নতুন রুটিনে যেভাবে সময় কাটছে ক্রিকেটারদের
হঠাৎ-ই সব থমকে গেছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপে বদলে গেছে সবকিছু। চেনা পৃথিবীই এখন ভিন গ্রহর মতো। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত বন্ধ, রাস্তাঘাটে নেই কোলাহল। বিরাণভূমি হয়ে পড়ে আছে খেলার মাঠগুলো। চোখের সামনে ফাঁকা মাঠ পড়ে আছে দেখেও সেখানে গিয়ে অনুশীলনের সুযোগ নেই খেলোয়াড়দের।
অন্যান্য খেলার মতো দেশের সব ধরনের ক্রিকেট অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত আছে। ঘরবন্দি অবস্থায় সময় কাটছে ক্রিকেটারদের। বাইরে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়েই নতুন রুটিন বানিয়ে নিতে হয়েছে ক্রিকেটাদের। নতুন রুটিনে কীভাবে দিন কাটছে, কী কী করছেন; এসব নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় দলের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার।
মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন
পরিবারের সাথেই সময় কাটছে। পাশাপাশি জিমের একটা শিডিউল দেওয়া হয়েছে আমাদের ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য, সেটা করা হচ্ছে। তো এটাই এখন মূল কাজ।
সকালে ফজরের নামাজ পড়ার চেষ্টা করি। ইনশা আল্লাহ প্রতিদিনই পড়ি। নামাজ পড়ার পর আর ঘুমানো হয় না। আগে একদমই বের হতাম না, বাসার ছাদে দৌড়াতাম। কিন্তু ছাদে সেভাবে দৌড়ানো যায় না। দুইদিন দৌড়ানোর পর হ্যামস্ট্রিং, কাপ এসব শক্ত হয়ে যায়। এই জন্য পরিকল্পনা করলাম যে, ভোরবেলায় যেহেতু মানুষজন থাকে না, তখন বের হবো। যখন একটু আলো হয়, সাড়ে ৫টা বা পৌনে ৬টার দিকে আমার ছোট ভাইকে নিয়ে বের হয়ে যাই।
আমাদের বাসার পাশে ফেনি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। এটার একটা মাঠ আছে। এই মাঠে গিয়ে দৌড়াই, ফিটনেসের কাজ করি। এরপর সাড়ে ৬টা বা সাতটার একটু আগে ফিরে আসি। এরপর বাড়িতে এসে গোসল করে নাস্তা করি। এরপর এক ঘণ্টার একটা বিশ্রাম।
বিশ্রাম শেষে বোর্ডের ফিজিওর দেওয়া নির্দেশনা মেনে কাজ করি। এরপর ঘুম এলে একটু ঘুমাই। না হলে পরিবারের সাথে আড্ডা দেই। যোহরের নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খাই। এরপর একটু টিভি দেখি। বিকেল বেলায় আসরের নামাজটা পড়ার পর একটু ছাদে যাই। ছোট ভাইয়ের সাথে টেপ টেনিসে শর্ট পিচ খেলি। এরপর মাগরিবের নামাজ। এই তো আসলে রুটিন। এভাবেই কাটছে সময়।
মাঝে অন্য খেলাও খেলি, ক্যারম খেলা হয়। আমার সব খেলাই ছোট ভাইয়ের সাথে। ওর সাথে ১০-২০ টাকায় বোর্ড বাজি খেলি। যদিও ওর কাছ থেকে টাকা নিই না। কম্পিটিশনটা যেন ভালো হয় এ জন্য আর কি এই বাজি। এ ছাড়া আমার কিছু বন্ধু আছে, ছোট ভাই আছে; এদের সাথে অনলাইনে লুডু খেলি। এভাবে আরকি সময় পার হয়ে যাচ্ছে।
তাসকিন আহমেদ
