স্ক্রিন টাইম কতক্ষণ রাখা নিরাপদ? কিভাবে বুঝবেন আপনি মোবাইল ফোনে আসক্ত?
দৈনন্দিন জীবনে কমবেশি সবাই যে অনেকটা সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কাটাই, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই; বিশেষ করে ফোনের স্ক্রিনে। এর বাইরেও টিভি, ল্যাপটপ বা নানা ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিনেও তাকিয়ে থাকতে হয়। তবে হাতের মুঠায় থাকায় রোজকার জীবনে মোবাইলের ব্যবহারটা একটু বেশিই।
একই সাথে আরও একটি বিষয়ে সম্ভবত সবাই একমত যে, এই মোবাইল ফোন ব্যবহার দিনের অনেকটা সময় নষ্ট করে দেয় এবং আমাদের উৎপাদনক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এমনকি, ২০২১ ও ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সার্ভেস-এর একটি জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৩১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এবং ৪৬ শতাংশ টিনেজার 'প্রায় সারাক্ষণই' মোবাইলে ব্যস্ত থাকে।
কিন্তু কিভাবে বুঝবেন যে আপনি মোবাইল ফোনে সত্যিই অনেক বেশি সময় ব্যয় করছেন যা আপনার স্বাভাবিক কাজকর্মকে ব্যহত করছে? কখনো কখনো এটা জানা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, কারণ ফোনে মগ্ন হয়ে আমরা বুঝতেই পারি না সময় কিভাবে বয়ে যাচ্ছে! আপনি মোবাইল ফোনে আসক্ত কিনা তা নিজের নিত্যদিনের রুটিনের দিকে চোখ বোলালেই টের পাওয়া সম্ভব।
টিনেজারদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটায়। ঠিক যেমনটা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের জেরোমি ইয়াংকির। ইয়াংকির ভাষ্যে, "প্রথমে এটা আমাকে শারীরিকভাবে ক্ষতি করেছে- কারণ মোবাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রল করতে করতে আমি রাতে ঘুমাতাম না; তারপর দিনের বেলা ঘুমের পেছনে সময় যেত। আমি আমার অবসর সময়ে এর বাইরে তেমন কিছুই করতাম না।"
কিন্তু পরে যখন শারীরিক ক্ষতি থেকে তা মানসিক ক্ষতি করতে শুরু করলো, তখনই তার টনক নড়ে। ইয়াংকি বুঝতে পারলেন, এটা তার সৃজনশীলতা নষ্ট করে দিচ্ছে এবং তার নিজেকে চেনার অনুভূতি কমিয়ে দিচ্ছে। এরপরেই তিনি স্ক্রিন টাইম কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন এবং তা বাস্তবায়নে নিজেকে কোনো ছাড় দেননি তিনি।
শুধু ইয়াংকি একা নন, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টিনেজারদের নিয়ে পিউ রিসার্চ সার্ভেস-এর করা জরিপে দেখা গেছে, এসব টিনেজারদের ৬৭ শতাংশ টিকটক ব্যবহার করে এবং এদের ১৬ শতাংশ 'প্রায় সারাক্ষণ' টিকটক ব্যবহার করে। অন্যদিকে, ইউটিউব ব্যবহারকারী ৯৫ শতাংশ টিনেজারদের মধ্যে ১৯ শতাংশই 'প্রায় সারাক্ষণ' ইউটিউব ব্যবহার করে।
কিভাবে বুঝবেন আপনি মোবাইল ফোনে আসক্ত?
