রাতের ঘুম ভালো হলে স্মৃতিশক্তি বাড়ে, এ দাবি কি সত্যি?
ইংরেজ কবি এবং ঔপন্যাসিক শার্লট ব্রন্টি লিখেছিলেন, 'অস্থির মন একটি অস্থির বালিশের সৃষ্টি করে।' মন উতলা কিংবা বিক্ষিপ্ত থাকলে আমাদের বালিশও তেমন হবে—এ আবার কেমন কথা! কিন্তু কবি যথার্থই বলেছেন।
একটু ব্যাখ্যা করা যাক। মাঝেমধ্যে আমরা অস্থির হয়ে পড়ি। কর্মব্যস্ত জীবনের বিরতিহীন ছুটোছুটি, হাসির আড়ালে লুকানো নানা দুশ্চিন্তা, যাপিত জীবনের অসফলতা—এরকম নানা কারণ আমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। নির্ঘুম চোখ নিয়ে এপাশ-ওপাশ করতে করতে রাত পার করি। কবি ঠিক এটাই বোঝাতে চেয়েছেন।
রাতের ভালো ঘুম বলবর্ধক ঔষধ হিসেবে কাজ করে। বিজ্ঞানজগতে এটি দীর্ঘদিন ধরে স্বীকৃত যে রাতের ঘুম আমাদের শেখার দক্ষতা ও স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। কিন্তু ঠিক কীভাবে রাতের ঘুম আমাদের স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করে? এ প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক উত্তর বেরিয়ে এসেছে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এল পাইস-এর এক প্রতিবেদনে।
অতিসম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, গভীর ঘুমের প্রাথমিক পর্যায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ইউনিভার্সিটি অভ ফ্রিবোর্গ-এর অধ্যাপক ড. বিজোর্ন রাশ জানান, 'সন্ধ্যায় আপনি যা কিছু শেখেন সেগুলো রাতে ঘুমের সময় পুনরায় সচল হয়ে ওঠে।'
এই সুইস বিজ্ঞানী আরও জানান, 'স্মৃতিরোমন্থন এবং নেতিবাচক চিন্তা আমাদের ঘুম অগভীর করে দেয়। যার ফলে যতটুকু ঘুমাতে চাই তার আগেই আমরা জেগে যাই। এমনকি মাঝে মাঝে দেখা যায় ঘুম বারবার ভেঙে যাচ্ছে।
পুনঃসচল চিন্তা
তবে কিছু স্বস্তির ব্যাপারও আছে। ঘুমন্ত অবস্থায় ব্রেইন সার্কিটে ইতিবাচক চিন্তাও পুনরায় সচল হয়ে ওঠে, যা ভালো ঘুমের একটি কারণ। ঘুমন্তকালে পূর্বচিন্তা (ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক) সচল হওয়ার এই ধারণাটিকে ঘিরে ড. রাশ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর ওপর একটি নিরীক্ষা করেন।
শিক্ষার্থীরা নিরীক্ষার অংশ হিসেবে চারটি আরামদায়ক খাটসংবলিত একটি ঘুমের ল্যাবরেটরিতে রাত্রিযাপন করেন। প্রতি রাতের জন্য তদের প্রত্যেককে ৫০ সুইস ফ্রাঁ দেওয়া হয়েছিল। ব্রেইন তরঙ্গগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্য তাদেরকে একটি ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এর পাশাপাশি তারা এবং তাদের পেশি ঘুমের কোন পর্যায়ে আছে, সেটিও পর্যবেক্ষণ করা হয়।
এছাড়াও নিরাপত্তা ও বিশ্রাম-সংক্রান্ত শব্দসংবলিত হিপনোটিক টেপ বাজানো হয়। টেপগুলোতে গভীর পানিতে মাছে সাঁতার কাঁটার মতো কিছু আরামদায়ক কাল্পনিক দৃশ্যও ছিল।
ফলাফলে দেখা যায়, এই হিপনোটিক টেপ শোনার পর শিক্ষার্থীরা গভীরতর ঘুমের ধীর-তরঙ্গের পর্যায়ে বেশি অবস্থান করেছিলেন। টেইপগুলো থেকে শোনা আরামদায়ক ও আশ্বাসদায়ক চিন্তা ঘুমন্ত অবস্থায় পুনরায় সচলের জন্য এমনটা ঘটেছে।
