রাশিয়ার তেল বহনে হঠাৎ করে গজিয়ে উঠছে ট্যাংকার জাহাজের বৃহৎ সংস্থা
ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই, তারই ব্যতিব্যস্ত প্রাণকেন্দ্রে একটি অফিস। দরজার প্যাকিং টেপ সদ্য ছেঁড়া হয়েছে বোঝাই যায়। মেঝেতেই ছড়িয়ে আছে তার অবশেষ। তবে পাশের অফিসের একজন জানালেন, হপ্তাকয়েক আগেই নতুন অফিসটি ছেড়েছে কোম্পানি; কর্মীরা চলে গেছেন অজ্ঞাত সে ঠিকানায়। খবর ব্লুমবার্গের
মুম্বাই থেকে আরব সাগর পাড়ি দিলে ১,২০০ মাইল দূরে দুবাই। পেট্রোডলারে গড়ে তোলা ঝাঁ চকচকে এই নগরের শিল্প এলাকায় ছোট্ট আরেকটি অফিসের সন্ধান মেলে। এটাও রাশিয়ার নয়া পেট্রোলিয়াম সরবরাহ শৃঙ্খলের ছোটখাট এক চালিকাশক্তি।
প্রথম ঠিকানার প্রতিষ্ঠানের নাম গ্যাটিক শিপ ম্যানেজমেন্ট (মুম্বাই-ভিত্তিক)। দ্বিতীয়টি হলো ফ্র্যাকটাল শিপিং। আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ডেটাবেজের তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠান দুটি ২০০ কোটি ডলার মূল্যের ট্যাংকার জাহাজের অধিকারী। আশ্চর্যের বিষয় হলো– মাত্র এক বছরের মধ্যেই এত টাকার জাহাজ কিনেছে তারা! এসব জাহাজ বিশ্বব্যাপী রাশিয়ান জ্বালানি তেল বহন করছে।
প্রতিষ্ঠান দুটির নৌবাণিজ্য নেটওয়ার্ক প্রসারিত হচ্ছে দিনকে দিন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরেই তাদের উৎপত্তি। তারপর ব্যবসা রমরমা হতে থাকে – রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানির ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞাগুলো জোরদার হওয়ার সাথে সাথে। রাতারাতি গজিয়ে ওঠা এসব শিপিং কোম্পানি জাহাজ ভাড়া দিচ্ছে রাশিয়াকে। ফলে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে গন্তব্যে বিপুল জ্বালানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারছে মস্কো।
বাণিজ্যিক জাহাজের দাম অনুসরণকারী একটি প্রতিষ্ঠান ভ্যাসেলসভ্যালু'র জ্যেষ্ঠ কন্টেন্ট বিশ্লেষক রেবেকা গালানোপৌলাস জোন্স বলেন, 'এটা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ট্যাংকারের বাজার, তাদের অংশগ্রহণ- রাশিয়ার বৈশ্বিক জ্বালানি তেল প্রবাহকে সচল রাখছে। ফলে তাদের সার্বিক রপ্তানির পরিমাণে নিষেধাজ্ঞা খুব সামান্যই প্রভাব ফেলেছে'।
রাশিয়াকে সহায়তা দান
মাত্র কয়েক মাসেই নিজেদের বহরে বড় সংখ্যক ট্যাংকার জাহাজ যোগ করেছে গ্যাটিক ও ফ্র্যাকটাল।
গত বছরের ৫ ডিসেম্বর সমুদ্রপথে রাশিয়ান জ্বালানি আমদানির ওপর সম্পূর্ণরূপে নিষেধাজ্ঞা দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জি-৭ ভুক্ত শিল্পোন্নত দেশগুলোর সাথে দেশটির জ্বালানি তেল রপ্তানিতে মূল্যসীমা আরোপের পক্ষেও যোগ দিয়েছে ইইউ। গত ৫ ফেব্রুয়ারি মূল্যসীমা রাশিয়ার পরিশোধিত তেলের ওপরও সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে, পশ্চিমা শিপিং কোম্পানিগুলোর জাহাজ ব্যবহার করে রাশিয়ান তেল রপ্তানি করতে হলে, চালানের মূল্য প্রতিব্যারেল ৬০ ডলার বা তার কম এমন প্রত্যয়নপত্র দিতে হবে। মূল্যসীমা না মানলে বিমা সুবিধাও দিতে পারবে না পশ্চিমা কোম্পানিগুলো।
রাশিয়া বিশ্ববাজারে ক্রেতা আকর্ষণে মূল্যছাড় দিচ্ছে। চীন ও ভারতের আমদানিকারকেরা তারই সুবিধা নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে মূল্যছাড় দেওয়া রাশিয়ার এই অশোধিত জ্বালানি তেল প্রবাহ অব্যাহত থাকুক, এজন্যই মূল্যসীমা কিছুটা উচ্চ রাখা হয়েছে। আর এখানেই লোভনীয় বাণিজ্যের খোঁজ পায় গ্যাটিক ও ফ্রাকটালের গোপন উদ্যোক্তারা। তাছাড়া, উভয় সংস্থাই যথেষ্ট পরিমাণে পশ্চিমা বিমা সেবা নিচ্ছে।
