ভুয়া চাকরির প্রস্তাবে মালয়েশিয়ায় গিয়ে বিপাকে অনেক অভিবাসী কর্মী
ধরুন, প্রতিশ্রুতিশীল চাকরির প্রস্তাবে নতুন কোনো দেশে জীবন শুরু করতে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর পর জানতে পারলেন, যে কোম্পানিতে নিয়োগ পেয়েছেন সেটি আসলে ভুয়া।
এরকমই এক ঘটনা ঘটেছে মোঃ জাহিদুল হোসেন (ছদ্মনাম) এবং তারসঙ্গে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেওয়া ৪৭ জন অভিবাসী কর্মীর সঙ্গে। গেল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন তারা।
কমপক্ষে ১,৫০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বেতনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাহিদুল ও সঙ্গীদের মালয়েশিয়া নিয়ে যায় ইলুমিনাস ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি কোম্পানি। কিন্তু পৌঁছানোর পরে জানতে পারেন কোম্পানিটি আসলে ভুয়া; প্রতারণার শিকার হয়েছেন তারা সবাই।
জাহিদুল এবং তার সহকর্মীরা এখন অচেনা দেশে অনাহার ও শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। লড়াই করছেন বেঁচে থাকার।
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের তথ্যমতে, নেপাল এবং মিয়ানমারের মতো দেশগুলো থেকে আসা অনেক অভিবাসী কর্মী প্রায়ই এরকম পরিস্থিতির শিকার হন।
নিয়োগপত্রের সত্যতা যাচাইয়ে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশ হাইকমিশন আহ্বান জানালেও সমস্যার সমাধান হয়নি। প্রায় সাড়ে তিন বছর বিরতির পর গেল বছর বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য আবারও দরজা খুলেছে মালয়েশিয়া।
শনিবার (১৫ এপ্রিল) হাইকমিশনের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় আসার পর কাজ না পাওয়া কর্মীর সংখ্যা আগত মোট কর্মীর সংখ্যার তুলনায় অনেক কম এবং এখন পর্যন্ত এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য সীমার মধ্যেই রয়েছে।
দূতাবাস জোর দিয়ে বলছে, মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা হলে, সেদেশে কোনো বেকার অভিবাসী শ্রমিক থাকবে না। এরজন্য মালয়েশিয়াজুড়ে শ্রম বিভাগের শাখার উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, কোনো দূতাবাসই কোনো দেশে অভিবাসী কর্মীদের চাহিদা পুরোপুরিভাবে যাচাই করতে পারে না। তাই এরজন্য তারা মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের ওপরই নির্ভর করছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশটির শ্রম বিভাগ ৮,৭২৭ কর্মীর চাহিদার বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে ৩,৫৮,৮৯২ জন নতুন কর্মী নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। এরমধ্যে ১,৩৪,৫৯৫ জন কর্মী ইতোমধ্যেই মালয়েশিয়ায় পৌঁছেছেন। বাকি ২,২৫,০০০ কর্মীর যাওয়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রায় ৫ লাখ নতুন বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ পাবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ হাইকমিশন।
প্রতারণার শিকার জাহিদুল হোসেন জানান, তার এলাকায় আলী আকবর নামের এক দালালের মাধ্যমে তিনি গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজ নামক একটি রিক্রুটিং এজেন্সিকে প্রায় ৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তবে বাংলাদেশ ছাড়ার আগের দিন তিনি জানতে পারেন, শাহীন ট্রাভেলস নামে অন্য একটি এজেন্সির সঙ্গে তার চাকরির চুক্তি হয়েছে।
কুয়ালালামপুরে আসার পর জাহিদুল ও তার সঙ্গীদের বিভিন্ন জায়গায় কাজ খোঁজার জন্য পাঠানো হলেও তারা চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। এছাড়া, তিন মাসের অস্থায়ী পাসের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় পুলিশ তাদেরকে একবার আটকও করে।
জাহিদুল জানান, বাংলাদেশ দূতাবাসের হস্তক্ষেপে তিনি ছাড়া পান। কিন্তু তার গ্রুপের ৪৭ জনের মধ্যে ৯ জন এখনও আটক রয়েছেন।
মালয়েশিয়ায় যে এজেন্টের সঙ্গে তারা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন, সেখান থেকে এক মাসের বেতন পাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তাও পান তারা। তবে এরপরেও দূতাবাসের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৪৭ জনের কেউই এখনও নতুন চাকরি খুঁজে পাননি।
এমন ঘটনা এবারই প্রথম নয়, এর আগেও ৪৮ জন কর্মীর একটি দলের সঙ্গে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। পরে শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের সহায়তায় তারা চাকরি পান।
অভিযোগের বিষয়ে, রিক্রুটিং এজেন্সি শাহীন ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা অংশীদার এম শাহাদাত হোসেন তসলিম বলেন, ভুক্তভোগী শ্রমিকরা মূলত গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজের কর্মী। মালয়েশিয়ার সিস্টেমের কারণে অনেক সময় এক এজেন্সির কর্মী অন্য এজেন্সির সঙ্গে ট্যাগ (জড়িত) হয়ে যায়।
তবে যেহেতু গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজ কর্মীদের দায় নিচ্ছে, সেহেতু তাদের কর্মসংস্থানের চেষ্টাও অব্যাহত আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
রোববার (১৬ এপ্রিল) রাত ৮টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত, এ বিষয়ে গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজের স্বত্বাধিকারী রেহানা আরজুমান হাই-এর মন্তব্য পাওয়ার চেষ্টা করা হলেও তা সফল হয়নি।
কূটনৈতিক চিঠি
হাইকমিশন বলছে, বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি দ্বারা নিয়োগকর্তাদের সঠিকভাবে যাচাইয়ের মাধ্যমে অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্ভোগ কমানো যেতে পারে। কিন্তু মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে প্রকল্প সাইটগুলোর পরিদর্শনের ক্ষেত্রে হাইকমিশনকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
হাইকমিশনে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ার শ্রম বিভাগের স্থানীয় কোম্পানিগুলোরই শুধু এই পরিদর্শনের এখতিয়ার রয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, "নিয়োগ চাহিদার যথার্থতা নিশ্চিত করা মালয়েশিয়া সরকারের দায়িত্ব, এটি মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির মাধ্যমে আশ্বস্ত করা হয়েছে।"
তবে কমিশন জানিয়েছে, মালয়েশিয়া সরকারের সতর্কবার্তা সত্ত্বেও বাংলাদেশি শ্রমিকদের সুরক্ষায় তারা সাইট তদন্ত বন্ধ করেনি।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় পৌঁছে বেশকিছু অভিবাসী কর্মী কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে আটকা পড়ার পর এবং একই ধরনের কিছু ঘটনায় বিষয়টি সামনে আসে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি এবং নেপালি অভিবাসী কর্মী নেগেরি সেম্বিলানের নিলাইতে ৪০ দিনের ট্রানজিট হোমে আটকা রয়েছেন এবং এখনও কোনো কাজের সন্ধান পাননি তারা।