ঘুরেফিরে সেই একই কথা আসবে। সারাদিন করার মতো তেমন কোনো কাজ তো নেই। নামাজ পড়ে, পরিবারের সঙ্গে থেকে সময় কাটছে। প্রতিদিন এক ঘণ্টা রেখেছি ওয়ার্ক আউটের জন্য। এটা নিয়ম করেই মানছি। আমরা যারা জাতীয় দলের খেলোয়াড় আছি, প্রত্যেককে আলাদা প্রোগ্রাম দিয়ে দিয়েছে। ওসব করা হচ্ছে।
যেগুলো ঘরে করা যায়, ওই হিসাব করেই প্রোগ্রাম দিয়েছে। তো ওটা মেনে চালিয়ে যাচ্ছি। এখন তো বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না, সেই সুযোগ নেই। কারণ, দেশের অবস্থা মোটেও ভালো নয়। বাইরে বের হলে এটা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। এ কারণে সবারই ঘরে থাাকাটা জরুরি।
আমার আসলে ঘরের খেলা সেভাবে খেলা হয় না। আমার মা, বোন, স্ত্রী; ওরা লুডু খেলে মাঝেমধ্যে। তবে সবাই এক সাথে মুভি দেখি। এই সময়ে অনেক মুভি দেখা হচ্ছে। প্রতিদিন না হলেও দুই দিনে একটা মুভি দেখা হচ্ছে। ফোনে একটা ক্রিকেট গেম আছে, ওটা খেলি।
নুরুল হাসান সোহান
আসলে এখন তো অফুরন্ত সময়। আগে যা কখনই সম্ভব ছিল না, এখন সেই সময়টাই পাচ্ছি। আর পুরোটাই পরিবারের পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে। চাইলেও অন্য কোথাও গিয়ে সময় কাটানোর সুযোগ নেই। তো সকালে উঠে বাচ্চাকে নিয়ে একটু খেলি। এরপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করি।
দুপুরে তেমন কিছু করা হয় না। বিকালে একটু রানিং করি। বাসার যতটুকু কাজ করা যায় সেটা করি। সন্ধ্যার পর মাঝে মাঝে একটু বের হই। সুযোগ থাকলে দুই একজন বন্ধুর সাথে দেখা করি। অবস্থা খুবই খারাপ, সেভাবে আসলে মুভ করার সুযোগ নেই।
এলাকার অবস্থা দেখার জন্যও মাঝে মাঝে বের হই। কয়েকদিন আগে বের হয়েছিলাম, কালও বের হয়েছি। সব জায়গা শ্মশানের মতো হয়ে গেছে। কোথাও কোনো মানুষ নেই। আমাদের সামনে একটা উঠোন আছে। তো সবাই মিলে এখানে একটু-আধটু ক্রিকেট খেলা হয়। টেপ টেনিসে খেলেছি। এটাই করতে হবে, বাইরে তো বের হওয়া যাচ্ছে না এখন।
এর বাইরে লুডু খেলা হয়। আমার কাজিন, বোন, সবাই মিলে লুডুটা খেলা হয়। যেটা বললাম আগে, যা করার সুযোগ হয়নি, এখন সেটা হয়েছে। যদিও এভাবে কেউ চায়নি। তো অপেক্ষা করতে হবে, সচেতন থাকতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।
আকবর আলী
আসলে জীবনে কোনো বৈচিত্র নেই এখন। প্রতিদিনই এক কাজ। বাইরে যাওয়ার সুযোগ না থাকলে জীবন কতটা রঙহীন হতে পারে, এটা হয়তো সবাই এখন বুঝতে পারছে। প্রতিদিনই এক কাজ করতে হচ্ছে সবাইকে। আমি যেমন প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করি। এরপর মুভি দেখা শুরু করি।
সময় পার করার জন্য প্রতিদিনই মুভি দেখা হচ্ছে। বলা যায় নিয়ম করেই মুভি দেখা হচ্ছে। এরপর দুপুরে যাই করি, বিকালে ফিটনেস নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। বিকালে আমাদের ট্রেইনার রিচার্ড স্টয়নার ইনস্টাগ্রামে ওয়ার্ক আউট করাচ্ছে, ওসব করছি। যেসব ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করা যায়, ওসব করাচ্ছে। তো এসব নিয়মিত করছি।
