‘দ্য লাগেজ সং’
জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আরিফ
'মেরা কুছ সামান তুম্হারে পাস পড়া হ্যায়
ঔ সাওয়ন কে কুছ ভিগে ভিগে দিন রখে হ্যায়
ঔ ঔর মেরে এক খৎ মৈঁ লিপতী রাত পড়ী হ্যায়
ঔ রাত ভুলা দো, মেরা ঔ সামান লৌটা দো'
সুবোধ ঘোষ ম্যাট্রিক পাস করে সেন্ট কলাম্বাস কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু অভাবে পড়ে সে পড়াশোনা আর চালানো যায়নি। বাসের কন্ডাকটরি দিয়ে শুরু, তারপর হাজারীবাগের বস্তি আর পূর্ব আফ্রিকাতে কলেরার টিকাকর্মী, অভ্র খনির ওভারসিয়ার, বোম্বে পৌরসভার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, গৌরাঙ্গ প্রেসের প্রুফরিডার, মালগুদামের হিসাবরক্ষক, সার্কাসের ক্লাউন, বেকারি মালিক, চা বিক্রেতা—জীবিকার প্রয়োজনে কী করেননি তিনি! শেষে পত্রিকার বিভাগীয় সহকারী। গান্ধীজির সহচর হিসেবে রাজনীতি করে স্বল্প জেলবাসের অভিজ্ঞতাও তাঁর আছে। প্রথম গল্প লেখেন 'অযান্ত্রিক', তারপরে 'ফসিল'। এসব গল্পের কাহিনি, ভাষা ওই সময়ের চেয়ে ঢেড় এগিয়ে ছিল। ঋত্বিক ঘটক যখন 'অযান্ত্রিক'কে চলচ্চিত্রায়ণ করেন, তখন দেখা গেল এক মাস্টার আর্টিস্টের কাজ আরেক মাস্টার আর্টিস্টের হাতে পড়ে কয়েক দশক এগিয়ে থাকা একটা ওয়ার্ল্ডক্লাস সিনেমা হয়ে গেছে। 'থির বিজুরি' বা 'জতুগৃহ' যখন প্রকাশিত হলো, পাঠককুল বুঝে গেলেন সুবোধ ঘোষ ভবিষ্যতের মানুষ। তপন সিনহা যখন 'জতুগৃহ' নিয়ে সিনেমা বানালেন, তখন সেটা আর সুবোধ ঘোষের গল্প থাকল না, বস্তা পচা ফর্মুলাবদ্ধ বাংলা সিনেমা হলো। আরও পরে সম্পূরণ সিং কালরা ওরফে গুলজার একই গল্প নিয়ে যখন 'ইজাযত' বানালেন, তখন সেটাও একই প্রকারের ফর্মুলাবদ্ধ হিন্দি সিনেমা হলো। পঞ্চাশের দশকে লেখা সুবোধ ঘোষের গল্পের চেয়ে ষাট আর আশির দশকে বানানো সিনেমা কয়েক আলোকবর্ষ পিছিয়ে থাকল। বিচিত্র সব বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা, বিচিত্র সব পেশায় জীবিকা নির্বাহ করা থেকে একটা একটা রত্ম কুড়িয়ে সুবোধ ঘোষ যে 'লাগেজ'টি ভরেছিলেন, সেটি অর্জন করা তো সহজ বিষয় নয়। ঘোষের 'লাগেজ' তাই সিনহা আর সিং-এর জন্য অধরাই থেকে গেল।
জিন্তি বুড়িকে আমরা চোখে দেখিনি, আম্মুর কাছে কেবল তাঁর গল্প শুনেছি আর তাঁর এক গোছা চাবি দেখেছি। জিন্তি বুড়ির আসল নাম যেমন আমরা জানি না, তেমন জানি না তিনি আসলে কোথা থেকে এসেছেন—ভাগলপুর, নাকি মুঙ্গের, নাকি বেগুসরাই! শুধু জানি '৪৬-এর বিহারের দাঙ্গায় সব হারিয়ে তিনি ভাসতে ভাসতে একসময় ঢাকা চলে আসেন। এখানে তাঁর সখ্যতা হয় বিশ্বযুদ্ধ-মহামারি-দুর্ভিক্ষ-দেশভাগ-বৈধব্যে হাওড়া থেকে সব হারিয়ে ভাসতে ভাসতে ঢাকায় চলে আসা মালেকা বেগমের সাথে। নিজ ভূমি থেকে মালেকা বেগম সাথে করে একটা সুরমাদানি আনতে পেরেছিলেন আর জিন্তি বুড়ি তাঁর ঘরের চাবির গোছা—যে ঘর বহু বহু কাল আগে ভিন্ন দেশের ভিন্ন মানুষের হয়ে গিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেছে। মালেকা বেগমের পৌত্র-পৌত্রী আমরা ভাইবোনেরা আম্মুর কাছে রাখা ওই দুটো জিনিসই দেখেছি কিন্তু এসবের পেছনে থাকা মালেকা বেগম বা জিন্তি বুড়ির অদৃশ্য 'সামান'গুলো দেখতে পাইনি। সেগুলো সবার কাছে সারা জীবনের জন্য অধরা হয়ে গেছে।
'পতঝড় হ্যায় কুছ, হ্যায় না?
