মহাসমুদ্রে মার্কিন প্রাধান্যের দিন শেষ!
বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ হয় সমুদ্রপথে। এর কারণ সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন সহজ, এতে খরচ আর প্রতিবন্ধকতা দুটোই কম। কিন্তু হুট করে যদি জলপথে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়, বিশ্বের সাগরগুলো আর অবাধ না থাকে, তাহলে কী হবে?
মাঝেমধ্যেই মার্কিনীরা টের পায় জীবনযাত্রা, জীবিকা, এমনকি জীবনের জন্যও তারা কতটা বৈশ্বিক মুক্ত সমুদ্রপথের ওপর নির্ভরশীল। ২০২১ সালে সুয়েজ খালে এভার গ্রিন জাহাজটি আটকে যাওয়ার কারণে স্থবির হয়ে পড়েছিল বৈশ্বিক সমুদ্রবাণিজ্য। এর মাস কয়েক পরে হানা দিলো করোনাভাইরাস।
করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের লং বিচ ও লস অ্যাঞ্জেলেসের বন্দরে শখানেকের বেশি কন্টেইনার জাহাজ আটকা পড়েছিল। তা-তে ব্যাহত হয়েছিল সমগ্র আমেরিকার সরবরাহ চেইন।
এসব ঘটনা সাময়িক ছিল। কিন্তু এরকম পরিস্থিতি আরও বেশি দীর্ঘায়িত হলে কী হবে ভাবুন তো। রাশিয়া যদি আর্কটিক মহাসাগরের বড় অংশকে নিজেদের বলে দাবি করে বৈরী দেশগুলোকে এটি ব্যবহার করতে না দেয়? যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী কিন্তু সেই ১৯৫০-এর দশকের পর থেকে আর্কটিকে চলাচলের উপযোগী যুদ্ধজাহাজ তৈরি করেনি।
অথবা প্রথম ধাক্কাটা চীন থেকেও আসতে পারে। শি জিনপিং তাইওয়ান দখল করতে পারেন। এরপর পূর্ব চীন সাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরকে নিজেদের বলে ঘোষণা করতে পারে দেশটি। এর ফলে এ সমুদ্র অঞ্চল দিয়ে যাতায়াত করা জাহাজগুলোকে বড় অংকের ফি ও শুল্ক দিতে হতে পারে।
কোনো একটি দেশ এরকম সিদ্ধান্ত নিলে অন্য দেশগুলোও বসে থাকবে না। এর ফলে বৈশ্বিক সমুদ্রপথ পুরোপুরি বাণিজ্যের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে যাবে। বড় বড় বাণিজ্য জাহাজগুলোর স্থান দখল করে নেবে ছোট, দ্রুতগতির কার্গো জাহাজ। বাড়বে ঘুষ ও জলদস্যুদের রাহাজানি। যে মুক্ত সমুদ্র এখন আমরা উপভোগ করতে পারছি, সেটার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
সমুদ্রবাণিজ্য কমে গেলে বাজারব্যবস্থা অভ্যন্তরীণ হয়ে যাবে। এর ফলে সূচনা হতে পারে দ্বিতীয় মহামন্দার। যেদিকেই তাকাই না কেন, আমেরিকার জীবনযাত্রায় আমি সবসময় সমুদ্রের ক্ষমতার আভাস দেখতে পাই। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও নিরাপত্তা সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। এ ব্যাপারটি এতটাই সত্য যে, এটি আমাদের বৈশ্বিক অভিগমনের কেন্দ্রে থাকা উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের এখন থেকেই উচিত আবারও একটি সমুদ্রশক্তিসম্পন্ন দেশের মতো চিন্তা ও আচরণ করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমুদ্রে যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেন প্রাধান্য লাভ করে। ক্রমে মুক্ত সমুদ্রের ধারণা বাস্তবতায় পরিণত হয়। সমুদ্রপথে বাণিজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পর বিশ্বায়নের অর্থনীতি ১৯৪০ সালের আট ট্রিলিয়ন থেকে ৭৫ বছর পর ১০০ ট্রিলিয়নে পৌঁছায়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখন আর আগের মতো সমুদ্রশক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছে না। আমেরিকার বাণিজ্যিক জাহাজ নির্মাণ শিল্প ১৯৬০-এর দশকে ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে। ১৯৮১ সালে রোনাল্ড রিগ্যান ক্ষমতায় আসার পর জাহাজ নির্মাণ শিল্প আরও স্থবির হয়ে পড়ে, কারণ রিগ্যান প্রশাসন এ শিল্পের ওপর ভর্তুকি কমিয়ে দিয়েছিল।
একই সঙ্গে মার্কিন নৌবাহিনীর আকারও ছোট হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নৌবাহিনী অনেক জাহাজ বাতিলের খাতায় ফেলেছিল। কিন্তু তখনো সক্রিয় জাহাজের সংখ্যা ১০০০-এর কাছাকাছি ছিল। ১৯৬৯ সালের পর জাহাজের সংখ্যা কমতে থাকে, ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে তা কমে ৫২১-এ পৌঁছায়। রিগ্যান ১৯৮০ সালে নৌবাহিনীর জাহাজের সংখ্যা ৬০০ করার অঙ্গীকার করে পরে তা পূরণ করেন।