ইন্টারনেটে আসক্তিকে এখনও পর্যন্ত ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়নি। কিন্তু এটি আসলে মেন্টাল হেলথ ডিসঅর্ডার নাকি মেন্টাল হেলথ কন্ডিশন হিসেবে ধরা হবে- তা নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়েই গেছে। এছাড়াও, এটিকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে, কিভাবে পরিমাপ এবং প্রতিকার করা হবে তা নিয়েও অনেকের মনে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
তবে স্ক্রিনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা সত্যিই কোনো 'আসক্তি' হোক বা না হোক; এর নেতিবাচক প্রভাব যে রয়েছে- বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে, সে ব্যাপারে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই একমত।
আর এ ইস্যুতেই ডা. মাইকেল রিচের নাম উল্লেখ করেছেন সিএনএনের লেখক আন্দ্রেয়া কেইন। স্বঘোষিত 'মিডিয়াট্রিশিয়ান' মাইকেল রিচ বোস্টন চিলড্রেনস হাসপাতালের ক্লিনিক ফর ইন্টারঅ্যাক্টিভ মিডিয়া'তে তরুণ 'রোগীদের' চিকিৎসা করেন। তার ভাষ্যে সেসব 'রোগী' মিডিয়া ব্যবহার সংক্রান্ত নানা সমস্যায় ভুগছে।
ডা. রিচ বলেন, "সমস্যাটা তখনই হয় যখন মোবাইলের পেছনে সময় নষ্ট করার ফলে তাদের দৈনন্দিন কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। দেখা যায়, তাদের হয়তো পর্যাপ্ত ঘুম হচ্ছে না। তারা সবকিছুতে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। ঘুমের কারণে স্কুলে যেতে পারছে না বা স্কুলে গিয়ে ঘুমাচ্ছে। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকেও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখছে।"
"আমাদের সমাজে আমরা 'আসক্তি' শব্দটাকে নিন্দনীয় হিসেবে দেখি। আমরা ধরে নেই যে, দুর্বল চরিত্রের দুর্বল মানুষেরাই 'আসক্ত' হয়… এবং আমরা এই আসক্তির প্রতিকার করার চেয়ে এর শাস্তি দেওয়ার কথাই বেশি ভাবি", যোগ করেন ডা. রিচ।
ডা. রিচ মনে করেন না যে তার রোগীদের সমস্যার মূলে রয়েছে প্রযুক্তি। বরং প্রযুক্তি তাদের সমস্যাগুলোকে বাড়িয়ে তোলে। তার রোগীরা যারা উদ্বিগ্নতা, অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা পুরনো দুশ্চিন্তার চাপ ইত্যাদি সমস্যায় ভুগছে, তাদের জন্য কাউন্টারইনট্যুইটিভ চিকিৎসাপদ্ধতি রয়েছে ডা. রিচ এর।
কতক্ষণ স্ক্রিন টাইম নিরাপদ?
২০১৮ সালে জার্নাল অব সোশ্যাল অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি'তে প্রকাশিত এক গবেষণায় ১৪৩ জন কলেজ শিক্ষার্থীর ওপর ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহারের প্রভাব নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এখানে যেসব তরুণদের মধ্যে শুরুতেই বিষণ্ণতার উপসর্গ দেখা গেছে, তাদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার কমিয়ে প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে ১০ মিনিট করা হয়। তিন সপ্তাহে দৈনিক মাত্র ৩০ মিনিট করে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের পর দেখা গেছে, তাদের বিষণ্ণতা ও একাকীত্বের উপসর্গ কমে এসেছে।
টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের খণ্ডকালীন সহকারী শিক্ষক ইয়ালডা টি. ইউলস বলেছেন, কারো স্ক্রিন-টাইম মাত্রাতিরিক্ত কিনা তা বুঝতে চাইলে নিজেকে ৫টি প্রশ্ন করুন:
- আপনার কি ভালো ঘুম হচ্ছে?
- আপনি কি ভালোভাবে খাওয়াদাওয়া করছেন?
- আপনার কাজকর্ম কি ঠিকঠাক চলছে?
- আপনি কি ঘর থেকে বেরিয়ে বন্ধুবান্ধব-পাড়াপ্রতিবেশীদের সাথে দেখা করছেন?
- আপনি কি শারীরিকভাবে সক্রিয়?
তাই স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবার আগে নিজের প্রাত্যহিক রুটিন খেয়াল করতে হবে। এছাড়াও, ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা আগে স্ক্রিনের দিকে না তাকানো, কাজ করতে করতে প্রতি ২০ মিনিট পর পর স্ক্রিনে তাকানো থেকে বিরতি নেওয়া এবং নিজে মা-বাবা হলে সন্তানদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্যও স্ক্রিন টাইম আরও কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা উচিত।
সূত্র: সিএনএন ও টাইম