ইমা কিথেল: ৫০০ বছরের পুরনো যে বাজারের ব্যবসায়ী শুধুই নারীরা
প্রথম দেখায় ইমা কিথেল বাজারকে আর দশটা সাধারণ বাজারের মতোই মনে হবে। সারি সারি বসা বিক্রেতারা এখানে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পণ্য কেনাবেচা করেন। টাটকা ফলমূল-সবজি থেকে শুরু করে মাছ-কাপড় সবকিছুই বিক্রি করেন তারা।
কিন্তু তিনটি বহুতল ভবন এবং তার আশেপাশে অসংখ্য টিনের খুপরি ঘর নিয়ে গড়ে ওঠা এই বাজারের পাঁচ হাজারেরও বেশি স্টলের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আপনি বুঝতে পারবেন অন্যান্য বাজারের সঙ্গে ইমা কিথেল এর পার্থক্য কী: বিশাল বড় এই বাজারের প্রতিটি ব্যবসায়ীই নারী।
"আমরা এখানে পরিবারের মতো, একজন আরেকজনের বোনের মতো", বলেন বাজারের ৬৫ বছর বয়সী বিক্রেতা মেইলানি চিনগংবাম। ২০০২ সাল থেকে এই বাজারে মন্দিরের সাজসজ্জার জিনিস, আগরবাতি, ধূপ ইত্যাদিসহ ধর্মীয় নানা আনুষঙ্গিক পণ্য বিক্রি করছেন তিনি। তার ভাষ্যে, "কাজ করার জন্য এই জায়গাটা খুবই ভালো। প্রত্যেকেই বিশ্বস্ত এবং দয়ালু।"
স্থানীয় মিতেই ভাষায় 'ইমা কিথেল' শব্দের অর্থ 'মায়েদের বাজার'। ভারতের উত্তরপূর্বের মণিপুর রাজ্যের রাজধানী ইমফালে অবস্থিত এই বাজারটিকে বলা হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ নারীদের পরিচালিত বাজার। পুরুষেরা এই বাজারে এসে পণ্য কিনতে পারবেন, মালামাল বহনকারী বা প্রহরী হিসেবে কাজ পারবেন; আবার নারীদের চা-পানি এনে দেওয়ার কাজও করতে পারবেন। কিন্তু বাজারে বিক্রেতা হিসেবে থাকবেন শুধুমাত্র নারীরা।
সকালবেলা এই বাজারে কেনাবেচার ধুম পড়ে যায়- এরোম্বা(আলু ভর্তা করে বানানো এক ধরনের স্থানীয় খাবার), ব্যাম্বু শুট, শুটকির চাটনির গন্ধে ভরে ওঠে এখানকার বাতাস। বাজারের এক কোণায় দেখা যায় একদল নারী পণ্যের ডেলিভারিতে দেরি হওয়া এবং মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য কী করা হবে তা নিয়ে আলোচনা করছেন।
কাজকর্মের মধ্যেই খানিক বিরতি নিয়ে নারীরা ধনসম্পদ ও ব্যবসায়ের দেবী 'ইমা ইমোইনু'র মন্দিরে প্রার্থনা করতে যান। তাদের বিশ্বাস, এই দেবীই তাদের এই বাজারের প্রধান রক্ষাকর্তা।
বাজারের বড় বড় স্তম্ভের পাশে বোঝাই করে রাখা হয়েছে নানাবিধ পণ্য: সুগন্ধি চন্দন কাঠ, সাজানো আছে সবুজরঙা পান-পাতা, হাতে তৈরি মাটির ও বাশের ঝুঁড়ি, চমৎকার সিল্কের কম্বল এবং বাহারি রঙের শতরঞ্জি।
দুই পাশে পণ্যের মাঝখানে নিজেদের দোকান সাজিয়ে বসেছেন বর্ণিল পোশাকে সজ্জিত নারীরা। তাদের পরনে লাল, হলুদ, সবুজ রঙ এর শাল, কারো কারো কপালে মণিপুরি চন্দন আঁকা, আবার কেউ কেউ মুসলিমদের মতো মাথায় স্কার্ফ পরা।
"এই বাজারে আপনি যা চাইবেন সবই পাবেন। এখানে সস্তায় জিনিসপত্র পাওয়া যায় এবং এটা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। পুরো রাজ্যের অর্থনীতিকে সচল রাখতে এখানের নারীদের উল্লেখযোগ্য অবদান আছে", বলেন স্থানীয় মিতেই ট্যুর গাইড লিনা মৈরাংথেম।
প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, শুধুমাত্র বিবাহিত নারীরাই ইমা কিথেল বাজারে ব্যবসা করতে পারবেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে এখানে দোকান নিয়ে বসার অনুমতি পাবেন। সেই নারীকে অবশ্যই একজন অবসরপ্রাপ্ত বিক্রেতার কাছ থেকে মনোনয়ন পেতে হবে, যিনি সাধারণত তার বোন, কন্যা বা কাজিনকেই মনোনীত করে থাকেন।
উদাহরণস্বরূপ, ইমা কিথেল বাজারের ব্যবসায়ী প্রিয়া খারাইবামের কথা বলা যায়। তিনি তার পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম যারা এই বাজারে ব্যবসা করছে। তার দাদির পরে তিনিই উত্তরসূরি হিসেবে পরিবারের মৃৎশিল্পের ব্যবসা ধরে রেখেছেন। ৩৪ বছর বয়সী প্রিয়া বলেন, "আমি আমার পারিবারিক ব্যবসা চালিয়ে নিতে পেরে খুবই গর্বিত।"
১৬ শতকে কাংলেইপাক রাজ্য থেকে ইমা কিথেল বাজারের উৎপত্তি। শুরুতে এটি ছিল খোলা আকাশের নিচে একটি অস্থায়ী বাজার, যেখানে ফসল বিনিময় করা হতো। প্রতিবেশী বার্মিজ এবং চীনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করার জন্য ১৫৩৩ সালে মণিপুরে পুরুষদের সৈন্যদলে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। মিয়ানমারের সীমান্ত বরাবর রাজ্যের পরিধি রক্ষার জন্য এ অঞ্চলের সব পুরুষকে অল্প বয়স থেকেই যোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
ফলে নগর পরিচালনার জন্য থেকে যান শুধু নারীরা।
"খোলা জায়গায় রাজ্যের নারীরা এই বাজারটি পরিচালনা করতো। মাছ, সবজি এবং অন্যান্য পণ্য বিক্রির মাধ্যমে বাজারের কার্যক্রম শুরু হয়", বলেন মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন স্কলার লোকেন্দ্র আরামবাম।
এছাড়াও, মণিপুর রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ইমফাল নগরীর অবস্থানকেও ধন্যবাদ দিতেই হয়। এই শহরটিতে যাতায়াতের ব্যবস্থা ভালো এবং ধীরে ধীরে শহরটি এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। ফলে ইমা কিথেল বাজারের নারীরা দিন দিন আরও প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।
কিন্তু রোজকার ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি গত ৫০০ বছর ধরে ইমা কিথেল বাজারের নারীরা মণিপুরের সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, ১৮৯১ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা মণিপুরে এমন কিছু নিয়মনীতি আরোপ করতে চেয়েছিল যার ফলে এখানকার বাণিজ্যের ওপর বহিরাগতরা প্রভাব বিস্তার করতে পারতো। কিন্তু ইমা কিথেল বাজারের নারীদের প্রতিবাদের মুখে ব্রিটিশরা তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। ১৯৩৯ সালে এ অঞ্চলের চাল ভারতের অন্যান্য রাজ্যে রপ্তানির প্রসঙ্গে ব্রিটিশদের নীতিতে ক্ষুদ্ধ হয়ে 'আনিশুবা নুপিলান' (সেকেন্ড উইমেন'স ওয়ার) আন্দোলন পরিচালনা করে এবং জয়লাভ করে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্য সরকার যখন ২০০৩ সালে বাজারের স্থলে একটি শপিং মল নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করে, তখন এই বাজারের নারী ব্যবসায়ীরা সপ্তাহব্যাপী গণ-ধর্মঘট পালন করে, অর্থনীতিকে স্থবির করে তোলে এবং সেই সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করে। এমনকি বর্তমান সময়েও নারীরা তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবাদ করেন; তাদের কর্মকাণ্ড স্থানীয় নির্বাচনের ওপরেও বড় প্রভাব ফেলে।
