পঞ্চাশ বছর আগে বিশ্বের প্রথম মোবাইল ফোন থেকে কল করা হয়েছিল
১৯৭৩ সালের ৩ এপ্রিল, আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগের এই দিনে নিউইয়র্কের সিক্সথ এভিনিউর এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সেলফোনের জনক মার্টিন কুপার। নিজের পকেট থেকে ছোট একটা ফোন বুক বের করলেন তিনি; এরপর হাতে তুলে নিলেন ক্রিম রঙের বড় একটা ডিভাইস, নম্বর পাঞ্চ করলেন এর মধ্যে এবং ডিভাইসটি কানের পাশে ধরলেন... পথচারীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল কুপারের দিকে।
তৎকালীন মটোরোলার ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার মোবাইল ফোন দিয়ে প্রথম কলটি করেছিলেন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান বেল ল্যাবরেটরিজের জোয়েল এস এঞ্জেলকে। আর তার হাতে ধরে রাখা সেই ফোনটি ছিল 'ব্যক্তিগত, হাতের মুঠোয় ধরে রাখার মতো এবং যেকোনো জায়গায় বহনযোগ্য' একটি সেলফোন।
নম্বর ডায়াল করার পর অপর প্রান্তে সুনসান নীরবতা। "আমার মনে হয়, ঐ মুহূর্তে সে দাঁত কিড়মিড় করছিল', হাসতে হাসতে বলেন ৯৪ বছর বয়সী কুপার। কুপারের এই ফোন কলই ছিল মানবসভ্যতার জন্য এক যুগান্তকারী মুহূর্ত...যা বদলে দিয়েছিল পৃথিবীকে।
মার্টিন কুপার ও তার টিম যে সময়ে সেলফোন উদ্ভাবনের জন্য চেষ্টা করছিল, বেল ল্যাবরেটরিজ তখন একটি 'কার-বেইজড' ফোন তৈরির চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। সকৌতুকে কুপার বলেন, "ভাবতে পারছেন কি? ১০০ বছর ধরে এই কপারের তার আমাদেরকে ঘরে এবং অফিসে আটকে রেখেছিল, এখন এটা আমাদের গাড়িতে আটকে রাখতে চায়!"
কিন্তু সেটি হতে দিতে চাননি কুপার এবং মটোরোলা। বরং প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা মানবসভ্যতার জন্য সবচেয়ে উপকারী একটি ডিভাইস উদ্ভাবন করেছিলেন।
কিভাবে প্রথম ফোনকল কাজ করেছিল সেই ধারণা এখনও খুব একটা বদলায়নি। ফোন আমাদের কণ্ঠস্বরকে ইলেক্ট্রিক সিগন্যালে রূপান্তর করে যা আবার একটি রেডিও তরঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এই রেডিও তরঙ্গ ট্রান্সমিটারের কাছে যায় এবং সেটি আবার আমাদের কণ্ঠস্বরকে ফোনের অপরপ্রান্তের ব্যক্তির কাছে পাঠায়... এ প্রক্রিয়া রিভার্স করার মাধ্যমে অবশেষে অপরপ্রান্তের ব্যক্তি আমাদের কথা শুনতে পায়।
যদিও বর্তমানকালের মোবাইল ফোনের সাথে মোটরোলার শুরুর দিকের মডেলগুলোর মিল নেই। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রথম কল করার ১১ বছর পর, ১৯৮৪ সালে মার্টিন কুপারের বানানো প্রোটোটাইপের বাণিজ্যিক সংস্করণ মটোরোলা ডায়নাট্যাক ৮০০০এক্স বাজারে আনা হয়। দ্য মোবাইল ফোন মিউজিয়াম-এর পরিচালক বেন উড বলেন, বর্তমানের হিসাবে ওই ফোনের বাজারমূল্য হবে ৯৫০০ পাউন্ড (১১,৭০০ ডলার)।
"মূলত এটা ছিল শুধু নম্বর ডায়াল করো এবং কল করো'র মতো ব্যাপার", বলেন বেন উড। "ঐ ফোনে কোনো ক্যামেরা ছিল না, ম্যাসেজ পাঠানোর সুযোগ ছিল না। ত্রিশ মিনিট টক-টাইম, ব্যাটারি চার্জ দিতে লাগতো ১০ ঘণ্টা এবং স্ট্যান্ডবাই টাইম ছিল ১২ ঘণ্টা, আর উপরে ছিল ৬ ইঞ্চির একটা অ্যান্টেনা", যোগ করেন তিনি।
মোটরোলার সেই ফোনের ওজন ছিল ৭৯০ গ্রাম- যা বর্তমানে একটি আইফোন ১৪ এর ওজনের প্রায় চার গুণ বেশি!
তবে মার্টিন কুপার কিন্তু ২০২৩ সালে এসেও এখনকার হ্যান্ডসেটের ডিজাইন নিয়ে সন্তুষ্ট নন। যদিও তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি কখনো ভাবতেই পারেননি মোবাইল ফোন একদিন হ্যান্ডহেল্ড 'সুপারকম্পিউটার' হয়ে উঠবে এবং এতে ক্যামেরা-ইন্টারনেট সেবাসহ এত সুযোগসুবিধা থাকবে।
"আমার মনে হয় বর্তমানকালের মোবাইল ফোন সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন নয়। অনেকগুলো দৃষ্টিকোণ থেকেই এটা সত্যিই খুব ভালো ফোন নয়। আপনি এখনকার ফোনগুলোর কথা ভাবুন; এক টুকরো প্লাস্টিক এবং কাচ- যেটা সমতল- আর ওই জিনিসটাকেই আপনার কানের পাশে চেপে রাখতে হবে। এই ফোনটা হাতে ধরে রাখাও অস্বস্তিকর, আর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চমৎকার কাজগুলো করতে চাইলে আপনাকে আগে একটা অ্যাপ নিতে হবে।"
মার্টিন কুপার মনে করেন, ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ফোনের মালিকদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের জন্য অ্যাপ তৈরি করবে অথবা অ্যাপ নির্বাচন করে দিবে।
তিনি আরও মনে করেন, একদিন এই ডিভাইসটিই মানুষের স্বাস্থ্যের উপর নজর রাখবে, ব্যক্তির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে এবং জীবনমান উন্নত করবে। এক পর্যায়ে কুপার এও মতামত ব্যক্ত করেন যে, মোবাইল ফোন হয়তো যুদ্ধ পরিহার করতেও সাহায্য করবে!
"মোবাইল ফোন একা এটা করতে পারবে না। কিন্তু এই ডিভাইসটি আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে", বলেন কুপার।
আধুনিক মোবাইল ফোন নিয়ে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, একান্ত গোপনে মার্টিন কুপার হয়তো পঞ্চাশ বছর আগে নিজের তৈরি করা ডিভাইসটির প্রতিই মুগ্ধ... যে ডিভাইসের মাধ্যমে তিনি সিক্সথ এভিনিউ থেকে বিশ্বের প্রথম মোবাইল ফোন কলটি করেছিলেন।
সেলফোনের জনকের মন্তব্য, "আমরা এখনও সেলফোন বিপ্লবের একেবারে শুরুর দিকে আছি।"