কোথা হতে এলেম: ৮ বছরের ছেলে ও তার বাবার কথোপকথন
ছেলে: বাবা আমি কোত্থেকে আসলাম?
বাবা: তোমার মা নদীতে গোসল করতে গেছিল। দেখল একটি ভেলা ভেসে আসছে, সে ভেলায় ছিল ছোট্ট এক শিশু, সেটাই তুমি।
ছেলে: আচ্ছা বাবা, আম্মু কোত্থেকে আসল?
বাবা: তোমার নানু নদীতে গোসল করতে গিয়েছিল, একটা ভেলা ভেসে এল, সেখান থেকে তোমার আম্মু।
ছেলে: তার মানে আমার দাদি, দাদির আম্মু, নানু, নানুর আম্মু- তারাও সবাই নদীতে গোসল করতে গিয়েছিল।
বাবা: একদম ঠিক। এবার বুঝেছ তো?
ছেলে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, বুঝলাম, আমাদের বংশে বিয়েশাদি, নারী-পুরুষের দৈহিক মিলনের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদনের কোনো রীতি ছিল না।
একটি প্রচলিত কৌতুকমাত্র, তবে এমন প্রশ্ন অনেক শিশুই করে। উত্তরে কেউ বলে- ভেলা থেকে আনছে, আবার কেউ বলে কলাগাছ ফেটে বের হয়েছে। বাস্তবতা হলো- স্বভাবতই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কীভাবে এসেছি? আমাদের চারপাশের গাছপালা, নদী, পাহাড়, জীবজন্তু দেখেও মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, সবকিছু কি রেডিমেড কিংবা প্রি-ফেব্রিকেটেড এনে পৃথিবীর বুকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে? নাকি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে?
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, জীবজগৎ কীভাবে সৃষ্টি হলো, কীভাবে আমরা এলাম, এসব উত্তর বিভিন্ন ধর্মে ভিন্ন ভিন্নভাবে দেয়া আছে। আবার কেউ কেউ জীবজগৎকে পর্যবেক্ষণ করেছে, করেছে বিকল্প ভাবনা। প্রায় ২৬০০ বছর আগে গ্রিক দার্শনিক আনাক্সিমানদার এবং এমবেডোসেল জীবজন্তুর বিবর্তন নিয়ে প্রথম নিজেদের চিন্তাভাবনা তুলে ধরেন। এরপর রোমান কবি ও দার্শনিক লুক্রেটিয়াস আরও বিষদভাবে তার তত্ত্ব তুলে ধরেন 'De rerum natura (On the nature of things)' বইয়ে। তারা মনে করতেন, এক প্রজাতি বিবর্তিত হয়ে- আরেক প্রজাতির সৃষ্টি হতে পারে।
ঠিকরে পড়া দুটি চোখ
আল কিনানি নামে বসরার এক যুবা, খুব সম্ভবত মাছ বিক্রি করা ছিল তার পেশা। কিন্তু, অবসর সময়ে যেত বসরার মসজিদে, মন দিয়ে শুনত বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনা। এভাবে প্রায় দুই যুগ সে পার করে শিক্ষাগ্রহণে, অতঃপর নিজেই লিখে ফেলে একটি বই, খেলাফতের রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্বন্ধে, আর সেটাই তাকে দেয় নতুন জীবিকার সন্ধান। বসরা থেকে চলে আসে বাগদাদে।
কথিত আছে খলিফা আল-মামুন তাকে তার সন্তানদের পড়ানোর দায়িত্ব দেন। কিন্তু, তার ঠিকরে পড়া ফোলা চোখের জন্য নাকি তাদের পড়ানো হয়নি, বাচ্চারা তাকে দেখে ভয় পেত।
পড়ানোর চাকরি না পেলেও পেলেন একটি নতুন নাম, যা তাকে জগদ্বিখ্যাত করে দেয়। ইংরেজিতে যাকে বলে 'popped eye, bulged eye' বা ফোলা চোখ; দেখলে মনে হয় বেরিয়ে আসছে কোটর থেকে, এর থেকে নাম 'আল জাহিজ'।
আল জাহিজ বাগদাদের বুদ্ধিজীবী মহলে জায়গা করে নেন আয়েশে, লিখতে থাকেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক বই। ধারণা করা হয় অন্তত ২০০টির মতো বই লেখেন, কিন্তু মাত্র ডজনখানেক বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়। তার বিখ্যাত বই 'বুক অব অ্যানিমেলস'।
তিনি লেখেন, 'প্রাণীরা বেঁচে থাকার লড়াই, সম্পদ, এমনকি প্রজননের জন্য এবং শিকার হওয়া এড়াতে লড়াই করছে। তিনি বিবেচনা করেন, যে পরিবেশগত কারণগুলো প্রাণীদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে নতুন বৈশিষ্ট্য বিকাশে সহায়তা করে এবং এইভাবে তারা একটি অন্য প্রজাতিতে পরিণত হয়।
আল জাহিজ পর্যবেক্ষণ করেন, যে জীবিত প্রাণীরা তাদের সফল গুণাবলি তাদের সন্তানদের মধ্যে প্রেরণ করে।
বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে প্রাণীদের অবশ্যই এমন বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে, যা তাদের খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতা করতে, শিকার হওয়া এড়াতে এবং পুনরুৎপাদন করতে সহায়তা করে।
আল জাহিজ মূলত তিনটি প্রক্রিয়া সম্পর্কে লিখেছেন – অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম, একে অপরের মধ্যে প্রজাতির রূপান্তর এবং এর পেছনে পরিবেশগত কারণগুলো।
সহজভাবে বলতে গেলে চার্লস ডারউইনের 'ন্যাচারাল সিলেকশন', হার্বার্ট স্পেন্সারের 'সারভাইভাল অব ফিটেস্ট', উত্তরাধিকারের ধারণাসহ বিবর্তনের সমস্ত আধুনিক মতবাদ আল জাহিজ একইসাথে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন প্রায় হাজার বছর আগে।
ভূমিকা- দ্য ইন্ট্রোডাকশন
১৩৭৭ সালে মুসলিম ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক ইবনে খালদুন লেখেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'মুকাদ্দিমাহ' বা 'ইন্ট্রোডাকশন'। বইটি লেখেন, বিশ্ব ইতিহাস লেখার ভূমিকা হিসেবে। বইয়ে তিনি অর্থনীতি, রাজনীতি, ইসলামিক থিওলজি, ন্যাচারাল সায়েন্সসহ বহু বিষয়ের সাথে বিবর্তন এবং মানব সৃষ্টি প্রক্রিয়া নিয়েও লেখেন। তার মতে, জড় থেকে জীবের উৎপত্তি, ছোট প্রাণী থেকে বড় প্রাণী, সর্বশেষ বানরজাতীয় প্রাণী থেকে মানুষের বিবর্তন। যদিও তাকে বলা হয় 'Founding father of modern sociolog', কিন্তু বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিতত্ত্বের তাত্ত্বিক প্রণেতাও তাকে বলা যায়। ডারউইন বা তার পরের প্রজন্মের বিজ্ঞানীরা কেউ দাবি করেননি যে বানর থেকে মানুষ হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানীদের বক্তব্য 'কমন এনসেস্টর'। যদিও ইবন খালদুন বিবর্তনের বিস্তারিত বর্ণনা দেননি, তবে তিনিই বানরের সাথে যোগসূত্রের কথা উল্লেখ করেন।
