এক দশক পর আবারও গলছে জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার বরফ, পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নয়া সমীকরণ
১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সার্জিও লিওনের ক্লাসিক সিনেমা দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি যদি কেউ দেখে থাকেন, তাহলে সিনেমার সেই আইকনিক মেক্সিকান স্ট্যান্ডঅফের দৃশ্যটি অবশ্যই মনে থাকার কথা। তিনজনের প্রত্যেকেই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে এক জোড়া করে পিস্তল ধরে রেখেছে অপরের দিকে — কেউই কাউকে বিশ্বাস করে না, কিন্তু প্রকাশ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তেও পারবে না, কারণ তাতে নিজের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে যদি পারফেক্ট মেক্সিকান স্ট্যান্ডঅফ থাকে, সেটা পূর্ব এশিয়ার দেশ চীন, জাপান, ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাঝে। প্রত্যেকেরই রয়েছে অপরের প্রতি অবিশ্বাস ও তিক্ত স্মৃতি, কিন্তু তিন অর্থনৈতিক পরাশক্তির মাঝে সংঘাত হওয়ার সম্ভাবনাও কম। কিন্তু সম্প্রতি সেই সমীকরণ পালটে যাচ্ছে দ্রুত। অতীতের তিক্ততাকে পেছনে রেখে দক্ষিণ কোরিয়া তার সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু জাপানের সঙ্গে সৌহার্দ গড়ে তুলতে যাচ্ছে; কারণ প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম পাড়ে দ্রুতই প্রভাব বাড়াচ্ছে চীন। আর এই সৌহার্দের প্রথম সোপান হলো দক্ষিণ কোরীয় প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইউলের গত ১৬ মার্চের টোকিও সফর — দীর্ঘ দশ বছর পর আবারও বরফ গলতে শুরু করেছে জাপানের সাথে।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার তিক্ততার অতীত অনেক আগের। ১৯০৫ সালে রুশো-জাপানিজ যুদ্ধে জয়ী হবার পর জাপান প্রথমবারের মতো কোরীয় উপদ্বীপকে নিজেদের কলোনি ঘোষণা করে। কিন্ত এর প্রভাব ছিল সামান্যই। তাই ১৯০৭ সালে জাপান কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে কোরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেন জাপানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ইতো হিরোবুমি। ১৯০৯ সালে ইতো হিরোবুমিকে হত্যা করে কোরীয় স্বাধীনতাকামী আন জুন-গিয়ুন; যার প্রেক্ষিতে ১৯১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কোরীয় উপদ্বীপকে নিজেদের উপনিবেশ হিসেবে দখলে নেয় জাপান। শুরু হয় নির্মম ঔপনিবেশিক শাসন। প্রায় এক লাখ কোরিয়ানকে জাপানি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়; দেড় লাখ কোরিয়ানকে দাস হিসেবে জাপানের বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও খনিতে কাজ করানো হয়; প্রায় দুই লাখ নারীকে 'কমফোর্ট ওম্যান' হিসেবে জোরপূর্বক নিযুক্ত করা হয়। এমনকি এক পর্যায়ে স্কুল-কলেজে কোরিয়ান ভাষা শেখানোও বন্ধ করে দেওয়া হয় কোরিয়ানদের জাপানি বানানোর উদ্দেশ্যে।
এর ফলে ১৯৪৫ সালের পর থেকে জাপানের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষ সৃষ্টি হয় কোরিয়ানদের মনে। এমনকি এখনো চীনের পর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি 'অ্যান্টি-জাপান' মনোভাব রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। প্রায় ২০ বছর পর ১৯৬৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় দেশ দুইটির মধ্যে। কিন্তু শুরু থেকেই ঔপনিবেশিক শাসন, কমফোর্ট ওম্যান এবং বিতর্কিত দোকদো বা তাকেশিমা দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে তৎকালীন দক্ষিণ কোরিয়ান প্রেসিডেন্ট লি মিয়ুং-বাকের দোকদো/তাকেশিমা দ্বীপ সফর নিয়ে কূটনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট লি জাপানের সম্রাট আকিহিতোকে অতীত কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে বললে ক্ষুদ্ধ জাপান সিউল থেকে রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে এবং উচ্চপর্যায়ের আলোচনা স্থগিত করে। ২০১৯ সালে জাপান দক্ষিণ কোরিয়াকে ইলেক্ট্রনিক্সের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের প্রেফারেন্সিয়াল লিস্ট থেকে সরিয়ে দেয়, যার প্রতিবাদে সিউল অভিযোগ করে, জাপান তাদের ওপর অর্থনৈতিক যুদ্ধ চালাচ্ছে।
সেই বরফ এ বছর গলেছে, যখন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইউন জাপানি প্রধানমন্ত্রী ফুমিয়ো কিশিদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং জাপান কোরিয়ার সাথে পুনরায় মুক্ত বাণিজ্যের ঘোষণা দেয়। সেমিকন্ডাক্টর, ব্যাটারি ও বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পে আরও সহযোগিতার কথা জানানো হয়। আর সরবরাহ চেইন সুরক্ষা ও রেয়ার মেটাল সংগ্রহের জন্য দুই দেশ যৌথভাবে ১.৫ মিলিয়ন ডলারের ফান্ড গঠনের কথাও জানায়।
তবে এ সম্পর্ক স্বাভাবিকায়নের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ফুমিয়ো কিশিদাও। ২০২২ সালের ১০ জুন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ আয়োজিত শাংগ্রি-লা সম্মেলনে তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন, 'আজকের ইউক্রেনের মতো পরিণতি আগামী দিনের পূর্ব এশিয়ার হতে পারে।' এর ধারাবাহিকতায় আঞ্চলিক সম্পর্ক দৃঢ়করণ চলছে এখন।
