বছরে ৯.৬ শতাংশ হারে উজ্জ্বল হচ্ছে রাতের আকাশ, অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তারারা
হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে অজস্র তারা জ্বলজ্বল করতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পর থেকে বিশ্বের প্রায় সকল প্রান্তের শহরগুলোর অলিগলিতে কৃত্রিম আলোর ব্যবহার প্রচণ্ড মাত্রায় বেড়ে যায়। আর এ কৃত্রিম আলোর কারণেই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাতের আকাশের উজ্জ্বলতা, সাধারণ মানুষের দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে অজস্র তারা।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের আকাশেই বেশিরভাগ সময় গবেষণা করেন। এছাড়াও বহু আগে থেকে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত গবেষণায় ব্যবহার করা হয় টেলিস্কোপ। আর এ গবেষণার কাজে আলো দূষণ যাতে না হয় তাই এ টেলিস্কোপ সচারাচর অন্ধকার জায়গায় বসানো হয়।
তবে বর্তমানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ শহরে বাস করে। আর এই চাকচিক্যময় জনবহুল শহরগুলোতে রাতের বেলা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে প্রচুর পরিমাণে কৃত্রিম আলোর ব্যবহার করা হয়। এর ফলে রাতের আকাশে তৈরি হয় আলো দূষণ। একইসাথে এ আলো দূষণের ফলে আকাশের বিশাল সংখ্যক তারা ঐ শহরের মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়।
স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে গত এক দশকে আলো দূষণের পরিমাণ প্রায় একই রয়েছে কিংবা অল্প কমেছে। কিন্তু আফ্রিকা, এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় এ দূষণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও বাইরের আলোকসজ্জা করার জন্য যে এলইডি লাইটের ব্যবহার করা হয়, স্যাটেলাইট সেই এলইডির নীল আলো শনাক্ত করতে পারে না। এলইডির এ আলো বিবেচনায় নিলে আলো দূষণের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে।
বহুদিন ধরেই 'গ্লোব অ্যাট নাইট' নামক একটি আন্তর্জাতিক সিটিজেন সায়েন্স প্রকল্প আলো দূষণ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। একইসাথে এ ক্যাম্পেইনের অধীনে কীভাবে প্রতিদিন আলো দূষণের কারণে আকাশ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী তথ্যও প্রকাশ করা হচ্ছে।
এ ক্যাম্পেইনের অধীনে সিটিজেন সায়েন্টিস্টরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের রাতের আকাশের আলো দূষণ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি অনলাইন রিপোর্টিং পেইজ তৈরি করেছেন। ২০১১ সালে অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে এ রিপোর্টিং পেইজটির যাত্রা শুরু হয়। এ পেইজে বৈশ্বিক রাতের আকাশে তারা দেখা যাওয়ার হার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রদর্শন করা হয়। স্বেচ্ছাসেবকেরা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে রাতের আকাশ সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করেন।
সম্প্রতি গ্লোব অ্যাট নাইটের প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, রাতের আকাশে প্রতি বছর কৃত্রিম আলোর পরিমাণ ৯.৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোটাদাগে বলতে গেলে, আট বছর আগের তুলনায় সাম্প্রতিক রাতের আকাশ দ্বিগুণ বেশি আলোকিত। আর আকাশে আলোর পরিমাণ যত বাড়বে, তত কম তারা দেখা যাবে।
আকাশে আলো দূষণের পরিমাণ যদি এভাবে চলতে থাকে তবে আকাশে খালি চোখে তারা দেখার পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনো স্থানের আকাশে ২৫০টি তারা দেখতে পাওয়া গেলে ওই স্থানে আজ জন্মানো একটি শিশু তার ১৮ বছর বয়সে ওই আকাশে রাতের বেলা হয়তো মাত্র ১০০টি তারা দেখতে পাবে।
রাতের আকাশের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির জন্য একদিকে নগরায়ন এবং অন্যদিকে ঘরের বাইরে এলইডি লাইটের ব্যবহার বৃদ্ধি অনেকাংশে দায়ী। এছাড়া ধীরে ধীরে অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ হারিয়ে যাওয়া এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে কৃত্রিম স্যাটেলাইটের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে জ্যোতির্বিদ্যায়ও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
একইসাথে আকাশে খালি চোখে দেখা তারার পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কেননা হাজার হাজার বছর ধরে রাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের তারা দেখে লেখক, গায়ক, দার্শনিকেরা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তারায় পরিপূর্ণ আকাশ মানুষের মনোজগতে এক বিস্ময়কর অনুভূতিও সৃষ্টি করে।
আলো দূষণ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্যও ক্ষতিকারক। এর ফলে দৈনিক প্রকৃতিতে যে স্বাভাবিক আলোকচক্র থাকার কথা তার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে জীবজগতে ঘুম, বৃদ্ধি কিংবা প্রজননে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হচ্ছে। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ জীববৈচিত্র্য এ আলো দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
ব্যক্তি থেকে শুরু করে সামষ্টিক পর্যায়ে সহজ কিছু পরিবর্তন আনলেই আলো দূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে ন্যূনতম যে পরিমাণ আলো দরকার, ঠিক সে পরিমাণ আলো ব্যবহার করতে হবে। ঘরের বাইরে আলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে তা মাটির দিকে মুখ করে স্থাপন করতে হবে। ঘরের বাইরে সাদা আলোর বাল্বের পরিবর্তে হলুদ আলোর বাল্ব ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও লাইট মোশন ও সেন্সর ব্যবহার করলেও আলো দূষণের পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব।
কেউ যদি চাকচিক্যময় শহর থেকে দূরে একটি নির্জন জায়গায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকান, তবে তিনি শহরের তুলনায় আরও অনেক বেশি তারার অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন। রাতের বেলা পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি অঞ্চল থেকে গড়ে প্রায় ২,৫০০ তারা খালি চোখে দেখতে পাওয়া যায়। নির্জন কোনো স্থানে একসঙ্গে এত তারার সৌন্দর্য দেখে তখন সত্যিই মনে হবে যে, অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ সংরক্ষণ করা জরুরি।