সরকার নির্বাচনে পরাজয়ের ভয় করছে: নিজের জীবনের হুমকির কথা জানিয়ে ইমরান খান
চলতি বছরের শেষের দিকে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি। লাহোরে ইমরান খানের নির্বাচনী র্যালিকে কেন্দ্র করে পুলিশ তেহরিক-ই-ইনসাফের অসংখ্য সমর্থককে আটক করেছে। ইতোমধ্যেই দলটির কর্মীদের একজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহতের সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ, দেশটির বর্তমান সরকার পরাজয়ের ভয়ে তাকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
লাহোরে ইমরান খানের র্যালিকে কেন্দ্র ১৪৪ ধারা জারি করে জনসমাগম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার। এমতবস্থায় গতকাল (বুধবার) তেহরিক-ই-ইনসাফের কর্মীরা র্যালি করতে আসতে থাকলে পুলিশ কর্মীদের ওপর টিয়ার গ্যাস ও জলকামান নিক্ষেপ করে। এ ঘটনার পর ইমরান খান র্যালির সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে।
গত মঙ্গলবার আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইমরান খান বলেন, "বর্তমান সরকার ও তার সহযোগিরা আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ভীত। কেননা শেষ আট মাসে অনুষ্ঠিত ৩৭ টি উপনির্বাচনের মধ্যে আমার দল ৩০ টিতে জয়লাভ করেছে।"
পাকিস্তানের সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী লাহোরে নিজের বাসভবনে আরও বলেন, "তারা আমাকে গ্রেপ্তার অথবা অযোগ্য ঘোষণা করে নির্বাচন থেকে বাতিল করতে চায়। কেননা আমার রাজনৈতিক দল বর্তমানে পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় দল। আর তাই তারা আমার দলকে ভয় পাচ্ছে।"
আগামী ৩০ এপ্রিল পাঞ্জাবে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আর এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তেহরিক-ই-ইনসাফের পক্ষ থেকে নির্বাচনী র্যালি করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু র্যালি শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পূর্বে 'অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়ার' অজুহাত দেখিয়ে তা করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন।
এ প্রসঙ্গে ইমরান খান বলেন, "পুলিশের পক্ষ থেকে র্যালির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এবং এর রুটও নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু আজ সকালেই এ অনুমতি বাতিল করা হয়েছে। বিপুল পরিমানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে এবং যেসব কর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবে এ র্যালিতে অংশ নিতে আসছিল তাদের উপর আক্রমন ও টিয়ার গ্যাস-জলকামান নিক্ষেপ করা হয়েছে।"
ইমরানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তার দলে আলি বিলাল নামের এক কর্মীকে পুলিশি হেফাজতে হত্যা করা হয়েছে। আল-জাজিরা দাবিটির সত্যতা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি। অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি।
সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রধান নির্বাহী ইমতিয়াজ গুল মনে করেন, তেহরিক-ই-ইনসাফ এর কর্মীদের ওপর পুলিশের এ হামলা একদিকে 'অপ্রয়োজনীয়' এবং অন্যদিকে 'নির্মম'। গুল আরও বলেন, "তেহরিক-ই-ইনসাফ কর্মীদের র্যালিতে অংশ নিতে বাধা দিতে বিপুল পরিমানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। সরকারের কার্যক্রম ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, তারা পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায়।"
প্রদেশ দুটির জনসংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগ। এ প্রদেশ দুটির প্রাদেশিক পরিষদ বিলুপ্ত ঘোষণার পর আসন্ন ৩০ এপ্রিল নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে হয়েছিল।
প্রদেশ দুটিতে মূলত ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই-ইনসাফই ক্ষমতায় ছিল। তবে অক্টোবরে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, সেটিকে আরও এগিয়ে আনতে চাপ প্রদানের অংশ হিসেবে মূলত এ প্রদেশ দুটিতে পরিষদ ভেঙে দেয় ইমরান খান।
অন্যদিকে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ ইমরানের খানে আগাম নির্বাচনের দাবি নাকচ করে জানান, নির্বাচন নির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠিত হবে।
ইমরান খান আল জাজিরাকে বলেন, "এটা স্পষ্ট যে, সরকার নির্বাচন চায় না। আমি আমার কর্মীদের জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে র্যালি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
'আমার জীবন হুমকির মুখে'
গত বছরের এপ্রিলে ৭০ বছর বয়সী ইমরান খান পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনাস্থা ভোটে হেরে পদ প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অব্যাহতি পর তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, হত্যা চেষ্টা ও জঙ্গিবাদের অভিযোগে অসংখ্য মামলা করা হয়েছে।
ইমরান খান এসব মামলাকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। একইসাথে তাকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরানোর জন্য এসব মামলা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন।
পাকিস্তানের সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, "আমার বিরুদ্ধে ৭৬ টি মামলা করা হয়েছে। আমি কতটি মামলায় কোর্টে হাজিরা দেব? আমি বহু মামলায় কোর্টে হাজিরা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কেননা গত চার মাস আগে আমাকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। আমার পায়ে তিনটি বুলেট ছিল এবং আমি ঠিকমতো হাটতেও পারতাম না।"
গত বছরের নভেম্বরে ইমরান খানের ওপর এ হত্যাচেষ্টার পর থেকে তিনি লাহোরে বসবাস করছেন। এর মধ্যে তিনি শুধু গত সপ্তাহে কোর্টে মামলার হাজিরা দিতে একবার ইসলামাবাদ গিয়েছিলেন।
ইমরান খান জানান, তিনি কোর্টে উপস্থিত হওয়ার সময় বারবার নিরাপত্তা চাইলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি। ইমরান খান বলেন, "আমার জীবন হুমকির মুখে রয়েছে। কেননা আমাকে যারা হত্যা করতে চায়, তারা ক্ষমতায় রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এমতবস্থায় আমি কীভাবে নিরাপদে, নির্বিঘ্নে আমার নির্বাচনী ক্যাম্পেইন পরিচালনা করবো? আমি কোর্টে কীভাবে যাবো? আমি তিনবার কোর্টে হাজিরা দিয়েছি এবং দুর্ভাগ্যবশত সেখানে কোনো নিরাপত্তা ছিল না।"
যদিও পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ ইমরান খানের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। গত মঙ্গলবার ইসলামাবাদের হাইকোর্ট ইমরান খানের বিরুদ্ধে যে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়েছিল সেটি প্রত্যাহার করেছে। মূলত প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বৈদেশিক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া উপহার অবৈধভাবে বিক্রি করার অভিযোগে করা মামলায় এ গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল।
ইসলামাবাদ হাইকোর্টের একটি একক বেঞ্চ ১৩ মার্চ পর্যন্ত ইমরান খানের গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছে। একইসাথে পাকিস্তানের সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীকে ১৩ মার্চের আগে কোর্টে হাজির হতে বলা হয়েছে।
সূত্র: আল জাজিরা