২০২২ সালে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইউনও আগ্রহী সম্পর্ক জোরদার করায়। এ কারণে তিনি গত ৬ মার্চ প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব কোরিয়ান কোম্পানি জাপানি সৈন্যদের দ্বারা নিযুক্ত কোরিয়ান দাস শ্রমিকদের নিযুক্ত করেছিল, তারা সেই ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রতিষ্ঠিত সরকারি ফাউন্ডেশনে তিন মিলিয়ন ডলার প্রদান করবে। ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সুপ্রিম কোর্ট এরকম ১৫ জন দাস শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন জাপানি কোম্পানিদের, যাদের মধ্যে ছিল মিতসুবিশি ও নিপ্পন স্টিল। কিন্তু এ কোম্পানিগুলো ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে। জাপান জানায়, কোরিয়াকে দেওয়া অনুদানের মাধ্যমেই সকল দেনাপাওনা ১৯৬৫ সালেই নিষ্পন্ন হয়ে গেছে।
এখন প্রেসিডেন্ট ইউনের প্রস্তাব অনুযায়ী এ ক্ষতিপূরণ দেবে কোরিয়ান কোম্পানি, যেসব কোম্পানি ১৯৬৫ সালে জাপানি অনুদান পেয়ে লাভবান হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই দাস শ্রমিকদের পরিবার, রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট ও বিরোধী দল এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছে। জীবিত তিন জন সাবেক দাস শ্রমিক ঘোষণা দিয়েছেন, তারা এ অর্থ গ্রহণ করবেন না। রাস্তায় বিক্ষোভ চলেছে। তবে ইউনের ইচ্ছা সামনে অগ্রসর হওয়া এবং জাপানকে সঙ্গে নিয়ে চীন ও উত্তর কোরিয়াকে মোকাবেলা করা।
এতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। ২০১৭ সালের পর এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটু ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল। এখন আবার দুইপাশে দুই শক্তিশালী মিত্রকে পেয়েছে তারা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ চুক্তিকে 'গ্রাউন্ড-ব্রেকিং' বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি এর আগে গত মাসে মাদ্রিদে ন্যাটো সম্মেলনের সময় ফুমিয়ো কিশিদা ও ইউন সুক-ইয়ুলের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ঘটনাও সাম্প্রতিক উন্নতিতে প্রভাব রেখেছে। এবং যখন জাপান-কোরিয়া বৈঠক চলছিল, তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া সি ড্রাগন ২৩ নামক এক যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করে, যেখানে সাবমেরিনবিরোধী যুদ্ধ প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্ক জোরদার করছে এমন সময়ে, যখন উত্তর কোরিয়া এক সপ্তাহে তিনটি মিসাইল পরীক্ষা করেছে। কিম জং উন তার সেনাবাহিনীকে নিউক্লিয়ার যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রস্তুতি বাড়াতে বলেছেন। কাজেই জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্ক এখন গাঢ় হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রেসিডেন্ট ইউন জানেন, বেইজিংয়ের বিপরীতে টোকিওর সঙ্গে গলা মেলানো তার জন্য বেশি সুবিধাজনক। একই সাথে তিনি এটাও জানেন, অত্র অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট কোয়াড আর জাপানের তৈরি ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক-এর দুটোর একটাতেও দক্ষিণ কোরিয়া নেই। দ্রুত পালটে যেতে থাকা বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতিতে শক্তিশালী মিত্র থাকলে লাভ বই ক্ষতি হবে না সিউলের।
ওদিকে কিশিদার পূর্বসূরী শিনজো আবে তার দীর্ঘ প্রধানমন্ত্রিত্বকালে যতগুলো বিতর্কিত কাজ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো। পুতিনের সাথে আবের আট দফা সম্প্রীতি পরিকল্পনা তেমন কাজে আসেনি। রাশিয়ার কাছ থেকে জাপান তার বিতর্কিত দ্বীপগুলোও ফেরত নিতে পারেনি। ২০১৮ সালের নভেম্বরে সিঙ্গাপুরে আবে চেষ্টা করেছিলেন ১৯৫৬ সালের সোভিয়েত-জাপান যৌথ ঘোষণা অনুযায়ী দুটি বিতর্কিত দ্বীপ শিকোতান ও হাবোমাই ফেরত পেতে; কিন্তু পুতিন তাতে সাড়া দেননি। আর এখন ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর ফলে আবের আমলে পুতিনকে তোয়াজ করে চলার নীতি উলটা ফল দিয়েছে জাপানের জন্য। এখন তার প্রয়োজন মিত্রের।
মৈত্রীর ভিত্তি হতে হবে জাপানের ক্ষমাপ্রার্থনা এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান। কিন্তু সমস্যা হলো, জাপান সেটি করতে রাজি নয়। মিতসুবিশি মার্কিন ও চীনা যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে কাজ করানোর জন্য ক্ষমা চেয়েছে এবং ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। কিন্তু কোরিয়ানদের বেলায় ক্ষতিপূরণ দিতে তারা নারাজ। জাপান যদি মৈত্রী চায়, তবে তার অতীতের এই কঙ্কালের মুখোমুখি হতেই হবে। তাকে কমফোর্ট ওম্যানদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। পাঠ্যবইয়ে উগ্র জাতিয়তাবাদী বয়ানকে সংশোধন করতে হবে। শিনজো আবের করে যাওয়া এসব কর্মকাণ্ডকে তার উত্তরসূরী ইয়োশিহিদে সুগা খানিকটা প্রশমিত করেছেন, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এ সকল কারণ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মৈত্রীর চারাগাছকে মুড়িয়ে ফেলতে পারে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।