সমুদ্রপথে সংগঠিত বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশকে সমবায় ভিত্তিতে বিমা সুবিধা দেয় লন্ডন-ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ অব প্রটেকশন অ্যান্ড ইনডেমনিটি ক্লাবস। ব্লুমবার্গের সংকলিত তথ্য অনুসারে, গ্যাটিকের জাহাজ বহরের ৭৫ শতাংশই তাদের বিমা সুবিধার আওতায় রয়েছে। ফ্র্যাকটালের ক্ষেত্রেও এই অনুপাত উচ্চ।
শিপিং খাতের বৃহৎ বিমাদাতা প্রতিষ্ঠানসমূহের ১৩টি সংগঠন মিলে গঠিত একটি গ্রুপ- আমেরিকান ক্লাব, যার সদর দপ্তর নিউইয়র্কে। ব্লুমবার্গের তথ্য অনুসারে, গ্যাটিক ও ফ্র্যাকচালের বহরে এমন অজস্র জাহাজ আছে যা তাদের কোনো না কোনো সদস্যের থেকে বিমা সেবা নিচ্ছে।
আমেরিকান ক্লাবের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ড্যানিয়েল ট্র্যাডোস বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, উভয় শিপিং প্রতিষ্ঠানের জাহাজ বহরকে বিমা সেবা দেয় তার সংগঠন। প্রতিষ্ঠান দুটি প্রত্যয়নপত্র দিয়েই এ সেবা নিচ্ছে। এই প্রত্যয়নপত্র হলো জি-৭ এর বেধে দেওয়া মূল্যসীমা অনুসারে পরিবহন করা চালানের দামের নথি।
প্রচলিত পশ্চিমা শিপিং কোম্পানিগুলো রাশিয়ান তেল বহন বন্ধ করে দেওয়ার ফলেই গ্যাটিক ও ফ্র্যাকটালের মতো সংস্থার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পশ্চিমা শিপিং কোম্পানিগুলো ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিবাদে অথবা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ার ভয়ে এই উদ্যোগ নেয়।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকর হওয়ার আগেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রস্তুতি শুরু হয়। এসময় বিপুল পরিমাণ ট্যাংকার জাহাজ বিক্রি করা হয়েছে নতুন একদল ক্রেতার কাছে; যাদের পরিচয় বা ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।
অনুমোদিত বাণিজ্য
ভারতের বাণিজ্যিক সংস্থা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে খুঁজে পাওয়া যায়নি গ্যাটিক শিপ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি সম্পর্কিত কোনো তথ্য। গ্যাটিকের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায় সেটি নির্মাণাধীন। নিজেদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি ব্লুমবার্গের কাছে কোনো মন্তব্য করতেও রাজি হয়নি।
অন্যদিকে, নিয়োগের জন্য ফ্র্যাকটালের ওয়েবসাইটে আছে শুধু একটি ইমেইল অ্যাড্রেস। মন্তব্যের জন্য তাদের ইমেইলে যোগাযোগও করে ব্লুমবার্গ। ফ্র্যাকটালের কর্মকর্তাদের পরিচিতজনদের থেকে তাদের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে হোয়াটস অ্যাপে ম্যাসেজ ও কল করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
তাদের দুবাই অফিসের তালিকা শিপিং ইনফরমেশন সার্ভিস- ইকোয়াসিসের তালিকায় রয়েছে ফ্র্যাকটালের অধিকাংশ ট্যাংকারের ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতেও একটি অফিস খুলেছে তারা। অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে শেয়ার করা এই ঠিকানাই তাদের সদর দপ্তর বলে জানানো হয়েছে।