'তারপর সৃষ্টিজগতের দিকে একবার নজর দেওয়া উচিত। এটি খনিজ থেকে শুরু হয়েছিল এবং একটি উদ্ভাবনী, ধীরে ধীরে উদ্ভিদ এবং প্রাণীতে অগ্রসর হয়েছিল। খনিজ পদার্থের শেষ পর্যায়টি উদ্ভিদের প্রথম পর্যায়ের সাথে যুক্ত, যেমন ভেষজ এবং বীজহীন উদ্ভিদ। উদ্ভিদের শেষ পর্যায় যেমন খেজুর এবং লতাগুল্ম, প্রাণীদের প্রথম পর্যায়ের সাথে যুক্ত, যেমন শামুক এবং শেলফিশ, যাদের কেবল স্পর্শ করার ক্ষমতা রয়েছে। এই সৃষ্ট জিনিসগুলোর ক্ষেত্রে "সংযোগ" শব্দের অর্থ হলো প্রতিটি গোষ্ঠীর শেষ পর্যায়টি নতুন গোষ্ঠীর প্রথম স্তরে পরিণত হওয়ার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। প্রাণীজগৎ তখন বিস্তৃত হয়, এর প্রজাতি অসংখ্য হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় এটি অবশেষে মানুষের দিকে নিয়ে যায়, যে চিন্তা করতে এবং প্রতিফলিত করতে সক্ষম। বানরের জগৎ থেকে মানুষের উচ্চ স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে বিচক্ষণতা এবং উপলব্ধি উভয়ই পাওয়া যায়, কিন্তু যা প্রকৃত প্রতিফলন ও চিন্তার পর্যায়ে পৌঁছেনি। এই মুহূর্তে আমরা মানুষের প্রথম পর্যায়ে আসি। এটি আমাদের (শারীরিক) পর্যবেক্ষণ যত দূর প্রসারিত।' মুকাদ্দিমাহ, অধ্যায়-১, (ইংরেজি: পাতা ১৩৭-১৩৮)
বিবর্তনবাদ এবং ডারউইনিজম
লুক্রেটিয়াসের প্রায় ১৪০০ বছর পরে বেশ কয়েকজন আরব দার্শনিক বিবর্তনতত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন, কিন্তু এদের মধ্যে আল-জাহিজ এবং ইবনে খালদুনের তত্ত্বই ছিল উল্লেখযোগ্য। ইবনে খালদুনের ৪০০ বছর পরে আবার একই সাথে বিবর্তন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন বেশ কয়েকজন। এদের মাঝে জন ব্যাপটিস্ট ল্যামার্কের 'Transmutation' ছিল বিখ্যাত যা ল্যামার্কিজম নামে পরিচিত ছিল। এরপরে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস এবং চার্লস ডারউইন একইসাথে বিবর্তনবাদ নিয়ে কাজ শুরু করেন স্বাধীনভাবে। ১৮৩১-১৮৩৬, পাঁচ বছর ডারউইন বিগল জাহাজে করে ঘুরে বেড়ান আমেরিকার উপকূল ও নিকটবর্তী দ্বীপগুলো, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন জীববৈচিত্র্য। পাঁচ বছরের নৌভ্রমণ এবং পরবর্তী গবেষণার ফসল হিসেবে ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তার বই 'On the Origin of Species by Means of Natural Selection, or the Preservation of Favored Races in the Struggle for Life.'
বইটি প্রকাশের পরপরই বিজ্ঞানী মহলে সারা ফেলে। ১৯৬০ সালে থমাস হেনরি হাক্সলে প্রথম 'Darwinism' শব্দটি ব্যবহার করেন অনেকটা বিবর্তনবাদের সমার্থক হিসেবে। এর আগে সবার কাছে ডারউইনিজম মানে ছিল ১৮ শতকের দার্শনিক 'Erasmus Darwin'-এর তত্ত্ব, যিনি ছিলেন চার্লস ডারউইনের দাদা। দাদার তত্ত্বও ছিল বিবর্তন নিয়ে, কিন্তু নাতির তত্ত্ব ছিল অনেক ব্যাপক, বিস্তৃত এবং পদ্ধতিগত। কেপ ভার্দে, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, ইকুয়েডর, গালেপোগাস দ্বীপপুঞ্জর মতো বৈচিত্র্যময় এলাকা ঘুরে ঘুরে অসংখ্য নমুনা সংগ্রহ, ছবি আঁকা, নিখুঁত বর্ণনা লিখে রাখার মতো এত ব্যাপক কাজ আগে কেউ করেনি। তাই বিবর্তনের ধারণাটি অনেকের কাছে আজগুবি মনে হলেও কাজের ব্যাপ্তি তৎকালীন বিজ্ঞান মহলকে প্রভাবিত করেছিল।
ইলেকশন-সিলেকশন: জোড় যার, মুল্লুক তার
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে 'ইলেকশন' শব্দটি বহুল ব্যবহৃত, প্রচলিত এবং আলোচিত। কয়েকজন ব্যক্তি একটি পদের জন্য আবেদন করে, জনগণ ভোট দেয়, সর্বোচ্চ ভোট যে পায়, সে নির্বাচিত হয়। আবার অনেক সময় ইলেকশন হয় না, হয় 'সিলেকশন'। যোগ্য কিছু লোকের তালিকা করা হয়, সেখান থেকে কয়েকজনকে বেছে নেয়া হয়, যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। জীবজগতেও এমন কিছু সিলেকশন হয়, তবে সিলেকশনটি কোনো নির্বাচক বা বিচারক প্যানেল করে না, প্রাকৃতিক কারণে ঘটে।
যেমন সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে অতিরিক্ত জোয়ারের সময় সাগরের নোনাপানি এসে জলবদ্ধতা সৃষ্টি করে। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ ধানগাছ মরে গেলেও কিছু গাছ টিকে গেছে। পরের বছর যদি এ ধানের বীজ নিয়ে চাষ করা হয়, সে ধানগুলো নোনাপানিতেও টিকে যাবে। এভাবে নতুন প্রজাতির উদ্ভব হবে, যে প্রজাতি নোনাজলেও টিকে থাকে। আফ্রিকার জঙ্গলে হরিণের দলকে সিংহ তাড়া করে, শক্তিশালী হরিণগুলো দৌড়ে পালিয়ে যায়, দুর্বলেরা শিকার হয়। ফলে পরবর্তী প্রজন্মের হরিণগুলো হয় শক্তিশালী।
