দীর্ঘ লকডাউন: মানসিক সমস্যায় ভুগছেন ঘরবন্দি মানুষ
টিভি দেখতে দেখতে আর ভালো লাগে না। স্কুলটাও খোলে না, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতেও পারিনা। ময়মনসিংহ শহরের বদরের মোড় এলাকায় বাসার বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিল ছয় বছরের শিশু স্নিগ্ধ।
চলমান পরিস্থিতিতে শিশু স্নিগ্ধর মতোই অবস্থা শহরের ইট, কাঠ, পাথরের খাচায় বন্দি থাকা বাকী শিশুদের। স্নিগ্ধর মা নুসরাত জাহান একজন স্কুল শিক্ষিকা।
তিনি বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক জীবন কাটাতে না পারায় চরম মানসিক সমস্যায় ভুগছেন তিনি। ঠিকমতো ঘুমও হচ্ছে না। আর তাতে বাড়ছে নানা শারীরিক সমস্যা।
ময়মনসিংহ নগরের বিভিন্ন পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লম্বা সময় ঘরে আটকা থাকায় পরিবারের সব বয়সের মানুষের মধ্যে দেখা দিচ্ছে এমন নানা মানসিক সমস্যা।
এক রকম বন্দি দশায় থাকতে থাকতে মানসিক সমস্যা তৈরি হওয়া ভুক্তভোগীরা বলছেন, দিন দিন চেপে বসছে বিষন্নতা, হতাশা ও আতঙ্ক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লকডাউন দির্ঘায়িত হলে বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে বাড়বে নানা মানসিক সমস্যা। অসুস্থ হয়ে পড়বেন অনেকেই। দেখা দেবে নতুন সঙ্কট। তাই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে এখনই সতর্ক হতে হবে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের সবাই একে অপরকে সাহায্য করার কোনো বিকল্প নেই।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেশি সমস্যায় ভুগছেন বয়স্ক ব্যক্তিরা। তাদের মধ্যে মৃত্যুভয় যেন চেপে বসেছে। নগরীর বাউন্ডারি রোডের বাসিন্দা সাইদুর রহমান স্বপন। বয়স ৭০ ছুই ছুই।
জানালেন, কোনও অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনলেই বুকের ভেতরে কেমন যেন করে ওঠে, অস্থীর লাগে। মনে হয় এই বুঝি মহল্লার কেউ আক্রান্ত হলো। এমন চাপা ভয় থকে অসুস্থ বোধ করেন তিনি। এ সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।
সাইদুর রহমানের স্ত্রী জেসমিন চৌধুরী বলেন, সারাক্ষণ বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর দেখি। সবখানে নেগেটিভ সংবাদ। আশার কোনো খবর পাইনা।
''শুনেছি বয়ষ্কদের করোনা হলে রক্ষা নেই। মনে হচ্ছে ঘর থেকে আর বের হতে পারবনা। কারো বাসায় গিয়ে কথা বলবো তারও উপায় নেই।''
সাবাহা মুগ্ধ এবার ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। দীর্ঘদিন বাসায় থেকে তার কী ধরণের মানসিক সমস্যা হচ্ছে জানতে চাইলে জানায়, ভেবেছিলাম পরীক্ষা শেষ হলে একটু ঘুরে বেড়াব। এখন ঘরে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাবা-মার কথাও ভালো লাগেনা। সোশ্যাল মিডিয়াও বিরক্তিকর এখন। মেজাজ সব সময় খিট খিটে থাকে।
বিষয়টি অনুধাবন করে মানসিক সমস্যা থেকে দূরে থাকতে অনেকে সতর্কও রয়েছেন। ময়মনসিংহের চড়পাড়া এলাকার বাসিন্দা আতাউল করিম খোকন জানালেন, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনি আলাপ-আলোচনা করছেন। নাতির সঙ্গে খেলছেন, নামাজ পড়ছেন। যতটা সম্ভব করোনা নিয়ে চিন্তা কম করার চেষ্টা করছেন।
শহরের সানকিপাড়া এলাকার গৃহিনি সিদ্দিকা জামান বলেন, বাচ্চাকাচ্চা সারাদিন ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে একরোখা আর বদমেজাজী টাইপের হয়ে গেছে। সারাক্ষণ এটা সেটা নিয়ে অযথা কান্নাকাটি করে। পরিবারের সবাই ঘরে থাকায় ঘরের কাজের চাপও বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, রুটিন এলোমেলো হওয়ায় ঘুমেরও ব্যাঘাত হচ্ছে। সে সঙ্গে করোনা আতঙ্ক তো আছেই। সব মিলিয়ে মেজাজ প্রচন্ড খিটখিটে হয়ে গেছে। যার প্রভাব পড়ছে পরিবারের অন্যদের উপর।