ঔ পতঝড় মৈঁ কুছ পত্তৌ কে গিরনে কী আহট
কানৌঁ মৈঁ এক বাত পহন কে লৌট আয়ী থী
পতঝড় কী ঔ শাখ অভী তক কাঁপ রহী হ্যায়
ঔ শাখ গিরা দো, মেরা ঔ সামান লৌটা দো'
সম্পূরণ সিং কালরা থেকে গুলজার দিনভি তা থেকে শুধুই গুলজার—নামের এই পরিক্রমা নিছক খেয়ালবশে নয়। দেশভাগের করাল থাবায় নিজ ভূমি থেকে উৎখাত হওয়া ছিন্নবিচ্ছিন্ন পরিবারের সন্তান সম্পূরণ উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাবের সোয়ান উপত্যকার মধ্য-প্লায়োস্টিসিন যুগের পুরোনো অঞ্চল দিনা থেকে যখন আড়াই হাজার বছরের পুরোনো মহারাষ্ট্রের নগর বোম্বেতে চলে আসতে বাধ্য হন, তখন তিনি শুধু সমৃদ্ধির জীবনই ছেড়ে আসেননি, সাথে ছাত্র পরিচয়ে ইতি টেনে বেলাসিস রোডের 'ভিকার মোটরস'-এ পুরোনো গাড়ি রং করার মিস্ত্রির পরিচয় গ্রহণ করেন। তবে সম্পূরণ তো হেমন্তে পাতা ঝরার শব্দ শুনতে পাওয়া মানুষ, যার কাছে হাজারো জনের হাজারো জীবনের কথা ফিরে ফিরে আসে। তাই গাড়ি রং করার পাশাপাশি তিনি কলেজে ভর্তি হন, লিখতে শুরু করেন এবং প্রগতিশীল লেখক সংঘে যোগ দেন। বাইরের জগতের সাথে অপরিচয়ের পর্দা যখন কাঁপতে কাঁপতে খসে পড়ে, তখন সম্পূরণ সিং কালরা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হবার বদলে লেখক গুলজার দিনভিতে পরিণত হন। তখনো তিনি তাঁর পরিচয়ে নিজের উৎসস্থল দিনাকে ধরে রাখেন। একসময় গুলজার দিনভির লেখনীর সৌরভ দেশ-কালের সীমা ছাড়িয়ে যায়—নামের শেষের দিনভি খসে পড়ে শুধুই গুলজার টিকে থাকে। যিনি কবিতা, গীতিকবিতা, কথাসাহিত্য, চিত্রনাট্য আর চলচ্চিত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত গোলাপ ফুটিয়ে তুলবেন, তাঁকে তো কেবল 'গুলজার' নামেই মানায়, তাঁর নামের শেষে আর কোনো পদবির প্রয়োজন নেই। এটা তো আমাদের ভাবনা, কিন্তু মনের ভেতরে সম্পূরণ কি আজও দিনাতে থেকে যাওয়া তাঁর 'সামান' ফিরে পেতে চান?
আমাদের পাড়ার শেষ প্রান্তে একটা বিশাল আকারের পরিত্যক্ত বাড়ি ছিল—বাহির মহল, অন্দর মহল, দুটো পুকুর, ছোট মন্দিরসহ। ওই বাড়ির মেয়ে সাধনা রায় স্কুলজীবনে আম্মুর সহপাঠী ছিলেন। '৬৫-এর যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে রায়বাবুরা রাতারাতি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। 'শত্রু সম্পত্তি'তে পরিণত হওয়া তাঁদের বাড়িঘর বহু বছর এভাবেই পড়ে ছিল। খুব ছোটবেলায় আমরা দেখতাম লতা আর আগাছায় ছেয়ে থাকা পড়ো পড়ো ঘরগুলোতে অনেকগুলো ভিখিরি বাস করতেন। শত্রুদের বিষয়সম্পত্তি তো বিজয়ীপক্ষের ভোগের জিনিস, তাই রায়দের বাড়িঘর এখন অনেক মানুষের বাড়িঘরের ভেতরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হবার অনেক পরে একবার সাধনা রায় এসেছিলেন, আম্মুর সাথে দেখাও করেছিলেন কিন্তু হেমন্তের বাতাসে তিনি তাঁদের বাড়ির সামনের জারুলগাছের পাতা ঝরা বা বাড়ির পেছনের শিলকড়ই গাছের সরু ডাল কাঁপা দেখতে পাননি। হারিয়ে যাওয়া বাস্তুভিটে থেকে এক অশ্রুত ডাক কেবল তাঁর কানে পৌঁছেছিল, যে ডাকের টানে তিনি ফিরে এসে দেখতে চেয়েছিলেন এখনো কে এমন করে তাঁকে ডাকে!
'এক অকেলী ছত্রী মৈঁ জব আধে আধে ভীগ রহে থে
আধে সুখে আধে গীলে, সুখা তো মৈঁ লে আয়ী থী
গিলা মন শায়দ বিস্তর কে পাস পড়া হো
ঔ ভিজওয়া দো, মেরা ঔ সামান লৌটা দো'
ষোল বছর বয়সী আশা মঙ্গেশকর তাঁর চেয়ে পনেরো বছরের বড় গণপতরাও ভোঁসলের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তার এগারো বছর পরে তাঁদের আধা সুখা আধা ভেজা যৌথ পথ চলার সমাপ্তি ঘটে। এগারো বছরের ফসল তিন সন্তান তো আর ফেলে আসার মতো 'সামান' নয়, অমন আরও অনেক কিছু ফেলে আসা যায় না। তাই বুঝি বিচ্ছেদের পরে গত তেষট্টি বছরেও আশার নামের শেষে ভোঁসলে থেকে যায়—বিছানার পাশে পড়ে থাকা ভেজা মনের মতো। রাহুল দেব বর্মণ ওরফে পঞ্চম যখন রীতা পটেলের সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন তখন আশার বিবাহ বিচ্ছেদের ছয় বছর হয়ে গেছে। অবশ্য পঞ্চম জন্মেছেনও আশার ছয় বছর পরে। আশার প্রথম বিয়েটা এগারো বছর টিকেছিল, পঞ্চমের প্রথম বিয়ে টিকেছে তার অর্ধেকেরও কম সময়। ১৯৮০ সালে দুজনে একসাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন বটে কিন্তু দুই সুরের মানুষের মধ্যকার সুর কেটে গিয়েছিল। আশার জন্য লেখা পঞ্চমের এই 'লাগেজ সং'টি বোধ করি ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী ছিল। অর্থকষ্টে ভুগে মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে চিরতরে চলে যাওয়া পঞ্চম আশাকে যে 'সামান' ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন, আশা সেটা তার তিন দশক ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন। সামনে আরও অনির্দিষ্টকাল তাঁকে এই 'লাগেজ' বয়ে বেড়াতে হবে।
মেহোনিদের নীল-ধূসর সাদা রঙের বাড়িটা বেশ পুরোনো, মোটা ইটের দেয়ালের, আর সামনের দিকে উঁচু উঁচু খিলানওয়ালা। থমাস আর এমিলি মেহোনির কন্যা লুসি মেহোনি বলত, এটা হচ্ছে বনেদি ইতালীয় বাড়ি, দেখছিস না কেমন উঁচু উঁচু খিলান আছে!
