ইবি ও ইডেন প্রসঙ্গ: এবার ফুলপরী মুখ খুলেছেন
ফুলপরীর ক্লান্ত, অসহায় বাবা, ভ্যানচালক আতাউর রহমান একটি কক্ষে বসে ঢুলছিলেন। কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেত্রীদের নির্যাতনের শিকার তার মেয়ের পক্ষে বিচারের দাবিতে তিনি এসেছেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, কষ্ট সহ্য করে কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন ফুলপরী। চোখে স্বপ্ন একদিন পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পরিবারের হাল ধরবেন। কিন্তু সেই ফুলপরীকেই হতে হয়েছে নির্যাতনের শিকার। তাকে এমনভাবে নিগ্রহ করা হয়েছে, যেন মেয়েটি দাঁড়াতে না পারে, পড়তে না পারে, লজ্জায় যেন তার মাথা নীচু হয়ে যায় এবং ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়।
কিন্তু না, ফুলপরীকে যতোটা অসহায় ভাবা হয়েছিল, ফুলপরী ততোটা অসহায় নন। গ্রাম থেকে আসা এই ছাত্রী স্পষ্টভাবে বলেছেন তিনি বিচার না পাওয়া পর্যন্ত থামবেন না। ফুলপরীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তার ভ্যানচালক বাবা এবং তার পরিবার।
যেখানে আমাদের সমাজে নিপীড়ন-নির্যাতন ও যৌন আক্রমণের শিকার নারীকে 'ইজ্জত বাঁচানো'র কথা বলে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়, সেখানে এই অতি সাধারণ মেয়েটি মুখ খুলেছেন এবং বিচার চেয়েছেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ছাত্রলীগের ২ নেত্রীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। ফুলপরীর বাবা আতাউর রহমানই তাকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস যুগিয়েছেন।
"তোর বাবা একজন ভ্যানচালক, কে তোর পাশে দাঁড়াবে?", অভিযুক্ত আক্রমণকারী সানজিদা চৌধুরীর এই তিরস্কার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এই ভ্যানচালক বাবাই মেয়ের হাত ধরে আছেন, যা সমাজের অনেক বাবাই নানা কারণে পারেন না। মেয়েকে নিয়ে ভ্যান, নৌকা, ইজিবাইক ও বাসে চড়ে রোজ ৮ ঘণ্টা ও ৬০০ টাকা ব্যয় করে বাড়ি থেকে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। সামান্য আয়ের ওপর নির্ভরশীল একটি পরিবারের উপর এ আরেক ধরনের চাপ। বাবাসহ পরিবারের কারোরই রাতে ঘুম হয় না। কষ্ট করে ক্যাম্পাসে আসতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
'তথ্য যাচাই-বাছাই ও তদন্ত করার' নামে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে নাটক করে সময়ক্ষেপণ করছেন, তা শুধু ইবি প্রশাসনের নতজানু নীতিকেই প্রমাণ করছে। ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রথম বর্ষের অনাবাসিক ছাত্রী ফুলপরী খাতুনের অভিযোগের ভয়াবহতা অনেক বেশি। মেয়েটি নিজের মুখে সেই অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কিভাবে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তাবাসসুম ইসলাম এবং তাদের সহযোগীদের হাতে তিনি নির্যাতিত হয়েছেন।
নির্যাতনের একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয় জানিয়ে ফুলপরী লিখিত অভিযোগে বলেছেন, 'বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের সময় হুমকি দেওয়া হয়। বলা হয়, এই কথা কাউকে জানালে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। সানজিদা, তাবাসসুম আপুরা মারার সময় বলছিল, মুখে মারিস না, গায়ে মার যেন কাউকে দেখাতে না পারে।'