তবে মনের ভার হালকা করার এই কৌশলগুলো মানুষকে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু ঘুমের গুণগত মানে কোনো পার্থক্য আনে না বলে জানান ড. রাশ। তিনি ভবিষ্যতের গবেষণায় অনিদ্রায় (ইনসোমনিয়া) ভোগা ব্যক্তিদের সাহায্য করতে চান।
তার মতে, 'এরূপ গবেষণা ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য না করলেও তাদের ঘুম গভীর ও শান্তিপূর্ণ করতে পারে। এছাড়াও এগুলো বিভিন্ন মানসিক অসুস্থতায় ভোগা (যেমন পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডি) ব্যক্তিদের সাহায্য করতে পারে।'
সিন্ধুঘোটক এবং শেখা
আমাদের ব্রেইনে সীহর্স বা সিন্ধুঘোটক আকৃতির একটি অংশ আছে যেটিকে বলা হয় হিপোক্যাম্পাস (সীহর্সের গ্রীক শব্দ)। এই অংশটি আমাদের শেখা ও স্মৃতিশক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞানীরা প্রায়ই ঘুমিয়ে থাকা তীক্ষ্ণদন্তীপ্রাণীর হিপোক্যাম্পাস তদারক করতে ব্যবহার করেন। যেমন, ইঁদুর। এই প্রাণীটি খাবার খুঁজতে গেলে গোলকধাঁধার মাঝেও পথ মনে রাখতে পারে। এক্ষেত্রে হিপোক্যাম্পাসই মনে রাখার প্রধান চাবি।
অস্ট্রিয়ার ইন্সটিটিউট অভ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি-র পোস্টডক্টোরাল ফেলো ড. হুয়ান রামিরেজ ভিলেগাস স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্ক কীভাবে স্মৃতি সংরক্ষণ করে, তা পরীক্ষা করে দেখতে তীক্ষ্ণদন্তীপ্রাণী ব্যবহার করেন। তার এই কাজের ফলাফল আলঝেইমারের মতো রোগ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারার সম্ভাবনা রয়েছে।
ড্রিম নামক একটি প্রজেক্টে তিনি আবিষ্কার করেন, ব্রেইনস্টেম নামে মস্তিষ্কের আরেকটি অংশ রয়েছে যেটি হিপোক্যাম্পাসের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম এবং এটি আগেভাগেই সচল হয়ে যায়।
রামিরেজ বলেন, ব্রেইনস্টেম কিছু দৃশ্য স্থাপন করে দেয় যার ফলে ঘুমের বিভিন্ন পর্যায়ে হিপোক্যাম্পাস পুনরায় স্মৃতি সচল করতে পারে। গোলকধাঁধায় চলা ও ঘুমের সময় ইঁদুরের ব্রেইনের কার্যক্রম রেকর্ড করার জন্য রামিয়েজ তাদের ইলেক্ট্রোডের সাথে সংযুক্ত করে দেন। ঘুম তাদের ব্রেইনে দিনের বেলার ঘটনাগুলো পুনঃপ্রদর্শন করে দীর্ঘমায়েদি স্মৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়।
ফলাফলে দেখা যায়, শেখার সময় তাদের ব্রেইনসেল যে ক্রম অনুযায়ী কাজ করে, ঘুমের সময়ও ঠিক সেভাবেই কাজ করে। তবে ঘুমের সময়ে সেলগুলো তুলনামূলকভাবে সংকুচিত থাকে। বিষয়টিকে বেশ আকর্ষনীয় মনে করেন রামিরেজ।
আমরা কীভাবে মনে রাখি?
রামিরেজের গবাষণার এই ফলাফল বেশ বিস্ময়কর। কারণ এটি নির্দেশ করে যে, ব্রেইনস্টেম উদ্দীপনা তৈরি ও স্মৃতি গঠনে কাজ করে। তীক্ষ্ণদন্তীপ্রাণীদের মতো স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রেও এটি সত্যি হতে পারে। অর্থাৎ মানুষের ক্ষেত্রেও ব্রেইনস্টেমের কাজটি মৌলিক মেকানিজম হতে পারে।
মানুষের ব্রেইনের মৌলিক কার্যাবলি বুঝতে এই গবেষণাটি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া এর কিছু ক্লিনিক্যাল উপকারিতাও থাকতে পারে। রামিরেজ বলেন, আমরা স্মৃতিধারণ পদ্ধতির মৌলিক নীতিগুলো বুঝতে সক্ষম হচ্ছি। হয়তো স্মৃতিসংক্রান্ত অসুস্থতার প্রভাব কমাতেও আমরা এগুলো ব্যবহার করতে পারব।