জাপানে বাড়ছে পরিত্যক্ত বাড়ির সংখ্যা, সংকট মোকাবিলায় গঠিত হয়েছে বিশেষ দল
জাপানে বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি লক্ষাধিক পরিত্যক্ত বাড়ি দেশটির জন্য একটি বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এর ফলে, শহরের অভিজাত এলাকাগুলো ভূতুড়ে পাড়া বা আবর্জনার স্তূপে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
প্রবীণদের পেনশন ও যত্নের জন্য বিপুল সামাজিক ব্যয়ের আশঙ্কায় থাকা দেশটিতে বর্তমানে ৮৯ লাখ পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে, যা মোট বাড়ির ১০.৩ শতাংশ। জাপানের স্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এসব বাড়ির অনেকগুলো দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া দেওয়া হয়নি বা মালিকরা সম্পত্তির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।
জাপানের নোমুরা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এনআরআই) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৩৩ সালের মধ্যে দেশটির মোট বাড়ির ৩০.৪ শতাংশ পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। এর মানে, প্রতিটি বাড়ির পাশেই গড়ে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি দেখা যাবে।
এই সমস্যার পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো– উচ্চ হারের উত্তরাধিকার কর, পরিত্যক্ত বাড়ি ভাঙার খরচ এবং এমন জমির ওপর করের বোঝা, যা বিক্রির সম্ভাবনা প্রায় নেই। বিশেষ করে কম জনসংখ্যার গ্রামীণ এলাকায় এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
এছাড়া, এক জটিল এবং অকার্যকর 'ক্যাডাস্ট্রাল নিয়মাবলী' এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে এই নিয়মে সংশোধনী আনা পর্যন্ত উত্তরাধিকারীরা জাপানে সম্পত্তি ত্যাগ করে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সুযোগ পেতেন।
টোকিওর কিছু এলাকায় পরিত্যক্ত বাড়ির সংকট মোকাবিলায় কর্মকর্তাদের বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে। সাইকেলে চেপে তারা ঝোপঝাড়ে ঢেকে যাওয়া বাড়ি খুঁজে বের করছেন কিংবা ভাঙা জানালা অথবা অন্যান্য চিহ্ন দেখে পরিত্যক্ত বাড়ি শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন।
সেটাগায়া জেলার পাঁচ সদস্যের একটি দলের অন্যতম সদস্য তাইকো চিবা বলেন, "যখন কোনো বাসিন্দা পরিত্যক্ত বাড়ি নিয়ে অভিযোগ করেন, আমরা সেই বাড়ির মালিক বা উত্তরাধিকারীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।" প্রায় দশ লাখ বাসিন্দার আবাসস্থল এই আবাসিক এলাকায় এমন বাড়ির সংখ্যা বাড়ছে।
মালিকের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর, তাদের বাড়িটি দ্রুত ভেঙে ফেলার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। তবে বিষয়টি সহজ নয়। বাড়ি ভেঙে জমি ফাঁকা রাখলে কর বৃদ্ধি পায়। এটি অনেক ক্ষেত্রে মালিকদের জন্য আর্থিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয় প্রশাসন কেবল তখনই কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যখন বাড়িটি প্রতিবেশীদের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে।
টিকটকে জাপানি শব্দ দিয়ে "পরিত্যক্ত বাড়ি" লিখে সার্চ করলে বিভিন্ন ভিডিও সামনে আসে। এসব ভিডিওতে দেখা যায়, হয় পরিত্যক্ত বাড়িতে আগুন লেগেছে অথবা আবর্জনায় ঠাসা ভবন কিংবা বন্যপ্রাণীর দখলে থাকা স্থাপনা।
তবে এমন বাড়িগুলো পুনর্নির্মাণের উদাহরণও রয়েছে। সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত বাড়ি নতুন আবাসন, শেয়ারড অফিস বা গেস্ট হাউজে রূপান্তরিত হচ্ছে। নোমুরা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এনআরআই) বিশেষজ্ঞ ওয়াতারু সাকাকিবারা বলেন, টেলিওয়ার্ক ও তরুণদের অনিশ্চিত কর্মসংস্থানের কারণে পুরনো বাড়ি সংস্কারের এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। কিন্তু এটি পুরো সমস্যার সমাধান নয়।
বর্জন ও নবায়ন
বিশেষজ্ঞ ওয়াতারু সাকাকিবারা জানিয়েছেন, পরিত্যক্ত বাড়ির সমস্যা জাপানের 'ডিসকার্ড অ্যান্ড রিনিউ' বা 'বর্জন ও নবায়ন' সংস্কৃতি থেকে এসেছে, যা দেশটির আগ্নেয় দ্বীপপুঞ্জ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ অবস্থান থেকে উদ্ভূত। এই সংস্কৃতি থেকেই দেশটিতে ৩০ বছরের মধ্যে পরিবর্তনযোগ্য দুই তলা কাঠের বাড়ির প্রচলন ঘটেছে।
সাকাকিবারা বলেন, "পরিত্যক্ত বাড়ির সংখ্যা কমাতে জন্মহার কমে আসা ঠেকানো জরুরি।" তিনি আরও বলেন, জাপানে বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উচ্চ প্রবৃদ্ধির সময়ে নির্মাণ উৎসাহিত করতে গৃহীত নীতিগুলো আজও বহাল রয়েছে।
জাপানের বাড়িগুলোর স্বল্প আয়ুষ্কাল বহু কোটি ডলারের রিয়েল এস্টেট বাজার তৈরি করেছে। এটি পরিবর্তন করা অত্যন্ত কঠিন বলে মনে করেন সাকাকিবারা। এই সংস্কৃতি ও বাজার ব্যবস্থা পরিত্যক্ত বাড়ির সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী করে তুলেছে।
২০২২ সালে জাপানে প্রায় ৭ লাখ ৭০ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। এটি জন্মহারের দিক থেকে দেশটিতে সর্বনিম্ন। বিশেষজ্ঞরা দেশটিতে জন্মহার কমে আসার জন্য বিবাহ কমে যাওয়া, গর্ভধারণের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং মহামারির সময় কাজের অনিশ্চয়তাকে দায়ী করেছেন।
কেইয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশটির ১২.৫ কোটি জনসংখ্যা ২০৬৫ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ কমে গিয়ে ৮.৮ কোটি হয়ে যেতে পারে। জনসংখ্যা সংকোচন রোধে জাপান কয়েক দশক ধরে নানা নীতি গ্রহণ করেছে, যেমন তরুণদের জন্য বিবাহ ভর্তুকি এবং সঙ্গী খুঁজে পেতে ডিজিটাল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি। তবে এগুলো কার্যকর হয়নি।
এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে নারীদের বৃহত্তর অংশগ্রহণ এবং বৈষম্যমূলক পরম্পরা বর্জন করে বৈবাহিক কাঠামোর প্রতি নারীদের অনীহাকেও জন্মহার কমে আসার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।