পাওনা পরিশোধে এলপিপির নতুন শর্ত, অযৌক্তিক বলছেন বাংলাদেশের সরবরাহকারীরা
মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের অন্যতম খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এলপিপি সম্প্রতি বাংলাদেশি পোশাক প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে পুরানো অর্ডারের পাশাপাশি নতুন অর্ডার ডেলিভারি নেওয়ার ক্ষেত্রেও নতুন শর্ত আরোপ করেছে। বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের অভিযোগ, সম্পূর্ণ পাওনা পরিশোধের দায় এড়াতে নতুন এই শর্ত আরোপ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
শর্তে বলা হয়েছে, ট্রিম এবং লেবেলিংয়ের ত্রুটির জন্য অর্ডার মূল্যের ২৫ শতাংশ এবং ভুল ঠিকানায় পণ্য সরবরাহের জন্য আরও ২৫ শতাংশ অর্থ কেটে নেবে এলপিপি।
কোম্পানির জারি করা নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি ডেলিভারির জন্য নির্ধারিত তারিখের পরেও পণ্য পাঠানো না হয়, সেক্ষেত্রে পণ্য নেওয়া বা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার থাকবে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের এবং এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতেও বাধ্য থাকবে না।
নোটিশে আরও বলা হয়েছে, পণ্য সরবরাহে এক সপ্তাহ দেরি হলে অর্ডার মূল্যের ৩ শতাংশ এবং দুই সপ্তাহ দেরি হলে ৬ শতাংশ অর্থ কাটতে পারবে এলপিপি। আর তিন সপ্তাহ দেরির ক্ষেত্রে অর্ডার বাতিল বা অর্ডারের মূল্যের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কেটে নেওয়ার অধিকার থাকবে কোম্পানির।
সূত্রের তথ্যমতে, গত ১৭ অক্টোবর, ২০২২ তারিখে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত 'পেমেন্ট পরিশোধে দেরি, বিপাকে পোলিশ প্রতিষ্ঠান এলপিপি-র ১০০ বাংলাদেশি সরবরাহকারী' শিরোনামের একটি প্রতিবেদনের পর, অর্ডার দেওয়া পণ্য নিয়ে যেতে শুরু করেছিল পোলিশ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অর্ডারের মোটামুটি অর্ধেক পণ্য ডেলিভারি নেওয়ার পরে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাকি প্রায় ৯০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য তারা নভেম্বরে নেবে।
বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন নিয়ম অনুসারে, অর্ডার মূল্যের ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত কেটে নেওয়ার সুযোগ বা অর্ডার বাতিল করার অধিকার রয়েছে কোম্পানিটির।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এলপিপি এখন পুরাতন সরবরাহকারীদের এড়িয়ে গিয়ে নতুনদের কাছে অর্ডার দিচ্ছে। অথচ পুরাতনদের এলপিপির নতুন পণ্য তৈরির সক্ষমতা রয়েছে; কিন্তু শোষণমূলক এই শর্ত আরোপের কারণে তাদেরকে নতুন অর্ডার দেওয়া হচ্ছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কোম্পানি যে ক্ষতির মধ্যে পড়েছে, তা পুষিয়ে নিতেই এ ব্যবস্থা নিয়েছে তারা।
টিএডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন টিবিএসকে বলেন, "এলপিপি সমস্ত নিয়ম ও ব্যবসায়িক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে এ অনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক একটি সংকটের কারণে ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় এ ধরনের নোটিশ দেওয়ার কোনো অধিকার নেই কোম্পানিটির; কারণ সরবরাহকারীরাও একই সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।"
তুহিন বলেন, সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে এলপিপি হয়তো সরবরাহকারীদের সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু শিপমেন্ট দেরিতে হওয়ায় ব্যাংকের অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকরাও সমস্যায় পড়েছেন।
তিনি বলেন, শিপমেন্টে দেরি হলে ক্রেতারা সাধারণত জরিমানা আরোপ করে, তবে এখানে আলোচনার সুযোগও রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে একটি বহুজাতিক বায়িং হাউসের প্রধান টিবিএসকে বলেন, ট্রিম এবং লেবেলিংয়ে কোনো ত্রুটি থাকলে ক্রেতাদের উচিত সরবরাহকারীদের জরিমানা না করে ভুল সংশোধনের সুযোগ দেওয়া। বেশিরভাগ ক্রেতাই ভুলের জন্য প্রস্তুতকারকদেরকে সংশোধনের সুযোগ দেয়।
