চিকিৎসা খরচ যখন একটি পরিবারের জন্য বিপর্যয়
একজন ক্যান্সার রোগীর পরিবারে চিকিৎসার বিল ঠিক কতটা বোঝা হতে পারে?
উত্তর রংপুর জেলার কৃষক সিরাজুল ইসলামের পরিবারের ক্ষেত্রে এই বোঝা অসহনীয়। রংপুরের এই কৃষক ইতোমধ্যেই তার কৃষিজমি ও গবাদি পশু বিক্রি করে দিয়েছেন। গত তিন বছরে তার স্ত্রীর ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি ও ওষুধের খরচ বহন করতে করতে এখন ঋণগ্রস্ত সিরাজুল।
ঢাকাতে থাকার মতো একটি বাসা নিতে অক্ষম এই দম্পতি জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ও হাসপাতালের ঠিক বাইরে একটি আবর্জনার স্তূপের পাশে আশ্রয় নিয়েছেন।
"আমি কারো কাছ থেকে টাকা ধার করতে পারলে আমার স্ত্রী কেমো পায়। ধার করতে না পারলে কেমোর তারিখ মিস করি আমরা।"
এই রোগের চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত তার ৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান সিরাজুল।
'ডিজিজ-স্পেসিফিক ডিসট্রেস হেলথকেয়ার ফাইন্যান্সিং অ্যান্ড ক্যাটাস্ট্রোফিক আউট-অব-পকেট এক্সপেন্ডিচার ফর হসপিটালাইজেশন ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ২৬ শতাংশ পরিবার গত কয়েক বছরে হাসপাতালে ভর্তির জন্য বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় (সিএইচই) করেছে। এ ধরনের ব্যয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ি ক্যান্সার (৫০ শতাংশ), এরপরেই রয়েছে যকৃতের রোগ (৪৯.২ শতাংশ), এবং পক্ষাঘাত (৪৩.৬ শতাংশ)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্য ব্যয়কে বিপর্যয়মূলক হিসেবে তখনই চিহ্নিত করে যখন একটি পরিবারে খাবারের চাহিদা মেটানোর পর চিকিৎসার জন্য তাদের মোট উপার্জনের ৪০ শতাংশ খরচ করতে হয়।
সমীক্ষায় আরো দেখা যায়, দেশে হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের ঘটনা বাড়ছে। ২০১০ সালে ১৪,২ শতাংশ (পরিবারের মোট খরচের ১০ শতাংশ) থেকে এবং ২০১৬ সালে তা হয়েছে ২৪.৬ শতাংশ, এবং ২০২১ সালে হয়েছে ২৬.১ শতাংশ।
এ গবেষণার ফলাফল গত ২০ আগস্ট ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়। ফলাফলে আরো দেখা যায়, ৫৮ শতাংশ পরিবার হাসপাতালের খরচ মেটাতে গিয়ে দুর্দশার সম্মুখীন হয়।
সমীক্ষা অনুসারে, ক্যান্সারের মতো বড় ধরনের রোগের জন্য একেকটি পরিবারকে সামর্থের বাইরে খরচ করতে হচ্ছে, এবং এর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছেই। এই খাতে বীমার সুযোগ না থাকায় চিকিৎসার পুরো খরচ মেটাতে হয় রোগীদেরকেই।
ডিস্ট্রেস ফাইন্যান্সিং বা চরম অর্থসংকটের মধ্যে রয়েছে গৃহস্থালীর সম্পদ, জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখে টাকা ধার করা এবং বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের কাছ থেকে অর্থসাহায্য নিয়ে সাধ্যের বাইরে যেয়ে খরচের ব্যবস্থা করা।
দেশি-বিদেশি গবেষক দ্বারা পরিচালিত এই সমীক্ষায় ৪৫ হাজার ৪২৩টি পরিবারের ১ লাখ ৮৩ হাজার ৭৫৭ জনের ওপর গবেষণা চালানো হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী এবং তাদের হাসপাতালে ভর্তির খরচসহ পরিবহন খরচ, অতিরিক্ত খরচ এবং অন্যান্য দৈনিক খরচ বিষয়ক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধ্যের বাইরের ব্যয় কমানোর ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাতে পরিবারগুলো চরম অর্থ সংকট বা বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় থেকে রক্ষা পায়।
গবেষণাদলের অন্যতম আব্দুর রাজ্জাক সরকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সামর্থের বাইরের খরচ কমাতে ওষুধের খরচ এবং অপ্রয়োজনীয় মেডিকেল টেস্ট কমাতে হবে। চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত নির্দেশিকা থাকতে হবে। ওষুধের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করা হলে, অপ্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবহার কমবে এবং মানুষের উপর আর্থিক চাপও কমবে।"
বর্তমানে, বাংলাদেশিদেরকে তাদের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮.৫০ শতাংশ খরচ নিজেদেরকেই বহন করতে হয়।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিক্স ইউনিট বলছে, রোগীদের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ খরচ হয় ওষুধ কিনতে, ২৩ শতাংশ খরচ হয় হাসপাতালের খরচ মেটাতে, এবং ৮ শতাংশ খরচ হয় রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় টেস্ট করাতে।
মাত্র ৩ শতাংশ রোগী সরকারি হাসপাতাল থেকে ওষুধ পান এবং ১৪.৯ শতাংশ রোগী রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা পান। বেশিরভাগ রোগীকে প্রাইভেট ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হয় এবং প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হয়। এতে পরিবারের খরচ বেড়ে যায় এবং তাদেরকে আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়।
আবদুর রাজ্জাক স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা চালু করারও পরামর্শ দেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে একজন রোগী গড়ে ৭.২ দিন হাসপাতালে থাকেন। হাসপাতালে রোগীদের সবচেয়ে বেশিদিন (২৫.৭ দিন) থাকতে হয় ক্যান্সারের কারণে। যক্ষ্মা রোগীরা হাসপাতালে থাকেন গড়ে ২০ দিন। এছাড়া, মানসিক রোগীরা থাকেন ১৩.৮ দিন এবং আঘাত বা দুর্ঘটনার শিকার রোগীরা থাকেন ১০.১ দিন।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) ডাঃ নুরুল আমিন টিবিএসকে বলেছেন, সামর্থের বাইরের ব্যয় কমাতে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাগুলো আরও কার্যকর হতে হবে। তা না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে ব্যয় ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনার এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
সংসদ সদস্য এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল আজিজ বলেন, সরকার পরীক্ষামূলকভাবে কিছু এলাকায় স্বাস্থ্য বীমা চালু করেছে। সারা দেশে এই সুবিধা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
সমীক্ষায় আরো দেখা যায় কীভাবে স্বাস্থ্য বীমার মাধ্যমে অন্যান্য দেশ তাদের নাগরিকদের সামর্থের বাইরের খরচের পরিমাণ কমিয়ে তাদের ওপর থেকে স্বাস্থ্য ব্যয়ের বোঝা কমাতে সাহায্য করেছে।
চীনে প্রবর্তিত আয়নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য বীমা নীতি ২০০৭ সাল থেকে নাটকীয়ভাবে সিএইচই এর পরিমাণ কমাতে সক্ষম হয়েছে।
বার্ষিক বাজেটে জনসাধারণের জন্য স্বাস্থ্য খাতে উচ্চ বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও, উন্নত অর্থনীতির রাষ্ট্রগুলোতে যারা সামর্থ্যের বাইরে খরচ করতে পারবেন না তাদের জন্যও যথেষ্ট বীমার ব্যবস্থা থাকে। বীমাকৃত ব্যক্তির ব্যক্তিগত আয়ের উপর নির্ভর করে কোরিয়াতে যেমন এই সীমা ১,৬৮৮ ডলার থেকে ৩,৩৭৫ ডলারের মধ্যে।
আবার সুইজারল্যান্ডে টাকার এই অংক ৭২৮ ডলার। সেই হিসাবে বাংলাদেশের কৃষক সিরাজুল ইসলাম ইতোমধ্যে ১৩ গুণ বেশি খরচ করে ফেলেছেন।
বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর আনুমানিক ৪৪ মিলিয়ন পরিবার বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্যব্যয়ের মুখোমুখি হয়; এ ব্যয়ের মূল্য চুকোতে গিয়ে ২৫ মিলিয়ন পরিবার দারিদ্র্যের মুখে পতিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) পরিবারের নিম্ন অর্থনৈতিক অবস্থা, স্বাস্থ্য বাজেটে কম বরাদ্দ, বীমার অভাব ইত্যাদির কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করেছে।
স্বাস্থ্যের জন্য বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ জিডিপির এক শতাংশেরও কম যা ৪৬টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত দুই দশক ধরে পরিবারগুলোকে অসংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য সামর্থ্যের অনেক বাইরে ব্যয় করতে হচ্ছে; চিকিৎসা যেমন দীর্ঘমেয়াদী হচ্ছে তেমনি হাসপাতালেও থাকতে হচ্ছে অতিরিক্ত সময়।
গ্লোবোকান ২০২০ রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১.৫৬ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
২০১৫ সালে, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ক্যান্সার রিসার্চ হাসপাতালের (এনআইসিআরএইচ) একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে, বহির্বিভাগে তখন রোগীর মোট সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৪ হাজার ৩৭ জন; একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল ৭ হাজার ২৮৫ জন।
স্বাস্থ্যের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দিন দিন নন-কম্যুনিকেবল ডিজিজ তথা অসংক্রামক রোগের হার বেড়েই চলেছে; বর্তমানে ২ কোটির বেশি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদযন্ত্রের রোগ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদী শ্বসনতন্ত্রের রোগ, ক্যান্সার এবং মানসিক রোগ। দেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশের পেছনেই দায়ী অসংক্রামক রোগ।
সমীক্ষায় এসেছে, সবচেয়ে বড় নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে ক্যান্সারের, এরপরেই রয়েছে যকৃতের রোগ এবং পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস।
৪৩ শতাংশ পরিবার সম্পত্তি বিক্রি করে, ধার-কর্জ করে বা নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে সহায়তা গ্রহণ করে স্বাস্থ্যসেবা খরচ মেটায় বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়।
সমীক্ষাতে আরও উঠে এসেছে স্বাস্থ্য ব্যয়ের বোঝা দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে কীভাবে সরাসরি প্রভাবিত করে। এক অনুমানে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়।
পরিবারগুলোর উপর এই খরচের বোঝা কমানোর জন্য সমীক্ষাটি জাতীয় স্তরের সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রকল্প প্রণয়নের পরামর্শ দেয় যেখানে স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর উপর বিশেষ নজর, বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্য খরচ নিয়ন্ত্রণ এবং ক্যান্সার, হার্ট, লিভার এবং কিডনি রোগীদের জন্য ভর্তুকিযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
পরিশেষে সমীক্ষাটির উপসংহারে এটাই বলা হয়েছে যে, সামর্থ্যের ঊর্ধ্বে ব্যয়ের উপর নির্ভরতা কমাতে সরকারের উচিত স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর ব্যাপারে বিবেচনা করা।