স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বুশ, ক্লিন্টন প্রশাসনের পর ওবামার সময় মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজের সংখ্যা কমে ২৭১-এ পৌঁছায়। এদিকে চীন ও রাশিয়া ভিন্নভাবে তাদের নৌশক্তিকে উন্নয়ন করতে শুরু করে যা মহাসমুদ্রে মার্কিন নেতৃত্বাধীন মুক্ত বাণিজ্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে।
রাশিয়া অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনে বিনিয়োগ করে। অন্যদিকে চীন এর বাণিজ্যিক ও সামরিক উভয় ধরনের জাহাজ নির্মাণ সক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। দুই দেশই আন্তর্জাতিক জলসীমায় নিজেদের দাবির পরিমাণ বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করছে।
আজকের দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ রয়েছে, ইরাক ও আফগানিস্তানে সাম্প্রতিক যুদ্ধগুলোর কারণে মনস্তাত্ত্বিক চাপ রয়েছে। কিন্তু আমাদের পক্ষে এখন আর একই সঙ্গে মহাদেশীয় শক্তি ও সমুদ্রশক্তির অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা এখনও অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে না জড়িয়ে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার করতে পারি। আমাদের কৌশলগত ভবিষ্যৎ এখন সমুদ্রনির্ভর।
১৮৯০ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর আলফ্রেড ঠায়ার মাহান দ্য আটলান্টিক-এ মার্কিন নৌশক্তির বহির্বিশ্বে পদচারণা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। বৃহৎ বাণিজ্যিক জাহাজ বহর ও তা রক্ষার্থে শক্তিশালী নৌবহর তৈরির পক্ষে মত ছিল থিওডর রুজভেল্ট ও হেনরি ক্যাবো লজের মতো রাজনীতিবিদদেরও।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন নৌশক্তি চরমে ওঠে। মহাসমুদ্রে দেশটির সামরিক ও বাণিজ্যক নৌবহরকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কোনো সামরিক শক্তি তখন বিশ্বে ছিল না। নিজেদের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্র সমুদ্রপথে মুক্ত বাণিজ্যের একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি করল। ইতিহাসে এ প্রথমবারের মতো সমুদ্র সবার জন্য উন্মুক্ত হলো। তাই মানুষ এর গুরুত্ব ও প্রতিবন্ধকতাগুলো নিয়ে তখন বিশেষ মাথা ঘামায়নি।
তবে নতুন করে কৌশলগত সমুদ্রশক্তি অর্জনে কাজ করতে কেবল নৌবাহিনীতে বেশি করে যুদ্ধজাহাজ সংযুক্ত করলেই হবে না, নতুন এ কৌশল শুরু করতে হবে অর্থনীতিকে দিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের এখন টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন ভারী শিল্প। নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রকে অন্য দেশের, এমনকি বন্ধু দেশের উৎপাদন কারখানার ওপর নির্ভর করে থাকা চলবে না। আমাদের একটি সমুদ্রশক্তি বিষয়ক বাণিজ্যনীতি তৈরি করতে হবে। দরকার হবে স্টিল প্ল্যান্ট, মাইক্রোচিপ কারখানা নির্মাণ — এমনকি প্রয়োজনে 'চিপস অ্যাক্ট'-এর মতো 'শিপস অ্যাক্ট'ও তৈরি করতে হবে।
অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় কোম্পানিগুলো একত্রিত হয়ে নতুন কোম্পানি গঠন করেছিল। এখন এসব কোম্পানির উচিত প্রয়োজনীয় স্পিন-অফ শিল্পকারখানা তৈরি করা যাতে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা ও টিকে থাকার সক্ষমতা তৈরি হয়।
মার্কিন বন্দরগুলোর বেশিরভাগ বেসামরিক বাণিজ্যিক জাহাজগুলো বিদেশে তৈরি। এগুলো বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজ। আমাদের নিজেদের পতাকাবাহী বেসামরিক জাহাজের অভাব আমাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রেখেছে। আজকে হয়তো আমরা করোনার সময়কার মার্কিন বন্দরগুলোতে কন্টেইনার জাহাজের আটকা পড়ার কথা স্মরণ করতে পারি। কিন্তু এমন দিনও আসতে পারে যেদিন চীন এর বড় বাণিজ্যিক জাহাজ বহরকে মার্কিন বন্দরে ভেড়ার নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। সেরকম কিছু হলে খাঁখাঁ করবে আমাদের বন্দরগুলো।
আজকের দিনে ইউরোপে আমাদের মিত্রদের জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে পেরে আমরা গর্বিত, কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের নিজস্ব পর্যাপ্ত জাহাজ না থাকার দরুন এসব পরিবহন একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ারও যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদেরকে বাণিজ্যিক জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।