পাইকারিতে রমজানের ভোগ্যপণ্যের দাম কমেছে, প্রভাব নেই খুচরায়
রমজানের নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমে এসেছে পাইকারি বাজারে। গত দুই সপ্তাহে পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে সবচেয়ে বেশি কমেছে ডাল জাতীয় পণ্য ছোলা, খেসারি, মসুর, মুগডাল, চিড়া ও চিনির দাম। বাজার দর অনুযায়ী, এই সময়ে এসব পণ্যের দাম কমেছে ৫-১৫ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, পর্যাপ্ত আমদানি সত্ত্বেও বাড়তি চাহিদার সুযোগে রমজানের একমাস আগে থেকে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় আমদানিকারকরা। কিন্তু রমজান শুরুর পর আস্তে আস্তে এসব পণ্যের বিক্রি কমে যাওয়ায় দামও কমতে শুরু করেছে। তবে পাইকারিতে দাম কমার প্রভাব নেই খুচরা বাজারে।
ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের আড়ত ও দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বাজারে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি ছোলা (তানজানিয়া) বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭২ টাকায়। যা রমজানের শুরুর দিকে ৯৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রমজানের শুরুতে ৮০ টাকা দরে খেসারি ডাল বিক্রি হলেও ১৫ টাকা কমে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়।
পাইকারিতে বর্তমানে প্রতি কেজি মসুর ডাল (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকায়। যা রমজানের শুরুতে বিক্রি হয়েছে ১৩৬ টাকায়।
গত দুই সপ্তাহে মুগডালের দামও কেজিতে ৩০ টাকা পর্যন্ত কমে এসেছে। রমজানের আগে প্রতি কেজি মুগডাল ১১০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।
একইভাবে কেজিতে ৫ টাকা কমে প্রতি কেজি ভালোমানের চিড়া ৪৮ টাকা, ৩ টাকা কমে চিনি ১০৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রমজানের একমাস আগে থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ওই সময় আমদানিকারকদের কাছ থেকে চড়া দামে পণ্য কিনেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। রমজানের শুরুর দিকে পণ্যের দাম কিছুটা বাড়তি থাকলেও প্রথম সপ্তাহের পর থেকে পণ্যের দাম কমতে শুরু করে। এতে প্রথম দিকে কিছু লাভ হলেও এখন লোকসানে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)- এর সহ সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, বেশিরভাগ ভোক্তা রমজানের আগে কিংবা শুরুতে পুরো মাসের বাজার করে নেয়। এতে পাইকারি থেকে খুচরায় কয়েক ধাপে পণ্যের দাম বেড়ে অস্থির হয়ে যায়। রমজানের এক সপ্তাহ পর থেকে বিক্রি কমে যাওয়ায় পাইকারি পর্যায়ে পণ্যের দাম কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু খুচরায় এখনো পর্যন্ত কোনো পণ্যের দাম খুব বেশি কমে নি।
গত রোববার নগরীর খুচরা বাজারে দেখা যায়, প্রতি কেজি ছোলা ৯০-৯৫ টাকা, খেসারি ডাল ৮৫ টাকা, মসুর ডাল (দেশি) ১৪০-১৫০ টাকা, মুগডাল ১৩০-১৪০ টাকা, ভালোমানের চিড়া ৬৫ টাকা এবং চিনি ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের মেসার্স হক ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আজিজুল হক বলেন, রমজানের আগে আমদানিকারকদের কাছ থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) অস্ট্রেলিয়ার ছোলা কিনেছে ৩০০০-৩১০০ টাকা দামে। যা এখন বিক্রি হচ্ছে ২৩০০-২৪০০ টাকায়। আমদানি শেষে বাজারে পণ্য বিক্রি করে দিয়ে আমদানিকারকরা মুনাফা ঘরে তুললেও বিক্রি কমে যাওয়ায় এখন লোকসানের মুখে পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
ট্যারিফ কমিশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে ছোলার বার্ষিক চাহিদা ১ লাখ ৪৪ হাজার টন। এর অর্ধেক অর্থাৎ ৭০ হাজার টনের চাহিদা থাকে রোজাকে কেন্দ্র করে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের প্রথম আড়াই মাসেই চট্টগ্রাম বন্দর সহ দেশের বিভিন্ন স্থল বন্দর দিয়ে ছোলা আমাদনি হয়েছে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন। এর আগে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ২০ হাজার টন ছোলা আমদানি হয়। রমজানের শেষ পর্যন্ত এই পরিমাণ প্রায় ২ লাখ মেট্রিকটন পৌঁছাবে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, সাধারণত দেশের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ ছোলা আমদানি হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে। এছাড়া ভারত, মিয়ানমার, কানাডা, ইথিওপিয়া, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও কিছু ছোলা আমদানি হয়। তবে গত কয়েক মাস ধরে ডলার সংকটের কারণে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি ব্যাহত হওয়ায় এই সময়ে ভারত থেকে ছোলা আমদানি করছে ব্যবসায়ীরা। এমনকি গত তিন মাসেই দেশের বার্ষিক মোট চাহিদার চেয়েও বাড়তি ছোলা আমদানি হয়েছে। চাহিদার বাড়তি আমদানি হলেও সে পরিমাণে বিক্রি না হওয়ায় ছোলা নিয়ে বিপাকে রয়েছেন আমদানিকারকরা। এসব ছোলা দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ করলে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম টিবিএসকে বলেন, 'ভারত থেকে ব্যাপকহারে ছোলা আমদানির নজির গত ১৫ বছরেও দেখিনি। বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হওয়ায় আমদানি মূল্যের চেয়ে কেজি প্রতি ১০ টাকা লোকসানে ছোলা বিক্রি করতে হচ্ছে।'
চট্টগ্রাম ডাল মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এসএম মহিউদ্দিন বলেন, চলতি বছর আমদানিকৃত ছোলার প্রায় অর্ধেকই অবিক্রীত থেকে যাবে। এসব ছোলা দীর্ঘদিন গুদামে রেখে বিক্রি করতে হবে। এতে গুদাম ভাড়া ও ব্যাংকের সুদ গুনতে হবে। এছাড়া পণ্যটি পাঁচ-ছয় মাসের বেশি সংরক্ষণ করলে পোকার আক্রমণে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে প্রতি বস্তা ছোলায় কমপক্ষে ৫০০ টাকা লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে যাদের হাজার টনের বেশি ছোলা মজুদ রয়েছে, বড় ধরনের লোকসানের ঝুঁকিতে রয়েছেন তারা।