দাম নিয়ন্ত্রণে চাল, ডিম ও মুরগিকে ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য’ তালিকায় যুক্ত করতে চায় সরকার
ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে 'অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন' এর অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্যের তালিকা সম্প্রসারণ করতে চায় সরকার। ছয় দশক পুরোনো এই আইনটি যুগোপযুগী করার প্রচেষ্টায় আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ার পর- এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, নতুন তালিকায়- সুপেয় পানি, চাল, আটা, পোলট্রি, দুধ ও ডিম, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, টুথপেস্ট, আলু, গম, ধান, কালো জিরা, চিড়া, মুড়ি ও তরল কীটনাশকসহ বিভিন্ন পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
অন্যদিকে সিগারেট, লবঙ্গ, তেজপাতা, এলাচ ও দারুচিনিকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে।
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই), বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি), কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরো বিভিন্ন পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্টসহ বিভিন্ন ধরণের তরল কীটনাশকের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে। সরকারও দীর্ঘদিন ধরে বাজারের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চাইছে– যা অস্থিতিশীল রয়েছে গত বছরের মার্চ থেকেই।
আইন অনুযায়ী, অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় থাকা পণ্যদ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার পদক্ষেপ নিতে পারে এবং বাজারে যারা কারসাজি করে দাম বাড়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, 'প্রায় এক বছর আগে আইনটি সংশোধনে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু পরিকল্পনা অনুসারে কাজ এগোয়নি। তবে এ আইনের আওতায় থাকা অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা সংশোধন করা হচ্ছে। এতে কিছু নতুন পণ্য যুক্ত হবে'।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন- ১৯৫৬ সালে প্রণীত হয়; এর আওতায় সরকার অত্যাবশ্যকীয় বিভিন্ন নিত্যপণ্যের উৎপাদন, বিপণন এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে।
এসব পণ্য যাতে নিম্ন আয়ের মানুষসহ সব শ্রেণির ভোক্তারা ন্যায্যমূল্য কিনতে পারেন– তা নিশ্চিত করাই এ আইনের উদ্দেশ্য।
এ আইনের প্রয়োগ করতে সরকার বিশেষ ভ্রাম্যমাণ আদালত স্থাপনের মাধ্যমে বাজার কারসাজি, মজুতদারি ও কালোবাজারির সাথে যুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।
দেশে দূর্যোগসহ যেকোন সংকটময় পরিস্থিতিতে যখন অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ বা মূল্য অস্থিতিশীল হয়, তখন প্রায়ই এ আইন প্রয়োগ করা হয়।
২০১৩ সালে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা সংশোধন করে এতে চিনি, লবন, পেঁয়াজ, ছোলা, জিরাসহ বিভিন্ন মসলা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে পাকিস্তান আমলে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সিগারেটসহ বিভিন্ন পণ্য, এখনও এ তালিকায় রয়ে গেছে।
মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ জরুরি পরিস্থিতিতে এ আইনের আওতায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য উৎপাদন বা বিপণন অব্যাহত রাখার সুযোগ রয়েছে। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকার সুবিধা কাজে লাগিয়ে, কোভিড-১৯ লকডাউনের সময় যখন সব ধরনের শিল্প কারখানা বন্ধ ছিল, তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আপত্তি সত্ত্বেও বৃটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোসহ সিগারেট প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে সিগারেটকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই পদক্ষেপ বহুল প্রত্যাশিত, কারণ দীর্ঘদিন ধরেই সিগারেটকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে তামাক-বিরোধী বিভিন্ন সংগঠন।
সংসদ সদস্য এবং পরিবেশ-বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে তামাক (বিড়ি-সিগারেট) বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন।
মহামারি চলাকালে ১৯৫৬ সালের আইনের সুযোগ নিয়ে যেভাবে তামাক কোম্পানিগুলো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে এবং প্রণোদনা তহবিল পেয়েছে – তা নিয়ে ২০২০ সালের নভেম্বরে এক অনুষ্ঠানে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি। তামাকজাত পণ্যের একটি বহুজাতিক সংস্থায় এখনও কেন সরকারের শেয়ার রয়েছে সে প্রশ্নও তোলেন সাবের হোসেন।
