আমরা একজন বড় মাপের মানুষকে হারালাম
রোকেয়া আফজাল রহমান, সকলের প্রিয় রকি আপা, আমাদের মাঝে আর নেই। তিনি অসুস্থ ছিলেন জানতাম। শেষ যখন হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ লিখে জানতে চেয়েছিলাম- আপা, কেমন আছেন? অকপটে বললেন, ভাল নেই। এমনভাবে তাঁকে কখনো বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তিনি সব সময় সক্রিয় একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর মুখে ভাল না থাকার কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে শোকে আচ্ছন্ন হয়েছি।
রোকেয়া আফজাল রহমান একজন প্রথিতযশা উদ্যোক্তা ছিলেন, তাঁকে আমি ব্যবসায়ী বলতে রাজী নই। কারণ তাঁর মধ্যে আমি সব সময় উদ্যোগ দেখেছি; শুধু নিজের জন্যে নয়, অন্যদের জন্যেও। তিনি মিডিয়া ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের চেয়ারপার্সন ছিলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাইডাসের বোর্ডের চেয়ারপার্সন, মহিলা উদ্যোক্তা সমিতি বা উইমেন অন্ট্রোপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ দেশি-বিদেশি বহু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পুরুষ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের মধ্যে একমাত্র নারী সদস্য হয়ে ছিলেন দীর্ঘদিন। রাজনীতি করতেন না, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন। ব্যস্ততার শেষ ছিল না তাঁর।
রোকেয়া আপাকে অন্যদের মতো আমি রকি আপা সম্বোধন করতাম না। আমি রোকেয়া আপা বলেই ডাতাম। আমি দেশে তাঁকে যতো না কাছে পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি পেয়েছিলাম দেশের বাইরে। রোকেয়া আপা এবং আমি দুজনেই সাউথ এশিয়ান উইমেন নেটওয়ার্ক (সোয়ান)-এর সদস্য। বাংলাদেশ থেকে বন্ধু শাহীন আনাম এবং সুরাইয়া চৌধুরীও সোয়ানের সদস্য। যেকোনো কারণেই হোক সোয়ানের সভাগুলোতে প্লেনে করে যাওয়া আসার সময় রোকেয়া আপার সাথে আমার যাওয়া হয়েছে বেশি। তখন কথা বলেছি এয়ারপোর্টে, প্লেনে পাশাপাশি সিটে বসে এবং যেখানে সম্মেলনে গেছি সেখানে।
তাঁর সাথে ভুটান, মিয়ানমার, ভারত (দেহরাদুন) সহ কয়েকটি দেশ গেছি। তখন জেনেছি তাঁর কাজের কথা; তিনি যেসব নারীদের উদ্যোগকে খুব পছন্দ করতেন তাদের কথা, বাংলাদেশের বড় বড় এনজিওর কথা। ব্রাকের ফজলে হাসান আবেদ, ড. মুহাম্মদ ইউনুসসহ সব বড় বড় এনজিও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁর অভিজ্ঞতার তুলনায় আমার অভিজ্ঞতা একেবারে নগণ্য, কিন্তু কেন জানিনা তিনি আমাদের নয়াকৃষি আন্দোলনের কাজ এবং বিশেষ করে বীজ রক্ষার কাজকে খুব বড় করে দেখতেন। আমাকে বলতেন, 'তোমরা এই কাজ আরো বাড়াও না কেন।' তিনি কোন এক ফাঁকে আমাদের টাঙ্গাইল নয়াকৃষি বিদ্যাঘর ঘুরেও এসেছিলেন। আমি ছিলাম না। আমি বলেছিলাম, আমিসহ একবার আসেন। কিন্তু সেটা আর হয়নি। আমরা শস্যপ্রবর্তনা করেছি, তাতেও তাঁর উৎসাহের শেষ নেই। বলতেন, এটা খুব ভাল কাজ। অন্যদেরও আমাদের কাজের কথা বলতেন।
২০১৯ সালেও আমরা যেবার দেহরাদুনে গিয়েছিলাম, সেখানে ইকোটুরিজম প্রকল্প দেখতে গিয়ে যেভাবে তিনি পাহাড় বেয়ে উঠলেন এবং নামলেন, আমি তো অবাক! আমি পারিনি। আমি মাঝ পথে এক জায়গায় বসে পড়েছিলাম, দমে কুলাতে পারছিলাম। আর রোকেয়া আপা? তিনি দিব্যি ঘুরে আসলেন আর এসে বললেন, 'না গিয়ে ভুল করেছো। ওখানে অনেক কিছু দেখার ছিল।'
রোকেয়া আপা সব সময় টিপটপ, অথচ কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না তাঁর পোশাকে বা চলনে।
রোকেয়া আপা অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর কথা বলে শেষ করা যাবে না। সোয়ান একজন বড় মূল্যবান সদস্য হারালো, আমরা হারালাম একজন বড় মাপের মানুষকে।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী