কম কাজ মানুষকে আরও অসুখী করে তোলে!
কর্মীরা বার্নড আউট হয়ে পড়ছেন। তাই যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় যখন উঠে এল যে চার দিনের কর্মসপ্তাহের ফলে তাদের কর্মীরা আরও সুখী হয়ে উঠেছেন, তাতে স্বাভাবিকভাবেই সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল।
সপ্তাহে চার কর্মদিবসের সুযোগ না থাকায় আগের চেয়ে বেশিসংখ্যক আমেরিকান এখন খণ্ডকালীন চাকরি বেছে নিচ্ছেন, পূর্ণকালীন চাকরির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও।
মনে হচ্ছে, কম কাজ করার যুগ আসন্ন। মহামারির প্রাদুর্ভাবের আগেও আমেরিকানরা কাজের পরিমাণ কমিয়ে আনছিলেন। সত্যি বলতে কী, কাজের পেছনে আমরা কখনও এত কম সময় ব্যয় করিনি। কাজেই আমরা যদি বার্নড আউট হয়ে পড়ি, তাহলে তার কারণ কাজ না-ও হতে পারে।
কম কাজ করার আকাঙ্ক্ষা বয়স শ্রমের ইতিহাসের সমান। ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কিনেস পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, তার নাতি-নাতনিদের সপ্তাহে মাত্র ১৫ ঘণ্টা কাজ করতে হতে পারে, কারণ তাদের অধিকাংশ কাজই করে দেবে প্রযুক্তি। আমরা এখনও সপ্তাহে দিনে ১৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করলেও তার পূর্বাভাস একেবারে ভুল হয়নি। কর্মঘণ্টার সময় কমে আসার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
প্রযুক্তি শ্রমকে নিঃসন্দেহে আগের চেয়ে বেশি উৎপাদনশীল করেছে। যেমন মহামারিকালে অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘরে বসে কাজ করতে পেরেছেন। এতে সময় বেঁচেছে অনেক।
অর্থনীতিবিদ মার্ক অ্যাগুইয়ার ও এরিক হার্স্টের এক সমীক্ষায় প্রাক্কলন করা হয়, ১৯৬৫ সালে ২১ থেকে ৬৫ বছর বয়সি পুরুষরা সপ্তাহে ৫১ ঘণ্টা কাজ করতেন; ২০০৩ সাল নাগাদ তা ৩৯.৯ ঘণ্টায় নেমে আসে। শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশ কম। তবে ১৯৬০-এর দশক থেকে শ্রমশক্তিতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। অনেকে খণ্ডকালীন চাকরি করছেন। এর সুবাদে ২০০৩ সাল নাগাদ চাকরিতে নারীদের সাপ্তাহিক গড় কাজের পরিমাণ ২০ ঘণ্টা থেকে বেড়ে ২৬.৩ ঘণ্টা হয়।
ওই একই সমীক্ষায় ঘর-গেরস্থালির কাজের পরিমাণও হিসাব করা হয়। এতে দেখা যায়, নানা প্রযুক্তির কল্যাণে গৃহস্থালি কাজের পেছনে সময় ব্যয় অনেকখানিই কমে এসেছে। সব ধরনের কাজ যোগ করার পর দেখা গেল, পুরুষদের কর্মঘণ্টা কমেছে ৭.৬ ঘণ্টা আর নারীদের কমেছে ৬.৪৪ ঘণ্টা।
কম কাজের সুফল হলো অবসর সময় বেশি পাওয়া। ১৯৬৫ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে পুরুষদের অবসর সময় প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। নারীদের অবসর সময় বেড়েছে ১০ শতাংশ—যদিও ১৯৯০-এর দশকে তা আবার কমতে থাকে। কারণ এ সময় থেকে নারীরা সন্তানদের পেছনে আরও বেশি বেশি সময় দিতে থাকেন। ১৯৬০-এর দশকে নারীরা সন্তানদের পেছনে যতটুকু সময় দিতেন, এখন তারচেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি সময় দেন।
একটা মজার তথ্য দেওয়া যাক। ১৯৬৫ সালে স্বল্পশিক্ষিত পুরুষরা বেশি সময় কাজ করতেন, কিন্তু এই ধারা এখন উল্টে গেছে। এখন বেশি উপার্জনকারী পুরুষরা বেশি কাজ করেন। ২০০৩ সাল নাগাদ শিক্ষিত পুরুষরা হাই স্কুলের ডিগ্রিবিহীন পুরুষদের চেয়ে পাঁচ ঘণ্টা বেশি সময় কাজ করতে আরম্ভ করেন। এখনও এই ধারা অব্যাহত আছে। ২০১৮ সাল নাগাদ স্বল্পশিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত পুরুষদের মধ্যে কাজে পরিমাণের ব্যবধান আরও কমে আসে।