"এছাড়া, যদি কোনো সরবরাহকারী সময়মতো পণ্য পাঠাতে না পারে, তখন ক্রেতারা সাধারণত তাদেরকে এয়ার ফ্রেইটের মাধ্যমে পণ্য পাঠাতে বলে। সেখানে এলপিপির এরকম কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরোপ করা অনৈতিক," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশি সরবরাহকারীরা আরও বলছেন, পণ্য সরবরাহে দেরি হলে সরবরাহকারীদের ওপর জরিমানা চাপানোর নোটিশ দিয়েছে এলপিপি। অথচ প্রতিষ্ঠানটি নিজেই যখন ডেলিভারি নিতে দেরি করে, ডেলিভারির তারিখ পেছায় তখন এর পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ফল ভোগ করে না তারা।
এছাড়া, ক্রেতারা নিজেরাই তাদের দেশে ডেলিভারি প্রক্রিয়ায় সমন্বয় করে সহজেই ভুল ঠিকানায় চালান সরবরাহের সমস্যাটি সমাধান করতে পারে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) ভাইস-প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, এলপিপির নতুন শর্ত একেবারেই অযৌক্তিক এবং এটি দেশের আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক্সপোর্ট ভ্যালুর ৫ শতাংশের বেশি দামের ওপর কোনো ছাড় বা জরিমানা করে না। কেউ যদি এমনটি করে তাহলে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক সংকটের কারণে পোশাক রপ্তানিকারকরা বর্তমানে ৩ থেকে ৬ শতাংশ প্রোফিট মার্জিন বা লাভে ব্যবসা করছেন। এদিকে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনেক রপ্তানিকারক ব্রেকইভেন পয়েন্টে বা তার নিচেও ব্যবসা করছেন।
"প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশনের সময় সমস্ত পণ্য পরীক্ষা করে নেওয়া ক্রেতার দায়িত্ব। এ বিষয়ে কথা বলতে পোলিশ খুচরা বিক্রেতার স্থানীয় অফিস প্রতিনিধিকে ডাকবে বিজিএমইএ," যোগ করেন তিনি।
সমস্যায় রয়েছে এলপিপি
ব্র্যান্ডটির লিয়াজোঁ অফিস ও বায়িং অফিসের প্রতিনিধিরা বলছেন, এলপিপি রাশিয়া ও ইউক্রেনে তাদের প্রায় ৮০০টি দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। এ কারণে পণ্যের চাহিদা কমার পাশাপাশি এসব দোকানের জন্য অর্ডার করা পণ্যগুলো বাংলাদেশে আটকে গেছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলপিপির সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশের প্রায় ১০০ পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। ব্র্যান্ডটির জন্য প্রস্তুতকৃত পোশাক পণ্যের চালান ও পেমেন্ট পরিশোধ বিলম্বিত হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছে বাংলাদেশের এই ব্যবসায়ীরা।
ফলস্বরূপ, বাংলাদেশি রপ্তানিকারক ও তাদের কাঁচামাল সরবরাহকারীরা ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি পেমেন্ট না পাওয়ায় তারল্য সংকটের মুখে পড়েছেন।
এলপিপির ওয়েবসাইট অনুসারে, খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় আমদানি সহযোগী বাংলাদেশ। ব্র্যান্ডটির পোশাক পণ্যের চাহিদার ৭০ শতাংশই পূরণ হয় করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে তারা সিরামিক, টেবিলওয়্যার ও পাটজাত পণ্য আমদানি করে থাকে।
২০২১ সালে খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টার্নওভার ছিল ২.৮৪ বিলিয়ন ডলার।
দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এলপিপির কান্ট্রি ম্যানেজার
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হতেই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশে এলপিপির কান্ট্রি ম্যানেজার।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সরবরাহ শৃঙখলে স্বচ্ছতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বাংলাদেশে এলপিপির কাজ শুরু করেন।
বাংলাদেশে অফিস খোলার পর, এলপিপি বড় প্রবৃদ্ধির মুখ দেখে এবং প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ থেকে সিরামিক, পাট এবং চামড়াজাত পণ্য আমদানি শুরু করে।