শিশুদের যক্ষ্মা মোকাবেলা এখনো চ্যালেঞ্জিং
বাংলাদেশে যক্ষ্মার চিকিৎসা বিনামূল্যে দেয়া হয় এবং সঠিকভাবে ওষুধ সেবন করলে ৯৫% ক্ষেত্রে রোগী সুস্থ হয়ে যায়। দেশে গত এক দশকে যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। কিন্তু সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় না হওয়ায় শিশুদের যক্ষ্মা মোকাবেলা এখনো চ্যালেঞ্জিং। শিশু মৃত্যু রোধে শিশুদের যক্ষ্মা নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো সহজলভ্য করার আহবান চিকিৎসকদের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান, যক্ষ্মা রোগীদের মধ্যে ১১ শতাংশই শিশু কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র ৪.২ শতাংশ শিশুর যক্ষ্মা শনাক্ত হয়, যা আসলে রোগ নির্ণয় বা শনাক্তের ঘাটতি নির্দেশ করে। দেশে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত ২০ হাজারের বেশি শিশু এখনও শনাক্ত ও চিকিৎসার বাইরে রয়ে গেছে।
২০২০ সালে দেশে ১৫ বছরের নিচে আনুমানিক ৩৩ হাজার শিশু যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিল এবং এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শিশু এই প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য রোগে প্রাণ হারিয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শিশু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু এখনও শিশুদের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ হিসাবে রয়ে গেছে যক্ষ্মা। ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে যক্ষ্মা নির্মূল করতে চাইলে এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া খুবই জরুরি।
সঠিক ডাটা না থাকলেও শিশু যক্ষ্মা রোগী বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের অ্যাজমা সেন্টারে প্রতি বছর ১০০-১৫০ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের অ্যাজমা ও টিউবারকিউলোসিস সেন্টারের সমন্বয়ক ডা. কামরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "প্রতিদিনই শিশু যক্ষ্মা রোগী বাড়ছে। কিন্তু শিশু যক্ষ্মা নির্ণয় ও চিকিৎসা দেয়া কঠিন। শিশুরা যক্ষ্মা পরীক্ষার জন্য কফ দিতে পারে না। আবার সমাজে প্রচলিত ধারণা, বাচ্চাদের টিবি হয় না। কখনো পরিবারের সদস্যরা বিশ্বাস করতে চায় না যে তার বাচ্চার টিবি হয়েছে। টিবি ডায়াগনোসিস করে দিলেও বাচ্চাকে ওষুধ খাওয়াতে চায় না। আবার চিকিৎসা শুরুর মাসখানেকের মধ্যে তাদের স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতি ঘটে। এসময় অভিভাবকরা সুস্থ হয়ে গেছে মনে করে চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। এমনকি ফলোআপে নেয় না। এটাও চ্যালেঞ্জ।"
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের এই সহকারী অধ্যাপক বলেন, "শুরুতে টিবি শনাক্ত না করলে বাচ্চার পরবর্তীতে নিউমোনিয়া হতে পারে, বাচ্চার ওজন কমে যায়, অপুষ্টিতে ভোগে। সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম টিউবারকিউলোসিস (সিএনএস টিবি) বা ব্রেইন টিউবারকিউলোসিস ডেভেলপ করলে বেশিরভাগ বাচ্চা মারা যায়।"
শিশু যক্ষ্মার লক্ষণ
দুই সপ্তাহের বেশি কাশি ও জ্বর বা এর কোন একটি হলেও শিশুর যক্ষ্মা হয়েছে এমন সন্দেহ করতে হবে। এছাড়া ওজন কমে যাচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার পরও নিউমোনিয়ার উন্নতি ঘটছেনা, এমনটি হলে যক্ষ্মার টেস্ট করতে হবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
ডা. কামরুজ্জামান বলেন, "বাচ্চারা যক্ষ্মার ঝুঁকিতে বেশি কারণ তাদের ইমিউনিটি কম। যক্ষ্মা সাধারণত পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে ছড়ায়। পরিবারের কেউ যক্ষ্মা আক্রান্ত হলে তাদের মাধ্যমে শিশুরা আক্রান্ত হয়। ধুলার কারণেও অনেক শিশু আক্রান্ত হয়। হাঁচি-কাশিতে ছড়ায়। আরেকটা কারণ হলো, না ফুটিয়ে গরুর দুধ পান। এটিও শিশুর টিবি আক্রান্তের একটি কারণ।"
শিশুদের যক্ষ্মা দেরিতে শনাক্ত হওয়ার কারণ
যক্ষ্মা ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ প্রকাশিত জাতীয় নির্দেশিকা বলছে, শিশুদের যক্ষ্মা নির্ণয় করা কঠিন কারণ তাদের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা যায় না।
চিকিৎসকেরা বলেন, বড়দের ক্ষেত্রে সাধারণত ফুসফুসের যক্ষ্মা বেশি হয়ে থাকে। অন্যদিকে ফুসফুসের বাইরে যে যক্ষ্মাগুলো রয়েছে সেগুলো শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
ডা. কামরুজ্জামান বলেন, "শিশু যক্ষা রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষণ দেরিতে প্রকাশ পায়। শিশুর জ্বর, কাশি হলে অভিভাবকেরা ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাওয়ায়, কিছুদিন ভালো থাকার পর আবার অসুস্থ হয় কিন্তু টিবি ডায়াগনোসিস করা হয় না।"
"শিশুদের ক্ষেত্রে ফুসফুসের যক্ষ্মা নির্ণয়েও অনেক সময় দেরি হয়। এর একটি কারণ হতে পারে শিশুরা বলতে পারে না, বোঝে না, কফ বের করতে পারে না। বাচ্চারা কফটা গিলে ফেলে তাই সেটা পেটে চলে যায়। এক্ষেত্রে যক্ষ্মা নির্ণয়ে পাকস্থলীর রস বের করে আনা হয়। সেই সুবিধা জেলা-উপজেলার হাসপাতালগুলোতে নেই। শিশুদের যক্ষা রোধে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে", যোগ করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, "অধিদপ্তরের অধীনে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গত কয়েক দশক ধরে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। তবে ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যক্ষ্মা নির্মূল করতে চাইলে এখনও অনেক কিছুই করা বাকি।"
যক্ষ্মা রোগের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে আজ (২৪ মার্চ) পালন করা হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, 'আমরা যক্ষ্মা নির্মূল করতে পারি।'