কাজেই ফুলপরীকে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও যৌন নির্যাতনও করা হয়েছে। এর আগেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে, পার্থক্য হচ্ছে এবার ফুলপরী মুখ খুলেছেন। এর আগে কেউ ফুলপরীর মতো সাহস করে কথা বলেননি। ফুলপরীকে অনুসরণ করে ইতোমধ্যেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৪ জন শিক্ষার্থী তদন্ত কমিটির কাছে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে ছাত্রছাত্রীরা যদি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংঠনের কোপানলে পড়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি শিরদাঁড়াহীন আচরণ করে, তাহলে সেই কর্তৃপক্ষের কোন অধিকার নেই ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক হওয়ার। বারবার প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে দেখছি মাথা নত করতে।
নির্যাতন হয়েছে একথা সত্য, ফুলপরী মেয়েটা বিচার দাবি করেছে এটাও প্রমাণিত, অভিযুক্তরা মাফ চেয়েছে ফুলপরীর কাছে এটাও সত্য, অথচ সবকিছুর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও হল প্রভোস্টের যে সাক্ষাৎকার দেখলাম পত্রিকায়, তাতে বোঝাই যাচ্ছে ওনারা দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব পালনেও তারা অপারগ।
নির্যাতনের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার আগে ও পরে ইবি প্রশাসনের অবস্থান কেমন ছিল? তাদের ভূমিকা ধরি মাছ, না ছুঁই পানি টাইপের। বারবার প্রমাণিত হচ্ছে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব তাদের পক্ষে। এই মাথা নতটা তারা কার সামনে করেন? করেন লাঠিয়াল বাহিনীর কাছে। এখানেও ছাত্রলীগের একশ্রেণীর কর্মী অবাধে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করে বলে অভিযোগ আছে, চলছে ভয়ের সংস্কৃতি; বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, প্রভোস্ট, ভিসি ক্ষমতার মোহে চুপ করে থাকেন বলেও ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য এভাবে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন পালন করেন, তাহলে একদিন এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনই যে তাদের টুঁটি চেপে ধরবে না, এ নিশ্চয়তা কে দিতে পারে। কথায় আছে তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে। কাজেই লাঠিয়াল বাহিনী, চাঁদাবাজ ও নির্যাতনকারী এই ছাত্রছাত্রী নামধারী গুন্ডাদের পোষ্য বানালে একদিন ঘা আপনাদের উপরেই পড়বে।
ইবি'র ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ছাত্রলীগ নেত্রীর 'খারাপ আচরণে'র প্রতিবাদ করায় রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের এক ছাত্রীকে স্টাম্প দিয়ে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রলীগের এক নেত্রীর বিরুদ্ধে। পেটানোর পর তার চুল ছিঁড়ে ফেলেছে এবং বটি নিয়েও তাকে ধাওয়া করেছে ওই নেত্রী। কলেজের বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা হলের ৫০৬ নম্বর রুমে এই নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
অভিযুক্ত ওই নেত্রীর নাম নুজহাত ফারিয়া রোকসানা। তিনি ইডেনের ছাত্রলীগের সহসভাপতি। এর আগেও রোকসানার বিরুদ্ধে কলেজের আরেক নেত্রীকে মারধর, সিট দখল ও শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ এসেছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমেও সংবাদ প্রচার করা হয়েছে।
এখানেও আমরা দেখছি হল সুপারের দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রবণতা। তিনি এই ভয়াবহ ঘটনাকে দুইজনের (রোকসানা এবং ভুক্তভোগী) অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে ছেড়ে দিয়েছেন এবং মিটমাট করে নিতে বলেছেন। যেখানে কলেজ কর্তৃপক্ষের উচিৎ ছিল অভিযুক্তর বিরুদ্ধে তদন্ত করা, সেখানে তা না করে মিটিয়ে নেয়ার কথা বলার মানেই হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ তোষামদী নীতিতে চলছেন। ইডেন কলেজের প্রশাসন ও শিক্ষকদের ভূমিকাটা কী? তারা কি নিজেরাই ছাত্রসংগঠনের হাতে বন্দী?