স্থাপত্য বিষয়ে তখন বা এখন কোনো সময়েই আমার কোনো জ্ঞান ছিল না। তাই জানি না, ওটা আদৌ বনেদি ইতালীয় বাড়ি কি না। তবে লুসিদের বাড়ির সামনের দিকের একটা অদ্ভুত আকৃতির ঘরে একটা ভাঙাচোরা কাঠের পিয়ানো দেখেছিলাম। লুসির ছোট ভাই জেমস একবার সেটার ভেতর থেকে তারের মতো পেতলের সরু সরু জিনিস বের করে আব্বাসের ভাঙারি দোকানে দিয়ে 'গাট্টা-মিঠাই' নিয়েছিল। আমি লুসিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
তোরা তাহলে ইতালি থেকে এসেছিস?
—না। এই বাড়ি একসময় কোনো এক ইতালীয়র ছিল। আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা তাঁদের কাছ থেকে কিনে নেন। আমরা হচ্ছি আইরিশ—আয়ারল্যান্ড থেকে এসেছি। দেখিস না আমরা বাড়িতে ইংলিশে কথা বলি।
আমি লুসির দিকে ভালো করে তাকাই। তার গায়ের রং ফর্সা হওয়া দূরে থাক, আমার চেয়েও কালো। তার চুলের রং কিছুটা লালচে বটে তবে সেটা তেল না দেবার দরুণ। তার চোখ মোটেও সবুজ বা নীল নয়, বরং কালচে-বাদামি বলা যেতে পারে। লুসিদের বাড়ির মানুষদের কথাতে কিছু ইংলিশ শব্দ আছে বটে, তবে অমন ইংলিশ শব্দ আমাদের বাড়ির মানুষদের কথায়ও আছে। আমাদের কিন্ডারগার্টেনের ইংলিশ টিচার, স্কুলের একমাত্র স্কার্ট পরা টিচার মিসেস মারফির ক্লাসে ঠিকমতো ইংলিশ বলতে না পারার দরুণ কাঠের স্কেলের বাড়ি খাওয়াদের দলে আমার সাথে লুসি মেহোনিও আছে।
লুসি রাগ রাগ গলায় বলে, আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন রে বদমাশ!
—না, দেখছি তুই সাহেবদের মতো দেখতে কি না। দেখলাম যে তোর চেহারা-সুরত আমাদের মতোই। তোর ইংলিশের দৌড় আমার মতোই খারাপ। গত বৃহস্পতিবারের সাপ্তাহিক পিটুনি পর্বে আমার সাথে তুইও মিসেস মারফির স্কেলের বাড়ি খেয়েছিস। এখন খামাখা আয়ারল্যান্ড থেকে আসার বাজে গল্প বানাচ্ছিস।
লুসি আমার ওপর রেগে আগুন হয়ে যায়। সে তড়বড় করে বলতে থাকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের চেহারা-সুরত আসলে কেমন হয়, কবে কখন আয়ারল্যান্ড থেকে তাদের পূর্বপুরুষ এই দেশে এসেছিল, খুব শিগগির তারা আবার আয়ারল্যান্ডে ফিরে যাবে ইত্যাদি।
স্বীকার করছি, দীপা রায়কে দেখার আগপর্যন্ত আমার কাছে লুসিকে বেশ ভালো লাগত, তবু আমি তার কথা বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করার কোনো কারণও নেই। ওর বাবা থমাস মেহোনি একটা আলসে, কর্মবিমুখ, বাটপার মাত্র। নিজের বাচ্চাকাচ্চা আর আশেপাশের মানুষদের আয়ারল্যান্ডের গল্প বলে সে বোঝাতে চায় যে সে খুব বনেদি মানুষ। সবাই তার এই মিথ্যাচার বোঝে। কেবল লুসি বুঝতে চায় না। বানোয়াট গল্প দিয়ে বানানো এক স্বপ্নকল্পের মধ্যে সে থাকতে চায়, প্রতিদিনের অভাব আর বঞ্চনাকে এভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। রোগা, প্যাঁকাটি লুসি মেহোনি তখন প্রতিনিয়ত অসম্ভব স্বপ্নের এক বিশাল 'লাগেজ' বয়ে বেড়াত—এখনো বয়ে বেড়ায় কি না, তা আর জানি না।