প্রাকৃতিক কারণেই এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যুদ্ধ করে নতুন বা ভিন্ন একটি প্রজাতির উন্মেষ ঘটে, শক্তিশালী প্রজন্ম টিকে থাকে। ন্যাচারাল সিলেকশনের বাইরে ঐচ্ছিক নির্বাচনও ঘটে। ফ্রিজিয়ান প্রজাতির গরু বেশি দুধ দেয় কিন্তু আমাদের দেশের আবহাওয়ায় টিকতে পারে না। ফলে দেশি গরুর সাথে বিদেশি প্রজাতির ক্রসব্রিড করে ধাপে ধাপে নতুন সংকর প্রজাতির উদ্ভব হয়।ডারউইনের 'অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস' পড়ার পর ১৮৬৪ সালে Herbert Spencer নিজের অর্থনীতি তত্ত্ব ও ডারউইনের জীববিজ্ঞান তত্ত্ব সমান্তরাল রূপরেখা হিসেবে প্রকাশ করেন। 'Survival of the fittest' বাক্যাংশটি ব্যবহার করেন তার লেখা 'Principle of Biology' বইতে। স্যার ওয়ালেসের পরামর্শে ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত 'The Variation of Animals and Plants Under Domestication' বইতে ডারউইন ন্যাচারাল সিলেকশনের পরিবর্তে 'Survival of the fittest' ব্যবহার করেন।
সূর্যগ্রহণ
১৮৬০-এর পরপর ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব ব্যাপক সমাদৃত হলেও, ধীরে ধীরে শুরু হয় এর ব্যাপক সমালোচনা। ক্রিয়েশনিস্ট এবং বিজ্ঞানী মহল, উভয় মহলের তোপের মুখে পড়ে ডারউইন তত্ত্ব। বানরের শরীরে ডারউইনের মাথা বসিয়ে প্রচুর কার্টুন আঁকা হয়, গাঁজাখুরি, আজগুবি, পাগলামি, এমন নানাবিধ বিশেষণে ভূষিত করা হয় বিবর্তনবাদের তত্ত্বকে। বলা চলে, ১৮৮০ সালের দিকে ডারউইনের তত্ত্ব আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এজন্য ১৮৮০ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত সময়টাকে বলা হয় Eclipse of Darwinism।
পুনর্জাগরণ
প্রায় ৪০ বছরব্যাপী ' Eclipse of Darwinism'-এর সময় বিবর্তন নিয়ে অনেক নতুন তত্ত্ব ও মতবাদের আগমন ঘটে, কিন্তু তাদের কোনোটিই ভিত শক্ত করতে পারেনি। বিশ শতকের প্রথম দিকে, প্রথম বড় ধরনের ব্রেক-থ্রু ঘটে মেন্ডেলের জেনেটিকস তত্ত্বের মাধ্যমে। ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন এবং মেন্ডেলের জেনেটিকসের সাথে যোগ হয় জেনেটিক ড্রিফট, জীবাশ্ম বিজ্ঞান, পপুলেশন জেনেটিকস, মিউটেশনসহ বিবর্তনের নতুন নতুন ব্যাখ্যা। সবকিছুকে গাণিতিক মডেলে এনে বিবর্তন সমন্ধে ঘটে এক নতুন সংশ্লেষণ, যার ওপর ভিত্তি করে ১৯৪২ সালে, জুলিয়ান হাক্সলে প্রকাশ করেন 'Evolution: The Modern Synthesis'। বলা চলে, মডার্ন সিনথেসিসের মাধ্যমেই ডারউইনিজমের পুনরুত্থান ঘটে। সেই ১৮৬০ সালে হেনরি হাক্সলের দেয়া নাম 'ডারউইনিজম' বা কারও কারও ভাষ্যে নিউ-ডারউইনিজম হয়ে গেল- ডারউইনের পূর্ববর্তী কিংবা পরবর্তী বিবর্তনবাদ সম্পর্কিত যেকোনো তত্ত্ব বা মতবাদের কথ্য পরিচয়। ডারউইন নিজেও তার তত্ত্ব সংশোধন করেন। তাই বিবর্তনবাদ মানেই ডারউইনের তত্ত্ব নয়; তবে বিবর্তনবাদকে কথ্য ভাষায়- ডারউইনিজম বলা হয়, যেমন প্লেটোনিক কনসেপ্ট, অ্যারিস্টটলিয়ান ফিলোসফি। তবে বিজ্ঞানী মহলের চেয়েও ডারউইনিজম শব্দটি বেশি ব্যবহার করতে শুরু করল ক্রিয়েশনিস্টরা, অনেক ক্ষেত্রে তা গালির মতো। ক্রিয়েশনিজমের সাথে দ্বিমত পোষণকারী যেকোনো মতবাদকেই তারা ডারউইনিজম বলতে শুরু করল।
'বানর থেকে মানুষের আগমন' কথাটি যদিও ডারউইন বলেননি, বলেছিলেন ইবনে খালদুন। কিন্তু, এখন যদি কেউ ডারউইনের তত্ত্বকে এবং বিবর্তনবাদকে পাঠযোগ্য বিষয় মনে করে, অনেক শিক্ষিত, বিজ্ঞ ব্যক্তি তাদের বলেন 'বানরের সন্তান'। ১৮৪০-এর দিকে প্রযুক্তি ছিল অনেক পিছিয়ে, জেনেটিকস ছিল আঁতুড়ঘরে, বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ ছিল একমাত্র এনালাইটিক টুলস, তারপরেও চার্লস ডারউইনকেই গণ্য করা হয় 'ফাউনডিং ফাদার অব ইভোলিউশন' হিসেবে।
পায়ে পায়ে পিছু হাঁটা
বিবর্তনবাদের সমস্যা হলো, এখানে বর্তমানের ওপর ভিত্তি করে অতীতকে কল্পনা করা হয়েছে। সরল উদাহরণ, যেমন একজন লোকের চুল কালো, গায়ের রং বাদামি, কিন্তু চোখ নীল। আমরা ভেবে নিচ্ছি, তার পিতামাতার কারও চোখ নীল ছিল। যদি তা নাহয়, ধরে নিচ্ছি এর আগের প্রজন্মে কারও এমন ছিল। জাপান বা চীনের কয়েক প্রজন্মের উচ্চতার পরিবর্তন দেখে কিংবা ২০০-৩০০ বছর আফ্রিকায় থাকা ককেশিয়ানদের গায়ের রং দেখে, আমরা পরিবেশের প্রভাব অনুমান করে নিচ্ছি। এ কাজটি হয়তো কয়েক প্রজন্ম, নিদেনপক্ষে কয়েক শতকের জন্য করা সম্ভব। ইতিহাসে লিপিবদ্ধ তথ্য অনুযায়ী হয়তো আরও পিছিয়ে গিয়ে তৎকালীন পরিস্থিতি কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। যেমন গত ১০ বছরের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দেখলে একটি লোকের চেহারার পরিবর্তন বা তার কার্যকলাপ, চালচলন, জীবনযাপন সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা নেয়া যায়। কিন্তু ২০ বছর আগে যখন ফেসবুক ছিল না, তখনকার পরিস্থিতির জন্য হয়তো তার পুরোনো কিছু ছবি, সঙ্গীসাথীদের সাক্ষাৎকার নেয়া যায়। কিন্তু যতই পিছাতে থাকব, তথ্যের পরিমাণ ততই কমতে থাকবে। ডারউইন যখন এসব তথ্য-উপাত্ত জড়ো করেন এবং যেসব বিষয়বস্তু নিয়ে গবেষণা করেন, তার পেছনে যাবার তেমন ভালো কোনো উপায় ছিল না। গালেপোগাস দ্বীপে গিয়ে শুধু ধারণাই করতে পারেন যে একটি পাখির ঠোঁট এ কারণে সরু হয়ে গেছে। কিন্তু কয়েক হাজার বছর আগে সত্যি ঠোঁট মোটা ছিল কিনা, জানার উপায় নেই। আফ্রিকার সাদা মানুষদের ইতিহাস পড়লে হয়তো আমরা জানতে পারি যে তারা ৩০০-৪০০ বছর আগে এখানে এসেছিল, কিন্তু পাখিদের জিজ্ঞেস করে তো আর ইতিহাস পাওয়া সম্ভব না, তাই সম্পূর্ণ ব্যাপারটি ছিল কাছাকাছি নমুনার আপাত ভিন্নতার ভিত্তিতে অনুমানমাত্র।