এই বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তির পথ, ঘরেই বন্দি থাকা। আর তাই এমন পরিস্থিতি মানসিক স্বাস্থ্যে বড় ধরণের সমস্যা তৈরি করছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল মনসুর বলেন, মানুষ আবদ্ধ থাকায় অভ্যস্ত না। তাই বিষন্নতা দেখা দিচ্ছে। আমার সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখছি তারা হেলুসিনেশনে ভুগছেন। উল্টা পাল্টা চিন্তা আসছে তাদের মাথায়। বয়স্করা ভয় পাচ্ছেন বেশি।
তিনি পরামর্শ দেন, মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পরিবারের সদস্যদের একে অন্যকে সাহায্য করতে হবে। একে অপরকে সময় দিতে হবে। সময় মতো ঘুমের ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। আশপাশের পরিবেশকে সুন্দর করে রাখতে হবে। বিশেষ করে বয়ষ্কদের সময় দিতে হবে বেশি। সমস্যা বেশি মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ময়মনসিংহ কমিউনিটিভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম এ এস পাঠান বলেন, কর্মময় জীবন থেকে হঠাৎ করে কর্মহীন থাকা মানসিক সমস্যার অন্যতম কারণ। স্বাভাবিক ভাবেই মন বিদ্রোহী আচরণ করবে। এর মধ্যে অনেকেই তার চাকরি নিয়ে চিন্তিত। ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাড়ানোর চিন্তা করছেন। কিন্তু তাদের মাথায় রয়েছে লোকসানের চিন্তা। ব্যাংক ঋণের ঝামেলা তো আছেই।
তিনি বলেন, এমন সময় মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে রুটিন করে দিনযাপন করার কোনো বিকল্প নেই। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলা বই পড়া বাড়াতে হবে। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, তিনি করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। চলমান পরিস্থিতিতে তার মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আক্রান্ত হওয়ার ভয় থেকে নানান দুচিন্তা তার মধ্যে বাসা বেধেছে। নিজে চিকিৎসক হয়েও মানসিকভাবে শক্ত থাকতে পারছেন না। মাঝেমধ্যে ঘুমের ওষুধও খাচ্ছেন তিনি।
এ দিকে সাধারণ মানুষ ও চিকিৎসকদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। সম্প্রতি অনলাইনে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা চালু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে দেওয়া হয়ছে দুইটি টেলিফোন নম্বর। সকাল আটটা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা যাবে। নম্বর দুটি হচ্ছে ০১৪০৪০০০০৮০, ০১৪০৪০০০০৮১। ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে চালু করা হয়েছে হোয়াটস অ্যাপ সার্ভিস। যার নম্বর ০১৪০৪০০০০৮২, ০১৪০৪০০০০৮৩।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার জানিয়েছেন, স্থানীয় স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে রোগী গিয়ে টেলিমেডিসিন কেন্দ্রের মাধ্যমে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছ থেকে সেবা নিতে পারবেন।
তিনি বলেন, যেসব করোনা আক্রান্ত রোগীকে টেলিফোন বা হোয়াটস অ্যাপ এর মাধ্যমে সেবা দেওয়া সম্ভব হবেনা তাদের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি টিম সবসময় প্রস্তুত থাকবে। জরুরী প্রয়োজনে তারা সরাসরি মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেবেন। এ ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা চালু রয়েছে। যে কেউ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসে সেবা নিতে পারবেন।