'এক সো সোলা চাঁদ কী রাতেঁ
এক তুমহারে কাঁধে কা তিল
গীলী মহেঁদী কী খুশবু ঝুঠ মুঠ কে শিকওয়ে কুছ
ঝঠ মুঠ কে বারে সব য়াদ করা দো
সব ভিজওয়া দো, মেরা ঔ সামান লৌটা দো'
'১৯৪২: আ লাভ স্টোরি' চলচ্চিত্রটিতে হিমাচল প্রদেশের ডালহৌসি, চাম্বা, খাজ্জর, কালাতপের দমবন্ধ করা সৌন্দর্যের মধ্যে রাজেশ্বরী পাঠকরূপী মনীষা কৈরালার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য দর্শকের মনে তখনই দোলা দেয় যখন তার সাথে পণ্ডিত উলহাস বাপটের সন্তুরের শব্দ তাঁর কানে মধু ঢালে। মনীষার কাঁধে কোনো তিল আছে কি না, জানি না; তবে তাঁর ওষ্ঠের ডান দিকের একটু ওপরে যে তিল আছে, তা ঘুম ঘুম চাঁদ আর মেহেদির সুবাস ছাড়াই বোখারা-সমরখন্দ কিনে নিতে পারে। উলহাস সরোদ শিখেছেন বিদুষী জারিন দারুওয়ালার কাছে, কণ্ঠসঙ্গীত শিখেছেন আগ্রা ঘরানার পণ্ডিত কৃষ্ণ গুন্ডপন্থ গিন্দ আর জয়পুর-আত্রাউলী ঘরানার পণ্ডিত য়মনরাও সদলিকরের কাছে। কিন্তু সন্তুরের মতো অসম্ভব কঠিন বাদ্যযন্ত্রটি তিনি কার কাছে শিখেছেন? জানি না। এ-ও জানি না, কী করে তিনি সন্তুরকে নতুন করে ডিজাইন করতে শিখলেন, অথবা বারোটি অর্ধস্বরের ক্রোমাটিক পদ্ধতিতে সন্তুরকে টিউন করতে শিখলেন, যেখানে একসাথে চার-পাঁচটি রাগের নোটকে মেশানো যায়। শুধু জানি পঞ্চমের সাথে মিলে ১৯৭৮ সালের 'ঘর' থেকে শুরু করে, ১৯৮৭ সালের 'ইজাযত' হয়ে ১৯৯৪ সালের '১৯৪২: আ লাভ স্টোরি' পর্যন্ত তাঁর সন্তুরের ব্যতিক্রমী সব সুর শ্রোতাকে অনেক হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তে ফিরিয়ে নিয়ে যায়; অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয়—হয়তো অতীতের সব মিথ্যে প্রতিশ্রুতিগুলোকেও!
কোল জাতির মানুষ ভারতবর্ষের নিকট ইতিহাসে অন্তত দুইবার বিদ্রোহ করেছিলেন। একবার ১৮২০-২১ সালে, আরেকবার ১৮৩১-৩২ সালে। প্রথমবারের যুদ্ধটা হয়েছিল সিংভূমের পোড়াহাটের জমিদার আর ইংরেজ সেনাপতি রোগসেসের বাহিনীর বিরুদ্ধে। ১৮২১ সালে 'চাইবাসার যুদ্ধে' কোলরা পরাজিত হন। এটা হচ্ছে সেই সময়, যখন বাংলা আর আসামের চা-বাগানগুলো চালানোর জন্য আজকের মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, অন্ধ্র, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চল থেকে ১১৬টি জনজাতির মানুষদের নানা প্রলোভন আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে, নানা ভয় দেখিয়ে নিয়ে আনার প্রস্তুতি চলছে। কোল জাতির মানুষ দীলিপ রাউতের কোনো এক পূর্বপুরুষকে ১৮৩০ সালের দিকে এভাবে মিথ্যে প্রতিশ্রতি দিয়ে চা-বাগান গড়ার জন্য ছোট নাগপুরের জঙ্গল থেকে সিলেটের জঙ্গলে আনা হয়েছিল। এভাবে যাদের আনা হয়েছে তাঁদের কারও উত্তরপুরুষ চা-বাগানের অদৃশ্য ঘেরাটোপ থেকে বের হতে পারেন না। তবে দীলিপ তার বন্ধুদের সাথে একবার বাগানের বাইরে শহরের ধাঙ্গড় কলোনিতে গেলে তেলুগু কন্যা আরতি রাজুর জুগুলার নচে (কণ্ঠার হাড়ের নীচে, গলার দিকে একটা তিল দেখেছিল। সেই তিলের দাম দিতে গিয়ে দীলিপ আরতিকে নিয়ে সিলেটের চা-বাগান থেকে ঢাকার ধলপুরের তেলুগু কলোনিতে পালিয়ে আসে। দীলিপ এখন ঢাকায় বদলি ধাঙ্গড়ের কাজ করে। দীলিপের পূর্বপুরুষকে ইংরেজদের আড়কাঠিদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো যেমন কালের পরিক্রমায় মিথ্যে প্রতিপন্ন হয়েছে, আরতিকে দেওয়া তার প্রতিশ্রুতিগুলোও তেমন একে একে মিথ্যে প্রতিপন্ন হয়েছে। তবু যেসব রাতে চাঁদ ওঠে, সেসব রাতে তাদের এক কক্ষের বাসার জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঘুমন্ত আরতির মুখে এসে পড়লে তার কণ্ঠের তিলটা এখনো দীলিপকে পাগল করে দেয়। পাশের খোলা নর্দমার পচা গন্ধ ছাপিয়ে তার নাকে চা-বাগানের কাঁচা পাতার খুশবু এসে লাগে।
'এক ইজাযত দে দো বস
জব ইসকো দফনাওঙ্গী
মৈঁ ভী ওহীঁ সো জাউগীঁ'
স্মৃতির সাথে যদি কেউ সমাহিত হতে চায়, তাহলে তার জন্য আসলে কারও অনুমতির প্রয়োজন পড়ে না। জতুগৃহের শতদল আর মাধুরী বুঝেছিল, কিছু স্মৃতি আসলে হারায় না, মুছে যায় না—ওগুলো 'ন হন্যতে'। রাজপুর জংশনের অপেক্ষাগৃহে তাদের যৌথ জীবনের স্মৃতি সমাহিত হয় না, বরং সেখানে তা অমরত্ব লাভ করে। ইজাযতের সুধা যখন মহেন্দ্রকে প্রণাম করে বিদায় নেয়, তখন সে আসলে মহেন্দ্র সংশ্লিষ্ট সব স্মৃতি রেলের ওই অপেক্ষাগৃহে সমাহিত করে তার স্বামীর সাথে চলে যায়। ফলে ইজাযত আর জতুগৃহ হতে পারে না।
'১৯৪২: আ লাভ স্টোরি' চলচ্চিত্রের এক দৃশ্যে দেখি রাজেশ্বরী পাঠকরূপী মনীষা কৈরালার তাঁর পিতা রঘুবীর পাঠকরূপী অনুপম খেরকে ওষুধ সেবনের কথা মনে করিয়ে দেন, তাঁর হাতে ওষুধ তুলে দেন। এটা দেখে আমার মনে হলো, আমার যদি একটা কন্যা থাকত, তাহলে সে-ও কি প্রতিবেলায় আমার হাতে এভাবে ওষুধ তুলে দিত? ভাই বা বোনের কন্যাদের যখন দেখি, তখন মনে হয়, এই মেয়েটা আমার ভাই-বোনের ঘরে না জন্মে আমার ঘরেও জন্মাতে পারত। তখন নিশ্চয়ই আমার জীবন এমন হতো না। যা আর কখনো হবার নয়, তা নিয়ে দুঃখ বিলাসের মানে নেই। রাগ ইমনে গাওয়া 'দ্য লাগেজ সং' শুনতে শুনতে ভাবি কত অপূর্ণ স্বপ্ন-সাধ-আশা সাথে নিয়েই তো একদিন সমাহিত হতে হবে, তার জন্য কারও অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না। এমনকি লুসি মেহোনি বা দীপা রায়ের স্মৃতিগুলো সাথে নিয়ে সমাহিত হতেও তাদের অনুমতির প্রয়োজন নেই।
গীতিকার ও সুরকার: রাহুল দেব বর্মণ ওরফে পঞ্চম
কণ্ঠশিল্পী: আশা (মঙ্গেশকর) ভোঁসলে
সন্তুর শিল্পী: উলহাস বাপট
রাগ: ইমন
চলচ্চিত্র: 'ইজাযত' (১৯৮৭)
চিত্রপরিচালক: সম্পূরণ সিং কালরা ওরফে গুলজার
মূল কাহিনি: 'জতুগৃহ' (সুবোধ ঘোষ)