"এখানে নারীদের একটা বিশাল শক্তি কাজ করছে। কিন্তু আমরা কোনো অসাধারণ মানুষ নই, আমরা শুধু নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে ব্যবসা করে থাকি। আমরা দায়িত্বশীল মা হতে চাই", বলেন ইমা কিথেল বাজারের একটি বিক্রেতা সমিতির সভাপতি তুদাম অংবি শান্তি।
বর্তমানে ইমা কিথেল মণিপুরের সমতাবাদী সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ।ভারতের নারী শিক্ষার হার সবচেয়ে বেশি যে রাজ্যগুলোতে, তার মধ্যে মণিপুর অন্যতম। সমগ্র ভারতেই তাদেরকে লিঙ্গ সমতার পথিকৃৎ হিসেবে দেখা হয়। মণিপুরের জনসংখ্যার অধিকাংশ স্থানীয় মিতেই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর হলেও, প্রগতিশীল মূল্যবোধ বজায় রেখে হিন্দিভাষী এবং ভারতের আরও ৩৩টি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদেরও বাজারে জায়গা দেওয়া হয়েছে।
মারিং নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য, ৫০ বছর বয়সী নারী তুংদার মাকুংগা তাদেরই একজন। বাজারের একটু বাইরের দিকে টিনের চালার নিচে তার ছোট্ট দোকান। তিনি বলেন, "আমি কিছুদিন হলো এখানে কাজ করা শুরু করেছি, এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে রেজিস্টার হইনি। কিন্তু এখানকার নারীরা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে এবং তারা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। আমার কিছুর প্রয়োজন হলে তারা আমাকে সাহায্য করে।"
এদিকে অনেক নারী প্রথাগত সামাজিক রীতিনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে এই বাজারের স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়েছেন।
৮০ বছর বয়সী কাপড় বিক্রেতা নংমাই থেম খুমসনবি বলেন, তার বিয়ে হয়েছিল খুবই সামান্য বেতনের সরকারি কেরানির সঙ্গে। তার স্বামী তাকে বাজারে ব্যবসা করার অনুমতি দিতে চাননি, কারণ তার স্বামী মনে করতেন নারীদের বাইরে কাজ করা উচিত নয়।
"সে চাইতো না আমি বাইরে গিয়ে কাজ করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তর্কে আমিই জিতি এবং এখানে ব্যবসা করে তার চেয়ে বেশি উপার্জন করতে শুরু করি", বলেন নংমাই।
তবে ইমা কিথেল বাজারের নারীদের জন্য সবকিছু এতটা সহজ নয়। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে একটি ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে এই বাজারের ভবনটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং এটি পুনঃনির্মাণ করতে দুই বছরেরও বেশি সময় লেগে গিয়েছিল। এছাড়াও, মহামারিকালে এক বছরেরও বেশি সময় বাজার বন্ধ থাকায় বহু ব্যবসায়ীর জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু মহামারির ভয়াবহতা কেটে যাওয়ার পর আবারও ৫০০ বছরের পুরনো এই বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এখানে পুরোদমে চলছে বেচাকেনা। প্রতিদিন এ বাজারে পা রাখলেই দেখা যায় বহু রঙ-গন্ধ-শব্দের খেলা ও হইচই। আর নারীদের জীবনে এই বাজারের ইতিবাচক প্রভাবকে কোনোকিছুর সঙ্গেই তুলনা করা যায় না।
"আমি মন থেকে আগ্রহ নিয়ে এখানে কাজ করি, ভালোবাসা নিয়ে কাজ করি। কিন্তু বিষয়টা শুধুমাত্র কাজের নয়। আমি এখানে প্রশান্তি অনুভব করি। এই নারীদের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমার ভালো লাগে। এখানে থাকলে আমার মনে হয়, আমি যেন আরও অনেক বছর বাঁচবো", বলেন ৬৪ বছর বয়সী বিধবা দর্জি অংবি জায়েলা।