সেপ্টেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করা হবে
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশ মেনে সংস্থাটির দেওয়া ফর্মুলা অনুযায়ী আগামী সেপ্টেম্বর থেকে জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে একটি নতুন ফর্মুলাভিত্তিক মূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়া কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য আইএমএফের দেওয়া শর্ত পালনের জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। জ্বালানিতে ভর্তুকি কমাতে চায় আইএমএফ।
নতুন এই ফর্মুলা অনুযায়ী শুরুতে তিন মাস পর পর জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করবে সরকার। ভবিষ্যতে জ্বালানির মূল্য প্রতি মাসে সমন্বয় করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া আইএমএফের শর্তানুযায়ী সরকার আরও দুবার বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ করে বাড়াতে পারে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে আপাতত গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন তারা।
কর্মকর্তারা জানান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ফর্মুলাভিত্তিক মূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন শুরু করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার।
তবে ডিসেম্বরের আগেই সরকার এই মূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়া কার্যকর করতে আগ্রহী। ইতিমধ্যে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক দাম ওই ফর্মুলায় পরীক্ষামূলকভাবে পর্যালোচনা করা শুরু করেছে সরকার।
আগামী সেপ্টেম্বর থেকে চূড়ান্তভাবে এই ফর্মুলা পুরোদমে কার্যকর করা হবে।
ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার আগে আইএমএফের যেসব শর্ত বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে সরকার, সেগুলোর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে আগামী ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশ সফরে আসছে সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদল।
এ সময় সরকারের ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপসহ রাজস্ব খাত সংস্কার, আর্থিক খাত সংস্কারসহ সরকারের অঙ্গীকার পূরণের বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করবে তারা।
তাদের প্রতিবেদন সন্তোষজনক মনে হলে আগামী জুলাইয়ে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করবে সংস্থাটি।
আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাওয়া যাবে আগামী ডিসেম্বরে। ওই কিস্তি ছাড়ের আগে ফর্মুলাভিত্তিক মূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬.২ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে।
অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের যে দাম আছে, তাতে আইএমএফের ফর্মুলা মেনে দাম নির্ধারণ করা হলে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম সামান্য পরিমাণ কমতে পারে। তবে পেট্রোল ও অকটেনের দাম লিটারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমবে বলে জানান তিনি।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় ব্যবসায়ীরা এক মাস পর পর জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম সমন্বয়ের প্রস্তাব করেছেন।
আলোচনায় মেট্রোপলিটন চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, সরকার জ্বালানি তেল ও গ্যাসে ভর্তুকি না দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে ব্যবসায়ীদের আপত্তি নেই। তবে সরকার কোন পদ্ধতিতে দাম নির্ধারণ করবে, তা আগে থেকে ব্যবসায়ীদের জানানো হলে তাদের জন্য নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনা করা সহজ হবে।
তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, শুরুতে তিন মাস পর পর জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করার পর পর্যায়ক্রমে এই ব্যবধান কমিয়ে আনা হবে। তবে কোন সময় থেকে প্রতি মাস অন্তর দাম নির্ধারণ করা হবে, সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিপিসির একচেটিয়া ব্যবসা
প্রতিবেশী দেশ ভারত প্রতিদিন জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করে। এমনকি রাজ্যভেদে নির্ধারিত দরেও পরিবর্তন হয়।
আবার অনেক উন্নত দেশ আন্তর্জাতিক বাজারদর ওঠানামা করলে মুহূর্তের মধ্যেই দাম সমন্বয় করে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জাপানসহ বিভিন্ন দেশে দিনে কয়েকবার দাম নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে সরকার এককভাবে জ্বালানি তেল সরবরাহ করাসহ দামও নির্ধারণ করে থাকে। সরকার-নির্ধারিত দামেই বাংলাদেশে জ্বালানি তেল বিক্রি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারদরের তুলনায় দেশে জ্বালানি তেলের দাম কম হলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন লোকসান করে, যা সরকারকে ভর্তুকি হিসেবে মেটাতে হয়। আবার আন্তর্জাতিক দরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হলে বিপিসি মুনাফা করে। এতে ভোক্তাদের লোকসান হয়।
২০১৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমে গেলেও সরকার দেশে দাম কমায়নি। ফলে তখন থেকে সাত বছর সরকার জ্বালানি তেল বিক্রি করে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেড়ে গেলে গত আগস্টে পেট্রোল ও অকটেনে ৫০ শতাংশ এবং ডিজেল ও কেরোসিনে ৩৬ শতাংশ দাম বাড়ায় সরকার।