আমরা যদি চার কর্মদিবসে যাই, তাহলে বেশি উপার্জনকারীরা কম কাজ করে পোষাতে পারবেন। কিন্তু সমগ্র অর্থনীতির জন্য এ ব্যবস্থা বাস্তবসম্মত নয়। ঘণ্টাভিত্তিতে কাজ করেন এমন অনেক কর্মী—যারা কম আয় করতে ইচ্ছুক—তাদের কর্মঘণ্টা সপ্তাহে ২০ শতাংশের বেশি কমাতে পারেন না। আর সবচেয়ে বেশি বেতন পাওয়া কর্মীরাও সম্ভত এ পরিমাণ কর্মঘণ্টা কমাতে পারবেন না।
সপ্তাহে চার কর্মদিবসের রীতি চালু হলে অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রযুক্তি আমাদের বেশি উৎপাদনশীল করে। তাই আমরা কম সময়ে বেশি উৎপাদনশীল কাজ করতে পারি। কিন্তু কাজের পরিমাণ ২০ শতাংশ কমে গেলে এই উৎপাদনশীলতা দিয়ে সেই ক্ষতি পোষাতে পারার সম্ভাবনা কম। যুক্তরাজ্যের গবেষণায় বলা হয়েছে, ক্ষতি পোষানো সম্ভব। কিন্তু গবেষণাটি করা হয়েছে সীমিত পরিসরে—এবং এতে অংশ নেওয়া ৮৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই মার্কেটিং, পেশাদার সেবা, প্রশাসন, দাতব্য অথবা অলাভজনক খাতের। এ দিয়ে সমগ্র অর্থনীতিকে বিচার করা যায় না। অধিকাংশ চাকরির ক্ষেত্রে কম কাজ মানেই কম ফলাফল। যার অর্থ হলো, কম পণ্য ও সেবা। এতে শ্রমিক ঘাটতির পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়, বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি।
যুক্তরাজ্যের সমীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোও অভিযোগ করেছে যে সপ্তাহে চার কর্মদিবসের ফলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, কারণ পৃথিবীর বাকি সবাই পাঁচ দিন কাজ করে। আর যেসব প্রতিষ্ঠান কর্মীদের সাপ্তাহিক ছুটি নিজেদের সুবিধামতো বেছে নিতে দেয়, ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কর্মী সমন্বয় করতে সমস্যা হয়েছে।
কাজেই আমাদের অর্থনীতি কাজের পরিমাণ ২০ শতাংশ কমাত প্রস্তুত নয়। তবে কম কাজ করেও বার্নড হয়ে পড়ার প্রবণতা আসলেই রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমনটি হচ্ছে কেন? আগের প্রজন্মের চেয়ে কম কাজ করে এবং বেশি অবসর কাটিয়েও মানুষ কীভাবে বার্নড আউট হয়ে পড়ছে?
এর কারণ সম্ভবত এ-ই যে, কর্মঘণ্টা কমলেও আমরা আদতে কখনোই প্রকৃত অবসর বা বিরতি পাইনি। বাবা-মায়েরা সন্তান লালন-পালনে আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি সময় দেন। এছাড়া আমাদের অবসর সময় কাটানোর ধরনও বদলে গেছে। বেশি ছুটি পেলেও আগে অবসর কাটিয়ে মানুষ যেরকম চাঙা হয়ে উঠত, এখন আর সেরকম চাঙা হতে পারছে না। এই অবসরটা আমরা কাটাই স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকে, উত্তেজনাপূর্ণ ভিডিও গেমস খেলে। বই পড়ায় অথবা পরিচিতদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার পেছনে আমরা এখন কম সময় ব্যয় করি। এই প্রবণতাগুলো কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের অতিরিক্ত উদ্বেগ ও অসুখী হওয়ার সঙ্গে জড়িত।
যে পদ্ধতিতে আমরা কাজের বাইরের সময়টা কাটাই, সেটাই সম্ভবত আমাদের ক্লান্ত করে তুলছে—আমরা কত ঘণ্টা কাজ করছি সেটি নয়। বাড়িতে বসে কাজ করায় এই পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হতে পারে। কারণ 'হোম অফিস' করার ক্ষেত্রে একদিকে যেমন সময় বাঁচে ও বেশি উৎপাদনশীল হওয়া যায়, অন্যদিকে তেমনি স্ক্রিনে এবং একাকী সময় কাটানোর পরিমাণও বেড়ে যায়। এই বিষয়টি অনেকদিক থেকে ব্যঙ্গাত্মক। জন কিনেস আশা করছিলেন, প্রযুক্তি আমাদের কাজ থেকে মুক্তি দেবে। হ্যাঁ, প্রযুক্তি আমাদের কাজ কমিয়েছে, অবসর সময় বাড়িয়েছে, কিন্তু একইসাথে আমাদেরকে বার্নড আউট ও অসুখী করে তুলছে।'
- ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