সাবেক বাণিজ্য সচিব ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর চেয়ারম্যান গোলাম রহমান টিবিএসকে বলেন, 'এই আইনের অ্যাসেন্সিয়াল কমোডিটির তালিকাটি মান্ধাতার আমলের। এটা বর্তমান সময়োপযোগী করে সংশোধন করা দরকার। তালিকায় নতুন পণ্য অন্তর্ভুক্ত করলেই- বাজারে সেটার দাম কমবে না। সেজন্য এসব পণ্যের ইন্ডিকেটিভ (নির্দেশক) মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে, বাজারে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ করার আইনগত কর্তৃত্ব সরকারের হাতে থাকা উচিত'।
এ তালিকা যদি বেশি বিস্তৃত করা হয়, তাহলে কিছু সমস্যা হতে পারে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
বাজারে চাল, আটা, ময়দা, ডিম, মুরগির মাংস ও টয়লেট্রিজ পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরির অভিযোগে গতবছর ১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।
সরকারের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা বিস্তৃত করার উদ্যোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য কোম্পানি– সিটি গ্রুপের কর্পোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা টিবিএসকে বলেন, 'রড ও সিমেন্টকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এখন আরো কিছু পণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করার আলোচনা চলছে। আমি আশা করি, সরকার একটি গভীর পর্যালোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে'।
'তবে যেসব পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করা হবে- তাদের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক আরোপ করা সঠিক কিনা- সে প্রশ্নটা আমি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তুলতে চাই। আশা করি, সরকার এদিকেও নজর দিবে। কোনটা যদি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হয়, তাহলে এর ওপর কোনো আমদানি শুল্কও থাকা উচিত নয়'- যোগ করেন বিশ্বজিৎ।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলো এসব অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নিজেদের ইচ্ছামতো নির্ধারণ করে বিপণন করছে। এমআরপি রেটে বিক্রি হওয়ায় আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিংবা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও এক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না।
বাজারমূল্যের অস্থিতিশীলতা মোকাবিলায় এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি চাল, আটা, রড, সিমেন্টসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার ঘোষণা দিলেও, আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে আটকে যায় মন্ত্রণালয়।
তালিকা সংশোধনের সাথে যুক্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'অনেক সময় বাজারে কাঁচামরিচের কেজি ৪০০ টাকায় উঠে যায়। কিন্তু, অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় না থাকায় আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে ওই পরিস্থিতিতেও বাজারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকে না সরকারের। তাই কাঁচামরিচকে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়'।
ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় কাজ করা ক্যাব আইনের নাম সংশোধন করে অনলাইন সেবাসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা এতে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে।
ভারত ও পাকিস্তানের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা
১৯৭৭ সালে সর্বশেষ সংশোধন করা হয় পাকিস্তানের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা, এতে আজো রয়ে গেছে তামাক। সংশোধনের পর এতে পোলট্রি ফিডসহ ৪০টির বেশি পণ্য যুক্ত হয়েছে।
ভারত সরকার তাদের ১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন ২০২০ সালে সংশোধন করে পণ্য তালিকা সংক্ষিপ্ত করেছে। এতে এখন সার ও বীজসহ সাত ধরনের পণ্য রয়েছে।
এই পরিবর্তন ভোক্তাদের চেয়ে ব্যবসায়ীদেরই বেশি লাভবান করেছে এমন সমালোচনা থাকলেও, ভারত সরকার কৃষকদের আয়বৃদ্ধি এবং সহজে ব্যবসা করার সুবিধা বাড়াতে এ উদ্যোগ নেয়। কারণ ছয় দশক আগে যখন এই আইনটি পাস করা হয় তখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না ভারত।