হাজার, অযুত লক্ষ বছরে জীবপ্রকৃতির কতটা পরিবর্তন হয়েছে, কত ধাপে হয়েছে, এসব বলার মতো কেউ নেই। তাই বর্তমান জীবপ্রকৃতি সম্পর্কে জানতে বিজ্ঞানীদের পেছন দিকে হাঁটতে হয়েছে, কল্পনা করতে হয়েছে গতকাল কী হলে আজকে এমন হবে। বর্তমানে হয়তো একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানী ঝানু গোয়েন্দার মতো ক্রাইম সিন পর্যবেক্ষণ করে একটি তদন্ত পরিকল্পনা করে, সে অনুযায়ী অতীতের অনুসন্ধান শুরু করেন এভিডেন্স দাঁড় করানোর জন্য। কিন্তু প্রাচীন বিজ্ঞানীদের জন্য ব্যাপারটা ছিল কাকতালীয়। এভিডেন্স তাদের তদন্ত শুরু করতে উদ্বুদ্ধ করে। হয়তো এমন একটি কঙ্কাল পাওয়া গেল, যা দেখতে মানুষের মতো, কিন্তু খুলি কিছুটা ভিন্ন রকম, উচ্চতায় বেশ খাটো। আবার হয়তো ৫০ ফুট দৈর্ঘের ক্যাঙ্গারুর মতো দেখতে একটি কঙ্কাল পাওয়া গেল, যার অস্তিত্বই পৃথিবীতে নেই। এমন বিস্ময়কর নমুনা উদ্বুদ্ধ করল আরও গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য, আরও নতুন এলাকায় অনুসন্ধানের জন্য।
গ্রিক বিজ্ঞানী Xenophanes (৫৭০-৪৮০ খ্রি.পূ), Herodotus (৪৮৪-৪২৫ খ্রি.পূ), Eratosthenes (২৭৬-১৯৪ খ্রি.পূ), এবং Strabo (৬৪-২৪ খ্রি.পূূ) প্রথম জীবাশ্মের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। স্থলভাগে পাওয়া জলজ জীব যেমন শামুক, ঝিনুক, মাছের জীবাশ্ম দেখে অনুমান করেন, একসময় এসব স্থলভাগ হয়তো পানির নিচে ছিল। ইবনে সিনা তার 'Book of healing'-এ (১০২৭) ফসিল নিয়ে আলোচনা করেন। চীনা প্রকৃতিবিদ Shen Kuo (১০৩১-১০৯৫ খ্রি.) বলেন, ক্লাইমেট পরিবর্তনের কারণে জীববৈচিত্র্যের বিবর্তন হয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের ফসিল বা জীবাশ্ম পাওয়ার সাথে একটি সমস্যা হলো এর সময়কাল জানা। যেমন হাওর অঞ্চলে একটি তিন ফুট লম্বা শিং মাছের কঙ্কাল পাওয়া গেল, আরেকটি পাওয়া গেল দুই ফুট লম্বা, আরেকটি এক ফুট লম্বা। এটা দেখেই বলা সম্ভব না যে এককালে শিং মাছ তিন ফুট লম্বা ছিল, হাজার হাজার বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে সে ছোট হয়েছে। হতে পারে সবগুলো শিং মাছের কঙ্কাল একই সময়ের, হয়তো একটি আইড় আরেকটি ট্যাংরা। যদি জানা যায় বড়গুলো ২০,০০০ বছর আগের বা কাছাকাছি সময়কালের, মাঝারিগুলো ১০,০০০ বছরের আশপাশে, তাহলে হয়তো ভাবনার সুযোগ থাকে একসময় শিং মাছ বেশ বড় ছিল, ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে ছোট হয়েছে। তাই অতীতের জীবাশ্মের সাথে বিবর্তনকে সম্পর্কিত করার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ল নমুনার সময়কাল নির্ধারণ করা।
ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট
অনেক পণ্যের গায়েই লেখা থাকে 'প্রস্তুতকাল', সেটা দেখে আমরা বের করতে পারি পণ্যটি কবে প্রস্তুত হয়েছিল। গাড়ির চেসিসে তা খোদাই করে লেখা থাকে, কিন্তু মানুষের গায়ে লেখা থাকে না। তারপরও গায়ের চামড়া, দাঁতের সংখ্যা, উচ্চতা, ইত্যদি দেখে আমরা অনেকটা অনুমান করে নিই, একজন মানুষের বয়স এত হতে পারে। কিন্তু একটি হাড়ের টুকরা কিংবা একটি পাথরের তৈরি বল্লম দেখে জানা সম্ভব না যে আসলে এটা কত সালে তৈরি করা হয়েছিল। কারণ, কেউ সেখানে ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট খোদাই করে রাখেনি।
মজার ব্যাপার হলো, সমস্ত পদার্থে প্রাকৃতিক উপায়ে লিখিত একটি প্রস্তুতকাল রয়েছে, সেটা পাঠোদ্ধার করতে পারলে তাকে কবে প্রস্তুত করা হয়েছিল, তা বের করা সম্ভব। তবে এটা ওষুধের গায়ে লেখা তারিখের মতো না যে পড়ে বলা যাবে তার প্রস্তুতকাল ১৩ জুলাই ৮৭৭ ইং। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগে মোটামুটি ভালোভাবে অনুমান করা যায়, জিনিসটা কত বছর আগের।
বয়স মাপার বালুঘড়ি
দুটো কাচের বেলুন, ইংরেজি আট কিংবা বাংলা ৪-এর মতো, একটির মুখে আরেকটি লাগানো, ভেতরে সাদা বালি বা পাউডার জাতীয় কণা। ইংরেজিতে বলা হয় আওয়ার গ্লাস, বাংলায় বালুঘড়ি। প্রায় ৩৭০০ বছর আগে মিসর এবং ব্যাবিলনে এ রকম ঘড়ির প্রচলন ছিল। যদিও ঘড়ি আবিষ্কারের পর এর আর প্রচলন নেই, তবুও স্যুভেনির হিসেবে দেখা যায়, আবার অনেকে ডিম ভাজার টাইমার হিসেবে ৩ মিনিটের বালুঘড়ি ব্যাবহার করে। বালুঘড়িতে একটি বেলুনে বালি থাকে, দুটি বেলুন একটি সরু নলের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। বেলুন উলটে দিলে ওপর থেকে নিচে বালু পড়তে থাকে। যত সময় যায়, বালু কণার সংখ্যা কমতে থাকে। প্রাচীন জিনিসের বয়স মাপার পদ্ধতিটাও অনেকটা এমন, কণার সংখ্যা কমা অনুযায়ী কত বয়স হলো, তা বের করা যায়।
বয়স নির্ধারণের এই পদ্ধতি সম্পর্কে জানার আগে পরমাণু সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা নিতে হবে। উচ্চতর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় না গিয়ে শিশুতোষ ব্যাখ্যা দিচ্ছি নিছক একটা ধারণা নেয়ার জন্য। আমরা জানি প্রতিটি পদার্থই পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত। প্রতিটি পরমাণু আবার প্রটোন, নিউট্রন, ইলেকট্রনের মতো কণা দিয়ে তৈরি। একেক মৌলিক পদার্থের এসব কণার সংখ্যা ভিন্ন থাকে। যেমন একটি হিলিয়ামে ২টি ইলেকট্রন, ২টি প্রোটন, ২টি নিউট্রন থাকে, কার্বনে থাকে ৬টি করে। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস, যা প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয়ে গঠিত। একটি পরমাণুর কেন্দ্রে যতগুলো প্রোটন থাকবে, সেটাই তার অ্যাটমিক নাম্বার। তবে একই মৌলিক পদার্থের পরমাণুতে প্রোটনের সংখ্যা সমান হলেও নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন হতে পারে। যেমন সাধারণ কার্বনের অ্যাটমিক নাম্বার ৬, মানে ছয়টি প্রোটন রয়েছে। যখন সমানসংখ্যক নিউট্রন থাকে, তখন তাকে বলা হয় ঈ১২। যদি একটি নিউট্রন বেশি থাকে, তাহলে ঈ১৩। কিছু কার্বনে ৮টি নিউট্রন থাকে, তাকে বলা কার্বন-১৪। একই পদার্থ কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা যদি ভিন্ন হয়, তখন তাকে আইসোটোপ বলা হয়। কার্বন-১২/১৩ আইসোটোপ স্থিতিশীল, কিন্তু কার্বন-১৪ অস্থিতিশীল।