জ্বালানির দাম বাড়ানোর সময় বিপিসি বলেছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের প্রতি ব্যারেলের মূল্য ৮০ ডলার হলে সংস্থাটি ব্রেক ইভেনে থাকবে। এরপর ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় এখন এটি ৯৭ ডলারে পৌঁছেছে। প্ল্যাটস-এর তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ এপ্রিল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য ছিল ৯৮ ডলার।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি বাবদ কোনো বরাদ্দ রাখেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ভর্তুকির জন্য জ্বালানি বিভাগ ১৯ হাজার ৩৫৭ টাকা চাইলেও কোনো বরাদ্দ দেয়নি অর্থ বিভাগ।
সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরার সময় সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন দ্রুত জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করার সুপারিশ করে বলেন, 'আমাদের হিসাব অনুযায়ী জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসি এই মুহূর্তে মুনাফা করছে। আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে দাম সমন্বয় করা হলে ভোক্তারা লাভবান হবেন।'
আরও বাড়বে বিদ্যুতের দাম
কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানান, আইএমএফের শর্ত মেনে ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী মাসগুলোতে বিদ্যুতের দাম আরও দুবার বাড়তে পারে।
চলতি মাসে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্পদ কমিটির সভায় বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান জানান, 'প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ হারে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু গত দু-মাস আমরা দাম বাড়াইনি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, দাম বাড়াতে হবে।'
এর আগে, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৫ শতাংশ হারে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বরাদ্দের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। তবু বিদ্যুৎ বিভাগ অতিরিক্ত ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দাবি করে। শেষে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে অতিরিক্ত ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
আইএমএফ এর সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্বাক্ষর করা সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী, জ্বালানি তেলে জিরো ভর্তুকি নীতি বাস্তবায়ন করবে সরকার। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি দাম বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো যাবে না।
জ্বালানি তেলে শূন্য ভর্তুকির দিকে যাত্রা
আইএমএফের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী (এমওইউ), সরকার জ্বালানি তেলে শূন্য ভর্তুকি নীতি বাস্তবায়ন করবে।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ জিডিপির অনুপাতে বাড়ানো যাবে না।
আইএমএফ প্রকাশিত এমওইউ অনুসারে, তিনটি পেট্রোলিয়াম পণ্যের সমস্ত ভর্তুকি পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়া প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে ফর্মুলাভিত্তিক মূল্য সমন্বয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। একইভাবে ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দামও ধীরে ধীরে সমন্বয় করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছে।
চলতি বছরের ১২ জানুয়ারী, কর্তৃপক্ষ খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্য ৫ শতাংশ এবং প্রায় সব ধরনের গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুতের ডিমান্ড ফি ৪২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন, হোটেল ও রেস্তোরাঁর জন্য গ্যাসের দামও ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বাড়ানো হয়েছে।
সরকার প্রতি মাস শেষ হওয়ার পর ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রতি মাসে তিনটি বিতরণ কোম্পানি—মেঘনা পেট্রোলিয়াম, পদ্মা অয়েল কোম্পানি ও যমুনা অয়েল কোম্পানির সঙ্গে বিপিসির ব্যাংক ডিপোজিটের তথ্যও জানাবে।
সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে পেট্রোলিয়ামের দাম আন্তর্জাতিক মূল্যের কাছাকাছি এসেছে। তবু ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকি বেড়ে জিডিপির ১ শতাংশের কিছু কম হওয়ার কথা। ২০২৬ সাল পর্যন্ত তিন বছরমেয়াদি কর্মসূচির আওতায় পর্যায়ক্রমিক ফর্মুলাভিত্তিক জ্বালানি মূল্য সমন্বয় পদ্ধতি চালু হলে তা পেট্রোলিয়াম পণ্যের জন্য কোনো কাঠামোগত ভর্তুকি নিশ্চিত না করতে সহায়ক হবে।
আইএমএফ প্রকাশিত সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ জীবাশ্ম জ্বালানির স্বচ্ছ বাজারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণের সংস্কার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করেছে।
বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য বাড়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকি জিডিপির প্রায় ০.৯ শতাংশে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে ভর্তুকি জিডিপির ০.৪ শতাংশ ছিল।
বাজেট চাপ কমাতে সরকার ২০২২ সালের আগস্টে পেট্রোল ও অকটেনের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ এবং ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৩৬ শতাংশ বাড়ায়।
প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও ২০২২ সালের জুনে গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। আর ২০২২ সালের নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়।
এই পদক্ষেপগুলো জ্বালানি ভর্তুকির জন্য বাজেটের চাপ কমাতে সাহায্য করবে এবং সাশ্রয়ী জ্বালানি ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এছাড়া বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কাকে উপেক্ষা করে এই কর্মসূচি চলাকালে কর্তৃপক্ষ এই ভর্তুকি না বাড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ধীরে ধীরে ভর্তুকি আরও কমানোর উপায় খুঁজছে।