এরপর সন্ধ্যায় বাসায় গেম খেলেই সময় কাটছে। পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে দাবা বা কার্ড খেলে সন্ধ্যার সময়টা কাটছে। ক্রিকেট খেলার সুযোগটা কম। কদিন আগেও বাড়ি উঠোনে শর্ট পিচ খেলতাম। কিন্তু এখন সেটারও সুযোগ নেই। কারণ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বাড়ির উঠোনে ৭-৮ দিন ক্রিকেট খেলেছি। কিন্তু এখন টানা ৪-৫ দিন ধরে বৃষ্টি। তো ওই অপশনও বন্ধ হয়ে গেছে।
আবু হায়দার রনি
আসলে আগের মতো কিছুই নেই। সব পরিবর্তন হয়ে গেছে। খেলাধুলা নেই, খারাপ লাগছে। এখন তো কিছু করার নেই। পরিবারকে সময় দিচ্ছি, যতটুকু সম্ভব হয় বাসাতেই ওয়ার্ক আউট করার চেষ্টা করি। ঘুম থেকে এখন একটু দেরিতে উঠি। কারণ এখন আর সকালে ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই।
ছাদে গিয়ে ওয়ার্ক আউট করার চেষ্টা করি। একটা দড়ির মধ্যে বল লাগিয়ে নিয়েছি। সেখানে একটু ব্যাটিং শ্যাডো প্র্যাকটিস করি। এভাবেই আসলে দিন কাটছে। বেশি কিছু করার নেই এখন। সবাই তো ঘরবন্দি।
কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠেছি। কারণ আমরা যারা খেলোয়াড়, ইনজুরি না হলে কখনই এভাবে ঘরে থাকিনি। ইনজুরি না হলে এতটা সময় কখনই ঘরে থাকা হয়নি। তো এতদিন হয়ে যাওয়ায় খারাপ লাগছে, বিরক্তি কাজ করছে।
বাসায় এসেই আমি একটা ক্যারম কিনেছি। এখানে আমরা সবাই মিলে ক্যারম খেলি। একটা লুডুও কিনেছি। কী আর করব, সময় তো পার করতে হবে। এই তো লুডু খেলি, ক্যারম খেলি। অনলাইনেও বন্ধুদের সাথে লুডু খেলা হয়। পাবজি খেলা হয়। সিনেমাও দেখা হচ্ছে। তো এভাবেই সময় পার করছি।
নাঈম হাসান
জিম আর স্কিপিং করেই দিন পার হচ্ছে। এখন রোজা শুরু শুরু হয়েছে। তো ইফতারি করে জিম করি। গতকাল এভাবেই করেছি। আজ আবার দুপুরেই জিম করে নিয়েছি। কারণ আফতারির পর তো কম সময় পাওয়া যায়। বাসায় তারাবি পড়ি। হুজুর বাসায় এসে খতম তারাবি পড়ান। সময় কম থাকায় দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে জিম করে নিই।
বাসায় কখনই তো এত সময় ধরে থাকা হয় না। বিরক্তি চলে এসেছে। কারণ কম সময় তো গেল না। এভাবে আর কতদিন। মাঠে না যেতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বিরক্তি লাগবে। আমরা যারা ক্রিকেটার, খেলার মধ্যে না থাকতে পারলে বিরক্তি কাজ করে।
আসলে যে খেলাটা সারা বছর খেলি, সেটাই না খেলতে পারলে অন্য কোনো খেলা আর টানে না। এই অবস্থার শুরুর দিকে লুডু খেলা হতো। এখন আর খেলি না। সিনেমাও তেমন দেখা হয় না। জিম করি, রানিং করি, সময় পেলে স্কিপিং করছি। এরপর বল হাতে নিয়ে ঘুরাই। ব্যাট নিয়ে শ্যাডো করি আয়নার সামনে। তো এভাবেই সময় কাটছে।
বাড়ির সামনে বোলিং করার সুযোগ ছিল। কয়েকদিন বোলিংও করেছি। কিন্তু বৃষ্টির কারণে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে করা হচ্ছে না। টিমমেটদের সাথে মাঝেমধ্যে কথা হয়। সৌরভ ভাইয়ের সাথে (মুমিনুল হক) কথা হয়েছে আজ। জিম করছি কিনা, এটা জিজ্ঞাস করছিলেন উনি। এরপর আফিফের সাথেও কথা হয়েছে।