাধারণ সব মিউজিক রচনা করার সাথে সাথে কয়েক শত কনসার্টে অংশগ্রহণ আর কয়েক মিলিয়ন ভক্ত তৈরি করেছেন কেজ। একইসাথে তার কাজগুলর জন্য তার সংগীত জগতের নায়ক পিটার গ্যাব্রিয়েল, সেনেগালিজ কিংবদন্তী বাবা মাল আর পপতারকা ব্রুনো মার্সের সাথেও কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
কেজের কেজগুলো মূলত অ্যাম্বিয়েন্ট মিউজিক জঁরার অন্তর্গত। সারাদিন পরিশ্রমের পর এই মিউজিকগুলো নিশ্চিতভাবেই মনে শান্তি যোগাবে। তবে কেজের কাছে ব্যক্তিগতভাবে এই মিউজিকগুলো মূলত সমাজের সমস্যাগুলোকে তুলে ধরে।
"আমি যে মিউজিকগুলো তৈরি করি তার সবগুলোই পরিবেশ রক্ষা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং শরণার্থী সমস্যা, ভূমি অবক্ষয়, যুদ্ধ, প্রাণী সংরক্ষণের মতো সামাজিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতনতার উদ্দেশ্যে তৈরি," বলে জানান কেজ।
নিজের মিউজিক ভিডিওগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পছন্দ করেন তিনি।
উদাহরণস্বরূপ 'ডিভাইন টাইডস'-এর কথাই বলা যায়। পুরো অ্যালবামজুড়েই ভারতসহ পৃথিবীর নানা জায়গার প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্যকে ফোকাস করা হয়েছে। তামিলনাড়ু থেকে শুরু করে ওয়েস্টার্ন ঘাঁট, উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কিছু অঞ্চল, থর মরুভূমি, এমনকি লস অ্যাঞ্জেলেস এবং স্পেনেও শ্যুট করা হয়েছে অ্যালবামটির জন্য।
অ্যালবামটির 'হিমালয়' ট্র্যাকটির ভিডিও মূলত হিমালয় পর্বতমালাকে উৎসর্গ করে তৈরি করা হয়েছে। ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় এর শ্যুট করা হয়। হিমালয়ের অসাধারণ পার্বত্য পরিবেশের সাথে কেজের মিউজিক এক অপার্থিব জগতে শ্রোতাদেরকে নিয়ে যায়।
কেজের বার্তাও এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ: প্রকৃতি অসাধারণ সুন্দর, কিন্তু প্রকৃতি অপরিসীম নয় এবং একে সম্মান করা উচিৎ। সেতারের সুরের সাথে সংগীতের রাগ রচনাগুলো নিখুঁতভাবে মিলে যায়।
যদিও প্রকৃতি এবং ক্ল্যাসিকাল ভারতীয় মিউজিক থেকেই কেজ তার গানের মূল অনুপ্রেরণা খুঁজে পান, তারপরেও তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার মিউজিক নিজের মিউজিকে ব্যবহার করতে চান। তিনি নেটিভ আমেরিকান বাঁশিবাদক, তিব্বতের সাধু, গেইলিক, হিব্রু এবং দক্ষিণ আফ্রিকান গায়কদল, তুরস্ক, সেনেগাল, আজারবাইজানের মিউজিশিয়ান, জাপানের কোটো বাদকসহ নানা দেশের লোকদেরকে নিয়ে কাজ করেছেন।
"এটা এক অসাধারণ অনুভূতি। বিভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর মানুষদেরকে মিউজিকের সার্বজনীন ভাষার নিচে একত্রিত করা।"
কেজের কাছে এই হাইব্রিডিজম পরিবেশ সংরক্ষণের মতোই অনুভূত হয়। আধুনিক এবং প্রাচীন মিউজিককে আলাদা করে রাখার মাঝখানে কোনো কৃতিত্ব নেই বলে মনে করেন তিনি।
তবে তার মিউজিক কসমোপলিটন বানানোর এই বিশাল প্রজেক্টকে অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না। ভারতীয় শ্রোতাদের কাছে কেজ যে ধরনের মিউজিক তৈরি করেন তা অনেক আগেই তার যৌবন হারিয়ে ফেলেছে। আবার অনেকের কাছে তার মিউজিক একটু বেশিই 'অ্যামবিয়েন্ট'। যে কারণে এটি ব্যকাওগ্রাউন্ড মিউজিক কিংবা পড়াশোনার সময় কানে বাজার হিসেবে ঠিক থাকলেও সক্রিয় শ্রোতা হিসেবে বারবার শোনার মতো নয়।
তবে সবাই কেজের মিউজিক নিয়ে এতটা নিরাশাবাদী নন। তার মিউজিক বেশ প্রশংসাও পেয়েছে। একজন শ্রোতার মতে, "আমি তার কাজের ধরন পছন্দ করি। কেজ তার মিউজিককে শেখার জন্য, বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য ব্যবহার করেন। তার গানের লিরিক্সগুলো প্রকৃতির মর্ম উপলব্ধি করতে বলে, প্রকৃতির প্রতি মানূষের ব্যক্তিগত ভাবনায় পরিবর্তন আনার কথা বলে। তার সুরও খুবই প্রশান্তিদায়ক।"
কেজের কাছে মিউজিক ব্যক্তিগত আবেগ এবং তিনি তার মিউজিকের মাধ্যমে পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে তোলার ব্যাপারে আশাবাদী।
ভারতে স্বাধীন মিউজিশিয়ানদের জনপ্র্যতা বাড়ার সাথে সাথে কেজও নতুন নতুন শ্রোতা পেয়েছেন। "গত বছর আমি ভারতজুড়ে ৪০টি কনসার্ট করেছি যেখানে স্টেডিয়ামগুলো লোকভর্তি ছিল। অনেকগুলো মিউজিক ফেস্টিভালেও আমাকে প্রধান আকর্ষণ হিসেবে রাখা হয়েছিল। তো মাআর মনে হয়, ভারত আমাকে গ্রহণ করে নিয়েছে।"
"তবে আমার তৃতীয় গ্র্যামির ফলে হয়তো আরও কিছু ভারতীয় শ্রোতা আমার মিউজিক শোয়ান শুরু করবেন," বলে হেসে জানান রিকি কেজ।
সূত্র: বিবিসি