পরমাণুতে কণার সংখ্যা পরিবর্তন করে দিতে পারলে এক পদার্থ অন্য পদার্থে পরিণত হয়। প্রকৃতিতে উপস্থিত এসব মৌল স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তু আনস্ট্যাবল আইসোটোপ, যেমন কার্বন-১৪, ইউরেনিয়াম, এরা সাধারণভাবে ক্ষয় হতে থাকে, যাকে বলা হয় রেডিও-অ্যাক্টিভ ডিকে। এ ক্ষয় জুতার সোল ক্ষয় হয়ে যাওয়ার মতো কিছু নয়। এ ক্ষয় হলো তাদের একেকটি অণুর পার্টিকেল কমে গিয়ে অন্য মৌলে পরিবর্তিত হওয়া। যেমন কার্বন-১৪ থেকে একসময় নাইট্রোজেন কিংবা ইউরেনিয়াম থেকে সিসাতে পরিবর্তিত হওয়া। রেডিও অ্যাকটিভ ডিকের হার একেক পদার্থে একেক রকম, যেমন হিলিয়াম-৭ বলতে গেলে সাথে সাথে ক্ষয় হয়ে যায় (১ সেকেন্ডের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগ সময়ে), আবার ইউরেনিয়াম-২৩৮ ক্ষয় হতে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর লাগে, যা আমাদের পৃথিবীর বয়সের কাছাকাছি।
ব্যাপারটা যদি এমন হয় যে একটি বিড়াল ১০০০০ লোম নিয়ে জন্মায় এবং প্রতিদিন তার একটি করে লোম ঝরে পড়ে। তাহলে কোনো একটি বিড়ালের লোম গুনে যদি দেখা যায় তার পশমের সংখ্যা ৯২৭০; তাহলে তার শরীর থেকে ৭৩০টি লোম পড়ে গেছে, মানে তার বয়স ২ বছর। প্রকৃতিতে আমরা কোনো একটি পাথরের টুকরার বয়স তার সাথে সম্পৃক্ত রেডিও অ্যাকটিভ ইলিমেন্টের ডিকের পরিমাণ মেপে তার বয়স নির্ধারণ করতে পারি। এভাবে বয়স বের করা পদ্ধতিকে বলা হয় রেডিওমেট্রিক ডেটিং। জৈব পদার্থের ক্ষেত্রে কার্বন-১৪ পরীক্ষা করে একটি ফসিলের বয়স নির্ধারণ করা যায় মোটামুটি নিখুঁতভাবে, যাকে বলা হয় রেডিওকার্বন ডেটিং বা ঈ-১৪ ডেটিং।
এত দিন যেসব ফসিলের বয়স বিজ্ঞানীদের অজানা ছিল, ১৯৫০-এর দিকে রেডিওমেট্রিক এবং রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের ব্যাপক ব্যবহারের সাথে সাথে আমাদের অতীত আরও নিখুঁতভাবে উপস্থাপিত হতে থাকে। আমরা জানতে পারি, কত হাজার বছর আগে আমরা পাথরের অস্ত্র ব্যবহার শুরু করি, কত হাজার বছর আগে আমরা গুহায় চিত্র আঁকতে শুরু করি, বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া মানুষ আকৃতির কঙ্কালগুলো কত পুরোনো, ডায়নোসর কত পুরোনো। আমরা জানতে পারি গিলগামেসের মহাকাব্য কবে রচিত হয়েছিল, পিরামিডের বয়স কত কিংবা জানতে পারি পিকিং ম্যান কত দিন আগে ছিল। এখন আর কেউ বলতে পারবে না যে তিন ফুট দীর্ঘ শিং মাছ আর আট ইঞ্চি দীর্ঘ শিং মাছের কঙ্কাল দুটি একই সময়ের।
আত্মীয়তার যোগসূত্র
বয়স মাপার পদ্ধতিতে আমরা শুধু জানতে পারলাম বিভিন্ন এলাকায় আবিষ্কৃত ফসিলগুলো কত পুরোনো, কিন্তু এ ফসিলগুলো কাদের, এটা কিন্তু জানা সম্ভব হয়নি। আমরা শুধু একটি এক লাখ বছর আগের একটি কঙ্কাল পেয়েছি, যা অনেকটা ঘোড়ার মতো, আবার ৫০ হাজার বছর আগের আরেকটি কঙ্কাল পেয়েছি, যা দেখতে একই রকম, কিন্তু সাইজে সামান্য ছোট, হয়তো মাথার আকৃতি কিছুটা ভিন্ন। এখানে দুটো সম্ভাবনা রয়েছে, হয়তো এক লাখ বছর পুরোনো কঙ্কালের প্রাণীটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে ৫০ হাজার বছরে সামান্য ছোট হয়েছে, মাথার আকৃতি একটু চ্যাপ্টা হয়েছে। যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে বলা যায় সময়ের ব্যবধানে বিবর্তন হয়েছে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো, এক লাখ বছর আগের কঙ্কালটি ঘোড়ার, ৫০ হাজার বছর পুরোনো কঙ্কালটি গাধার, দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জীব। সে ক্ষেত্রে এসব পুরোনো নমুনা দিয়ে বিবর্তন প্রমাণ করা সম্ভব না।
বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়কালের, বিভিন্ন এলাকায় প্রাপ্ত মানবসদৃশ কঙ্কালগুলো সাজিয়ে একটা প্যাটার্ন তৈরি করার চেষ্টা করে।
কোনো গাড়ির স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে সেই ১৮৮০ সালে থেকে শুরু করে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মডেলের গাড়ির ভাঙাচোরা রংচটা, মরচে পড়া চ্যাসিসগুলোর দিকে তাকিয়ে একজন ব্যক্তি হয়তো একটা ধারণা পাবে, ১৯০০ সালের গাড়িটা এমন ছিল, এরপর আধুনিক ছোট ইঞ্জিন এল, গাড়ির বনেট ও বুট স্পেস ছোট হতে লাগল। আধুনিক সাসপেনসন চেসিস পরিবর্তিত হলো। হাইড্রলিক স্টিয়ারিং, সেলফ স্টার্টার সব কিছু আবিষ্কারের সাথে সাথে গাড়ির অবয়ব পাল্টে যেতে লাগল। কিন্তু সবগুলো একই কোম্পানির গাড়ি কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। গত প াশ বছরে টয়োটা গাড়ির আকৃতি যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, রোলস রয়েস হয়তো সেভাবে হয়নি।