শুধু এইবারই নয়, আমরা এর আগেও ইডেনের ছাত্রীদের দলীয় কোন্দল, মারামারি, ভাগ-বাটোয়ারার সংবাদ দেখতে পেয়েছি। তবে গত কয়েক বছরে কলেজ ক্যাম্পাস ও ছাত্রীনিবাসে যে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা ছিল ভয়াবহ। ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীদের বিরুদ্ধে অশোভন কাজে সাধারণ ছাত্রীদের যুক্ত হতে বাধ্য করানোর অভিযোগ উঠেছিল। গত আগস্টেও নির্যাতনের সময় ২ শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছিল সভানেত্রীর বিরুদ্ধে।
'এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পা টাইনা ছিঁড়ে ফেলবো' এই কথার অডিও রেকর্ড ফাঁস করার অভিযোগ তুলে ইডেন কলেজের ২ শিক্ষার্থীকে সাড়ে ৬ ঘণ্টা রুমে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। এসব অপরাধ হচ্ছে, এই কথা কি কলেজ কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ জানতেন না? যখন জেনেছেন, তখন কতোটা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন? কিছুই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে।
আমাদের দেশে এমনিতেই নারীর বিরুদ্ধে কটুক্তি, মন্তব্য ও আচরণ করা হয়। কোন কারণ ছাড়াই নারীকে হেয় করা হয়। সেখানে ইবি'র ছাত্রী হলে ও ইডেন কলেজের রাজনৈতিক হানাহানির ঘটনা সাধারণ মেয়েদের এগিয়ে আসার পথকে রুদ্ধ করে।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলাকালে আমরা দেখেছি ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্র আন্দোলন কতটা শক্তিশালী ও সক্রিয় ছিল। সময় পাল্টেছে, পাল্টেছে ছাত্র রাজনীতির চেহারা। যদি প্রশ্ন করি, ছাত্র রাজনীতি করে গত ২৫/৩০ বছরে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান কতটা বেড়েছে, সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা কতটা লাভবান হয়েছে? হানাহানি, মারামারি, হেলমেট পার্টি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ব্যবসা করা ছাড়া কোন সুস্থ ছাত্র রাজনীতি তো দেখছি না।
সত্যি কথা বলতে ছাত্র রাজনীতির সুস্থ চর্চা হারিয়ে গেছে, যেটা আছে সেটা হলো ক্ষমতা প্রদর্শন। ছাত্ররাজনীতি মানে শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠানের মঙ্গলের জন্য কাজ করার রাজনীতি। শিক্ষায় বরাদ্দ, শিক্ষার মান, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কোনো কথা হয় না, কোন দাবিদাওয়া নেই। সেগুলো নিয়ে ছাত্রনেতাদের কোনো মাথাব্যথাও নেই।
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল ও ইডেন কলেজেসহ বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে যা হচ্ছে, তা ছাত্র রাজনীতি নয়, সেটা অপরাধ ও অন্যায়। আমরা লক্ষ্য করছি শিক্ষামন্ত্রী কোন ঘটনার প্রসঙ্গে মুখ খুলছেন না। নারী সাংসদরা চুপচাপ, নারী অধিকার কর্মীরাও পথে নামছেন না, মহিলা মন্ত্রণালয়ও অসাড় ভূমিকা পালন করছেন। অন্যদিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি তদন্তে প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে বসে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রশাসন নিজেদের গদি বাঁচাতে ব্যস্ত। তাহলে কোন অন্যায়ের বিচার হবে কি? কারা করবে এর বিচার? সত্যি কথা বলতে দোষীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলেই অপরাধীরা দিন দিন লাগামছাড়া হয়ে উঠছে। এরপরেও আমরা প্রার্থনা করি ফুলপরীরা যেন বিচার পায়, কোন দেবদূত যেন তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়।
-
লেখক: যোগাযোগকর্মী