ব্লুমবার্গের বিশ্লেষিত তথ্যানুসারে, গ্যাটিকের জাহাজ বহর নিজস্ব জ্বালানিসহ প্রায় ৩ কোটি ব্যারেল তেল বহন করতে পারে। সে তুলনায়, ফ্র্যাকটালের পরিবহন ক্ষমতা অন্তত দেড় কোটি ব্যারেল।
ব্লুমবার্গের সংগৃহীত ট্যাংকার ট্র্যাকিং তথ্যানুসারে, চলতি বছর উভয় প্রতিষ্ঠানের জাহাজ রাশিয়ার বন্দরে গিয়েছে, অথবা মাঝসমুদ্রে অন্য জাহাজ থেকে জ্বালানি তেলের চালান ভরেছে।
উল্লেখ্য যে, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত মূল্যসীমায় যোগ দেয়নি, রাশিয়ান তেল বাণিজ্যে তারা কোনো নিষেধাজ্ঞাও দেয়নি। তাই এসব দেশে নিবন্ধন নিয়ে তারা আইনত বৈধভাবেই পশ্চিমা সেবাগুলো নিতে পারছে – মূল্যসীমা অনুসারে চালানের প্রত্যয়নপত্র দেখানোর মাধ্যমে।
রাশিয়াকে দেওয়া সেবা
বাণিজ্যিক জাহাজের বেচাকেনায় মনিটরিং সংস্থা- ভ্যাসেলভ্যালু'র তথ্যমতে, গ্যাটিকের প্রথমদিকের ট্যাংকার ক্রয়ের রেকর্ড রয়েছে ২০২২ সালের জুনে। আর সাম্প্রতিকতমটি কেনা হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। ইকোয়াসিসের তথ্যমতে ফ্র্যাকচালও একই মাসে জাহাজ কিনেছে।
এ বাণিজ্যের উদাহরণ গ্যাটিকের 'জাম্বো' নামের একটি ট্যাংকার। গত ১১ ফেব্রুয়ারি জাহাজটিকে দেখা যায় রাশিয়ার বাল্টিক সাগরের বন্দর উস্ত-লুগায় ভিড়তে। বর্তমানে জাহাজটি রয়েছে গ্রিসের কালামাতার কাছে। রাশিয়ান তেল এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে স্থানান্তরের জন্য সমুদ্রের এই অঞ্চলটি বর্তমানে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে বলে ব্লুমবার্গের নিজস্ব শিপ-ট্র্যাকিং তথ্য জানিয়েছে। এই জাহাজটিই গত ৩ ফেব্রুয়ারি কেনা হয় বলে জানায় ইকোয়াসিস।
মূল্যসীমা আরোপের পর থেকে রাশিয়া নিজস্ব বন্দরগুলোর মাধ্যমে দৈনিক ৩২ লাখ ব্যারেল অশোধিত তেল রপ্তানি করেছে। যা নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের আগের দুই মাসেও প্রায় একই মাত্রায় হয়েছিল। গ্যাটিক ও ফ্র্যাকটালের মতো নতুন শিপিং জায়ান্ট এই গোপন নেটওয়ার্কের অংশ – যা মস্কোর তেল বাণিজ্যকে বাধামুক্তভাবে সচল রাখায় সহায়তা করছে।
দুটি সংস্থাই তাদের পরিচালিত ট্যাংকারের সুবিধাভোগী মালিকানা সংস্থা হিসেবে নিবন্ধিত নয় , অর্থাৎ তারা অন্য কারো মালিকানাধীন ট্যাংকার পরিচালনা করে, যাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয় না।
আমেরিকান ক্লাবের ওয়েবসাইটে তারা ট্যাংকার জাহাজগুলোর 'নিবন্ধিত মালিকানা সংস্থা' বলে উল্লেখ রয়েছে। শিপিং শিল্পে জাহাজের মালিকানার বিষয়ে এটি প্রচলিত চর্চা, যেখানে প্রকৃত মালিকের পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ থাকে।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের শিপিং তথ্যভাণ্ডার তত্ত্বাবধানকারী আইএইচএস- এর তথ্যমতে, সুবিধাভোগী মালিকানার নিবন্ধনের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে কে জাহাজের মালিক তা জানার সুযোগ থাকে। কিন্তু, তা না করলে মালিকানা অস্পষ্ট রয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি অলাভজনক গবেষণা সংস্থা– ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ প্রকল্পের সহ-পরিচালক স্টিভ কারলা'র মতে, 'নতুন এই বৃহৎ গ্রুপগুলোর কাছে কতোটা অনায়সে জাহাজের মালিকানা স্থানান্তর করা সম্ভব হচ্ছে, তার প্রমাণই আমরা দেখতে পারছি'।