মানুষের কঙ্কাল বা ফসিল থেকেও বিজ্ঞানীরা পরিবর্তনের ধারাগুলো অনুমান করে নেয়। মানুষের পায়ের হাড়, খুলির ভেতর মস্তিষ্কের আয়তন, গোড়ালির গঠন, বিভিন্ন বিষয় দেখে একটি প্যাটার্ন তৈরি করে যে ১০ লাখ, ৫ লাখ, ১ লাখ, ৫০ হাজার বছরে পরিবর্তনের প্রকারভেদ কেমন ছিল। বন-জঙ্গলে চলা ল্যান্ডরোভার আর শহরে চলা সিডানের বিবর্তন যেমন ভিন্ন গতিতে হয়েছে, পাহাড়ি এলাকার মানুষ, মরুভূমির মানুষ কিংবা দ্বীপা লের মানুষের পরিবর্তনেও তেমন ভিন্নতা পাওয়া যাবে। সস্তা জ্বালানি, বড় এবং ধনী দেশ হিসেবে আমেরিকাতে বড় বড় গাড়ি তৈরি হয়েছে, আবার ছোট দেশ, সরু রাস্তার এলাকাগুলোতে ছোট গাড়ি তৈরি হয়েছে। বিবর্তন সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের অনুমান অনেকটা এমনই, এর কোনো প্রমাণ নেই, শুধুই কল্পনা, তা-ও আবার লাখ লাখ বছর পেছনে গিয়ে কল্পনা। মানুষ বা অন্য যেকোনো জীবের দেহ সহজেই মাটির সাথে মিশে যায়, তাই জীবাশ্মও যে চাইলেই পাওয়া যাবে, তা নয়। যেসব এলাকা শুষ্ক, যেখানে অগ্নুৎপাত হয়ে জীবাশ্ম লাভার মধ্যে চাপা পড়ে গেছে, যেখানে বরফশীতল আবহাওয়াতে এমনিতে মৃতদেহ টিকে গেছে, এমন অল্প কিছু নমুনার ওপর ভিত্তি করেই তাকে মানুষের জাদুঘর সাজাতে হয়েছে। আর একেকটি জীবাশ্মের সময়কাল অনুযায়ী বিবর্তনের কারণগুলো ভাবতে হয়েছে।
বেঞ্জ গাড়ির সন্ধানে
মোহাম্মদপুর ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত এলাকা, ঢাকার কেন্দ্র থেকে দূরেই বলা চলে। এখানকার ইকবাল রোডে বেশ কয়েকটি স্কুল রয়েছে। প্রতিদিন শুধু ইকবাল রোডে হাজার হাজার গাড়ি ঢোকে স্কুলের বাচ্চা নিয়ে। ১৯৮২-৮৩-এর দিকে, একদম ঢাকার কেন্দ্রে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল বেশ সম্ভ্রান্ত স্কুল ছিল, সাথে ছিল কলেজ সেকশন। তখন সেই হাজার শিক্ষার্থীর স্কুলে একটিমাত্র গাড়ি আসত, কালো একটি মরিস মাইনর। আমাদের লাইব্রেরিয়ান ম্যাডামের হাজব্যান্ড তাকে গাড়িতে করে নামিয়ে দিয়ে যেতেন। এখন ঢাকার উত্তরা নামক টাউনশিপে যত গাড়ি আছে, ৫০ বছর আগে সারা বাংলাদেশে তত সিডান কার ছিল না। মানে আজকে যে লাখ লাখ গাড়ি আছে, একসময় ছিল অনেক কম, আরও গেলে দেখা যাবে কোনো গাড়িই ছিল না। এর মানে গাড়ি অন্য কোথাও থেকে এসেছে।
এবার যদি গাড়ির উৎসের সন্ধানে পেছনে হাঁটি, আজকের ভারতে প্রস্তুত মারুতি গাড়িটি একজন বিজ্ঞানী পরীক্ষা করলে দেখবে, গাড়িটি ভারতে তৈরি হলেও এর অনেক অনেক কিছু জাপানি গাড়ির সাথে মিলে যায়, তাই গাড়িটি হয়তো জাপানি কোনো গাড়ির ডিজাইনকে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। এর উৎস খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যাবে সুজুকি। সে গাড়ি পরীক্ষা করলে পাওয়া যাবে সিভিটি, ভিভিটিআই এসব হয়তো জাপানি প্রযুক্তি, কিন্তু মূল ইঞ্জিনের সাথে আমেরিকার ইঞ্জিনের যথেষ্ট মিল। এবার যদি আমেরিকান গাড়ির দিকে নজর দেয়, তাহলে পাবে অনেক কিছু আমেরিকান প্রযুক্তি হলেও আসলে মূল প্রযুক্তি এসেছে ইউরোপ থেকে। ইউরোপে গেলে দেখা যাবে, জার্মানি থেকে গাড়ি এসব জায়গায় ছড়িয়েছে। আরও গোড়ায় গেলে পাওয়া যাবে, কার্ল বেঞ্জ নামক ভদ্রলোক তার স্ত্রী বার্থা বেঞ্জের দেয়া যৌতুকের টাকায় পৃথিবীর প্রথম গাড়িটি তৈরি করেন ১৮৮৬ সালে। পরে ইউরোপীয় এমিল জেলিনেক ১৯০১ সালে গাড়ি তৈরি করে তার মেয়ের নামে নাম রাখেন 'মার্সিডিজ'। পরে বেঞ্জ আর জার্মান গাড়ি নির্মাতা ডায়ালমার মিলে ১৯২৬ সালে নির্মিত গাড়ির ব্র্যান্ড রেজিস্ট্রার করেন 'মার্সিডিজ বেঞ্জ' নামে।
এ মুহূর্তে যদি বিশ্বের সব গাড়ি নির্মাতার গাড়িগুলোর পার্টস আলাদা আলাদা করে সজানো হয়, প্রায় সব গাড়ির কিছু মূল পার্টস জার্মান উত্তরাধিকার দেখাবে, এরপর মিল পাওয়া যাবে হয়তো ইউরোপ ও আমেরিকান প্রযুক্তির। কিন্তু সংখ্যায় দেখা যাবে জাপানি প্রযুক্তির নিদর্শন সবচেয়ে বেশি। তখন একটা ধারণা পাওয়া যাবে যে জার্মানি তথা ইউরোপ থেকে শুরু হয়েছিল, পরে ইউরোপ এবং আমেরিকাতে প্রচুর সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে, কিন্তু সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে জাপান থেকে।
গাড়ির মতো যেকোনো জিনিসের বিবর্তনের একটি সম্পূর্ণ চিত্র পেতে হলে তার উৎসের সন্ধানে যেতে হয়। ওপরের উৎসের সন্ধান সহজে দেওয়া সম্ভব হয়েছে কারণ, এসব লিপিবদ্ধ ইতিহাস। কিন্তু, জীব বিবর্তনের অযুত-নিযুত-লক্ষ বছরের পেছনের ইতিহাস খোঁজা প্রায় অসম্ভব, কারণ কেউ এসব লিখে রাখেনি। তাই বিবর্তন কীভাবে হয়েছে, আদৌ মানুষের বিবর্তন হয়েছে কি না, তা জানতে উৎসের সন্ধান অত্যাবশ্যকীয়।
উৎসের সন্ধানে
মাত্র ৪০ বছর আগে উত্তরা, বসুন্ধরা, বাসাবো, খিলগাঁও এসব এলাকায় কোনো মানুষ ছিল না, অধিকাংশ এলাকা ছিল বিল, পানির নিচে। মাত্র ৩০০ বছর আগে কলকাতা মেগা সিটিতে তেমন লোকালয় ছিল না। আজ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি, ৫০ বছর আগে ছিল সাড়ে সাত কোটি, এভাবে যদি পেছাতে থাকি, পাওয়া যাবে একসময় ঢাকা শহরেও কেউ ছিল না, আরও আগের কোনো একসময় বাংলাদেশেই কোনো মানুষ ছিল না। তারও আগে হয়তো ভারতবর্ষে ছিল না।
মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মানে একসময় হয়তো ১০০০০ মানুষ ছিল এবং কোনো সন্দেহ নেই ১০০০০ মানুষের পক্ষে পৃথিবীর লক্ষ লোকালয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সম্ভব না। স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে আদি মানুষগুলো কোথায় ছিল?
সমস্যা হলো আমাদের কলিজা, গুর্দা, ফুসফুসে মেইড ইন লেখা নেই। বাইরে ভিন্নতা থাকলেও কাটার পর সবার ভেতরে প্রায় একই রকম, রক্ত সবারই লাল। তাই বাইরে থেকে দেখে মানুষের উৎস খুঁজে বের করা সহজ নয়।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি অবস্থার কিছু পরিবর্তন ঘটল, যাত্রা শুরু হলো জেনোমিকসের। জিন, জেনোম, ডিএনএ সম্বন্ধে মানুষ জানতে শুরু করল। জানতে পারল মানুষের আসল বিল্ডিং কোড কোথায়। জানতে পারলাম আমরা প্রত্যেকে প্রায় একই জিন বহন করি, কিন্তু প্রায় ৩২০ কোটি DNA বেস- পেয়ারের সব হুবহু এক না, অন্তত ১% ভিন্নতা রয়েছে। শুরু হলো ম্যাপিং, সে গাড়ির পার্টসের মতোই বিশ্বের সব এলাকার লোকদের দেহঘড়ি খুলে পাশাপাশি বিছানো হলো, দেখা হলো কোন এলাকার সাথে কোন এলাকার মিল সবচেয়ে বেশি বা কম।
আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, এমন সব দেশের জেনোম ম্যাপ যদি পাশাপাশি রাখা হয়, তাহলে দেখা যাবে সবার মধ্যে আফ্রিকার ছাপ রয়েছে, আবার মধ্য এশিয়ার সাথে ভালো মিল আছে। এরপরে হয়তো পূর্ব এশিয়া, কিন্তু আবার দেখা যাবে হয়তো পূর্ব এশিয়ার সাথে পশ্চিমে অবস্থিত আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীদের মিল বেশি। এসব থেকে হয়তো কেউ ধারণা করবে আফ্রিকা থেকে কাছে দক্ষিণ আমেরিকাতে মাইগ্রেশন না হয়ে এশিয়া থেকে আলাস্কা হয়ে উত্তর আমেরিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকাতে মানুষ গিয়েছিল।
এত দিন বিবর্তনের ধারণা বা তার ব্যাখ্যা ছিল বাহ্যিক অবয়বের তুলনামূলক বিশ্লেষণ, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সময়কালের ফসিল সময়ানুক্রমিকভাবে সাজিয়ে কল্পনা করা একটি চিত্ররূপ মাত্র। এর মধ্যে অধিকাংশই 'হয়তো' আর যদি। হয়তো ইন্দোনেশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল, হয়তো মঙ্গোলিয়ানরা রাশিয়া থেকে আলাস্কা দিয়ে আমেরিকা গিয়েছিল, হয়তো মধ্যপ্রাচ্য ছিল জংশন। জেনোম ম্যাপিং এ রকম অসংখ্য 'হয়তো' এবং 'যদি'কে একটি গাণিতিক মডেলে নিয়ে এল, এসব অনুমান পরিণত হলো সাক্ষ্য-প্রমাণ বা এভিডেন্সে।
জন্মসনদের সন্ধানে
ন্যাচারাল সিলেকশন, সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট, মেন্ডেলিয়ান তত্ত্ব, মেলথাসিয়ান তত্ত্ব, জেনোমিক্স, জিন ম্যাপিং, যা কিছু বলা হয়েছে, তার সবকিছুর প্রেক্ষাপট বর্তমান। একটি পাখির ঠোঁট কেমন, মাথার গড়ন কেমন, চোখের রং কেমন, সবই বর্তমান প্রেক্ষাপট। এসব উদাহরণ থেকে একজন বলতে পারে যে বিবর্তন ঘটেছিল, কিন্তু নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা কঠিন। মেনে নিলাম ডাইনোসর ছিল এবং তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এটা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এমন অনেক প্রাণী এখনো বিলুপ্ত হচ্ছে। হোমো-ইরেকটাসের কঙ্কাল পেয়েছি মানে এ নয় যে তারা আমার পুর্বপুরুষ। তারা হয়তো বানর, বেবুন, ওরাংও ওটাংয়ের মতোই আরেকটি প্রজাতি, যারা ম্যামথের মতো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারপরেও ধরে নিলাম চিতল মাছ বিবর্তিত হয়ে ফলি মাছ এসেছে, কিন্তু মানুষ ইউনিক, আমরা যেভাবে এসেছি, সেভাবেই আছি। এ ধরনের দাবি কেউ করলে তা ভুল প্রমাণিত করা কঠিন। আমরা চোখের সামনেই দেখছি মৃগেল মাছ, গ্রাসকার্প, কালবাউশ ভিন্ন ভিন্ন মাছ। কিন্তু এ রকম মাছের কঙ্কাল দেখতে একই রকম মনে হবে। তাই মাথা মোটা, থ্যাবড়া নাক, চাপা খুলি, এসব পুরোনো জীবাশ্ম এনে যদি দাবি করি, এসব আসলে ভিন্ন প্রজাতি নয়, বর আমাদেরই পূর্বপুরুষ, তা কেউ মানতে বাধ্য নয়।
আমি একটি জমির মালিক হয়েছি উত্তরাধিকারসূত্রে আমার পিতার কাছ থেকে। এ জমির মালিকানা পেতে হলে আমার জন্মসনদ দাখিল করতে হবে।
কিন্তু যদি আমার জন্মসনদ না থাকে, তাহলে কী হবে?
বিবর্তনের ধারায় বিজ্ঞানীদের সামনেও তেমন একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াল উত্তরাধিকার প্রমাণ করা। হোমো-ইরেক্টাস কিংবা অস্ট্রালোপিথেকাস ছিল মেনে নিচ্ছি, কিন্তু তারা যে আমাদের আত্মীয়, কিংবা মানুষ এবং অন্য কোনো মানবসদৃশ প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে, তা আমাকে কেন মানতে হবে?
যদি প্রমাণ করতে হয়, বিবর্তন হয়েছিল, তাহলে অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে পিতৃপুরুষের বার্থ সার্টিফিকেট জোগাড় করতে হবে।
অতীতের পুনরুত্থান
মায়ের সাথে মিসরে ঘুরতে গিয়ে বালক চেয়েছিল ইজিপ্টোলজিস্ট হবে। পরে বুঝতে পারে ব্যাপারটা বেশি বেশি রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছে। ইজিপ্টের ভূত সাময়িকভাবে মাথা থেকে নামিয়ে মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন, এরপরে মোলিকুলার বায়োলজি, আর সেখান থেকেই শুরু উঘঅ নিয়ে কাজ করা। একটা আ লিক প্রবাদ রয়েছে, পাগল ভালো হলেও চৌদ্দ আনা। পাবোর মাথা থেকেও ইজিপ্টোলজির ভূত সম্পূর্ণ নামেনি। মিসরীয় মমি থেকে নমুনা নিয়ে তার উঘঅ সিকুয়েন্সিংয়ের কাজ শুরু করেন গোপনে। কিন্তু দেখা যায় প্রাচীন মমি থেকে নেওয়া নমুনার উঘঅ ব্যাকটেরিয়া কিংবা যারা কাজ করে, তাদের ডিএনএ দ্বারা কন্টামিনেটেড হয়ে যায়। শুরু হয় নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কারের গবেষণা, কীভাবে প্রাচীন নমুনা থেকে উঘঅ সিকুয়েন্সিং করা যায়। গত শতাব্দীর শেষের দিকে ঘোষণা দেয়া হয় সে এবং তার দলের লোকেরা প্রাচীন উঘঅ সিকুয়েন্সিং করার পথ খুঁজে পেয়েছে। ২০০৭ সালে তার দল জানায়, তারা নিয়ান্ডারথালের পুরো জেনোম পুনর্নির্মাণ করবেন এবং ২০০৯ সালে তারা সফল হন। এরপর ২০১০ সালে আরেকটি নমুনার সম্পূর্ণ জেনোম পুনর্নির্মাণ করেন, রাশিয়ার সাইবেরিয়ার ডেনিসোভান গুহা থেকে প্রাপ্ত একটি আঙুল থেকে নমুনা নিয়ে। আমরা জানতে পারি নিয়ান্ডারথালের মতোই আরেক মানবসদৃশ আরেক সাবস্পিসিস বা উপজাতির ডেনিসোভানের কথা। কিন্তু সবচেয়ে চমকে দেয়া তথ্য হলো আধুনিক মানুষ, হোমোস্যাপিয়ানদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১-৪% নিয়নাডারথাল উঘঅ। মেলানেশিয়ান স্যাপিয়েনদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৬% পর্যন্ত ডেনিসোভান DNA। পাবোর এ উদ্ভাবন অতীতকে জানার অভূতপূর্ব দুয়ার খুলে দেয়। পাবোর ভাষায়, নিয়েন্ডারথাল বিলুপ্ত হয়নি, আমাদের মাঝেই বেঁচে আছে। আমাদের শুধু বিবর্তনই হয়নি, বিবর্তিত অন্যান্য প্রজাতির সাথে আন্তপ্রজনন হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি ঘোড়া খুবই বুদ্ধিমান প্রাণী। সে মনে করে, সে অন্য জীব থেকে আলাদা, স্বতন্ত্র। অন্য জীব হয়তো ধীরে ধীরে বিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু আমি হইনি, আমি ঘোড়া এক ও অদ্বিতীয়। আমার সাথে অন্য জীবের তুলনা কোরো না, তোমরা অতীতের যেসব ঘোড়াসদৃশ কঙ্কাল দেখাচ্ছ, সেটা আমি নই। কিন্তু পাবোর আবিষ্কার কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের করে আনল। সে বস্তুত প্রমাণ করে দিল, ঘোড়া শুধু বিবর্তিতই হয়নি, যাত্রাপথে গাধা এবং জেব্রার সাথেও আত্মীয়তা ঘটিয়েছে। প্রাচীন উঘঅ থেকে পুনর্নির্মাণের এই পথ খুঁজে পাওয়াকে বলা হচ্ছে জেনোমিকস এবং কার্বনডেটিংয়ের পর সবচেয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার।
আমরা সবাই জানি, এই মহাবিশ্বের সবকিছু অণু-পরমাণু দিয়ে তৈরি। এসব পরমাণু আবার ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনের মতো কণার সমন্বয়। অতি উন্নত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে একটা বড় পরমাণুকে হয়তো দেখা যেতে পারে, কিন্তু পরমাণুর ভেতরে কী আছে, সেটা আমরা কখনোই দেখতে পারি না। নিলস বোরের পরমাণুর খুব সহজ-সরল একটি নকশা দেখানো হয়, যেটা অনেকটা আমাদের সৌরজগতের মতো, একটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে যেভাবে গ্রহরা প্রদক্ষিণ করে। কেন্দ্রে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন, আর এর চারদিকে ইলেকট্রনের অরবিট। এটা আসলে নিতান্তই ধারণামাত্র, কত ধরনের কণা আছে, ইলেকট্রন কীভাবে, কত দূরে আছে, প্রদক্ষিণ করছে কী করছে না, পরমাণু আসলে কেমন সাইজের বা আকারের, সবই আপাত ধারণামাত্র। ম্যাস স্প্রেক্টোমিটারের মতো নানাবিধ প্রযুক্তির মাধ্যেমে এখনো বোঝার চেষ্টা করছি, পরমাণু ভেতরে কেমন হতে পারে। ইলেকট্রন কতটা ব্যাসার্ধ নিয়ে থাকতে পারে, এর আকৃতি অবিকৃত, নাকি ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়, এ সমন্ধে বহুবিধ মতবাদ রয়েছে। সবশেষে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পরমাণু আসলে কী আকৃতির, তা আমরা এখনো জানি না। যতটা জানি, তার অধিকাংশই অনুমিত মতবাদ।
কিন্তু তাতে কি কিছু থেমে রয়েছে? পরমাণুর এই ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্সকে কাজে লাগিয়ে কত কিছু করছি। মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট থেকে ঘরের বাতি, সবই এই ইলেকট্রন নামের অজানা চরিত্রকে কাজে লাগিয়ে চলছে। পরমাণুর আইসোটোপ, রেডিয়েশন, ডিকে, এ রকম অনেক কিছু ব্যবহার করে ক্যানসারের চিকিৎসা থেকে অ্যাটম বম্ব কিংবা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। জানার চেষ্টাই বিজ্ঞান তথা মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
অ্যাটম শব্দটির উৎস হলো 'যাকে ভাগ করা যায় না'। কিন্তু এখন আমরা তা করতে পারি। এখন অ্যাটম নামটাই ভুল, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, জানার স্পৃহা নতুন জ্ঞানের পথ দেখায়।
প্রচলিত একটি ধারণা হলো, বিবর্তন মানেই বানর থেকে মানুষ হবার মতো একটি পাগলের প্রলাপ, ডারউইন একজন বিকৃত মস্তিষ্কের লোক এবং স্কুল-কলেজে এ রকম অপমানিত এবং একজন ব্যক্তির ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি বিষয় পড়ানো মোটেও উচিত না। ১৮৮০-এর দিকে ডারউইনকে নিয়ে অনেক কার্টুন আঁকা হতো, বানরের মাথায় ডারউইনের মাথা লাগানো। দেড় শ বছর পরে এখন আর ডারউইনকে নিয়ে আঁকা হয় না, যে কেউ বিবর্তনকে বিজ্ঞান বলেই তাকে বানরের সন্তান বলা হয়। বিবর্তনবাদ নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করা লোকেদের মধ্যে রয়েছে জ্ঞানী-গুণী, শিক্ষিত বিচক্ষণ ব্যক্তিরাও। কিন্তু নিজেদের অজান্তে তারা প্রতিদিন বিবর্তন বিজ্ঞানের প্রতিটি দ্রব্যের সদ্ব্যবহার করে বিবর্তনের বিরোধিতা করেন।
যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি আমরা খাই, তা বিবর্তনেরই ফসল। পঞ্চাশ বছর আগের পেনিসিলিনে আজকে আপনার কোনো কাজ হয় না, ডাক্তার নতুন জেনারেশনের পেনিসিলিন দেয়, এটা বিবর্তনের ফসল। বিজ্ঞানের কোনো ক্ষেত্রই বিচ্ছিন্ন নয়, পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, সবাই একে অপরের সাথে কোনো না কোনোভাবে সংযুক্ত। আমি বিবর্তন পড়ব না বা মানব না, কিন্তু আধুনিক অ্যান্টিবায়োটিক খাব যা বিবর্তন বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার আগমন ঘটছে, একে মোকাবিলার জন্য নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হচ্ছে, বিবর্তন নিয়ে গবেষণার ফলেই এসব সম্ভব হচ্ছে।
বিবর্তন বা যেকোনো বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে কেউ বাধ্য নয়, আমি কী পড়ব, সেটা সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব অভিরুচি। আধুনিক বিবর্তনবাদ দাবি করেনি বানর থেকে মানুষের উৎপত্তি। তবে বিজ্ঞান যদি না শিখি, বিবর্তনসহ সমস্ত বিজ্ঞানকে যদি প্রত্যাখ্যান করি, তাহলে একসময় মানুষ আর বানরে কোনো পার্থক্য থাকবে না, যুগের বিবর্তনে গাছে চড়াও শিখে যাব।