ঘূর্ণিঝড় মোখা: সমুদ্রবন্দরে চার নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত
মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় 'মোখা'র প্রভাবে দেশের চারটি সমুদ্র বন্দরের জন্য চার নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। শুক্রবার বিকেলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১১ নম্বর বিজ্ঞপ্তিতে এই কথা জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি বর্তমানে মোংলা বন্দর থেকে ৯৬৫ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম থেকে ১,০০৫, কক্সবাজার থেকে ৯৩৫ ও পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছে। এটি আরো উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আরও ঘনীভূত হতে পারে।
এছাড়া অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই বিক্ষুদ্ধ রয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বঙ্গোপসাগরে যেসব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার রয়েছে, সেগুলোকে নিরাপদে তীরে আসার জন্য বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় 'মোখা' মোকাবেলায় চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় ১ হাজার ১২০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক। চাল-বিস্কুটসহ শুকনো খাবার মজুদ রেখেছে জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন।
১ হাজার ১২০টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে নগরী ও জেলায় মোট ৫ লাখ এক হাজার ১১০ জনের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ১০৩০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করেছে জেলা প্রশাসন। সিটি করপোরেশন ৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছে, যাতে প্রায় এক লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে বলে দাবি সংস্থাটির।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) মো. তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৫ উপজেলা ছাড়াও নগরীতে ৭৫ হাজার ২০০ জনের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ৯৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এদিকে মোখার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁদের নিজস্ব 'অ্যালার্ট-২' জারি করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ৪ নম্বর সংকেতের জন্য বন্দর এই অ্যালার্ট-২ জারি করে। এ্যলার্ট ২ জারির পর চট্টগ্রাম বন্দর কন্ট্রোল রুম চালু করেছে। একই সাথে সাইক্লোন স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা আহ্বান করে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। আবহাওয়া অধিদফতর ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেয়ার পরই ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় মূল কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
মোখায় ১০-২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা, সরানো হচ্ছে কয়েক লাখ মানুষ
ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে বাংলাদেশের সব উপকূলীয় এলাকা ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের হুমকির সম্মুখীন হতে পারে বলে জানিয়েছেন কানাডার সাসকাচোয়ান ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কামাল পলাশ।
এছাড়াও তিনি বলছেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষদের জীবন হুমকির সম্মুখীন এবং তিনতলার নিচে কোনো ভবনে আশ্রয় নেওয়া নিরাপদ নয়।
মোস্তফা কামাল পলাশ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মোখা আজ দুপুর তিনটার সময় ১৪.৩ উত্তর অক্ষাংশ, ৮৮ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থান করছে।
তিনি বলেন, "এটি উত্তর-পূর্ব দিকে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। এটি বাংলাদেশের দিকে আসা শুরু করে দিয়েছে। আজকে সন্ধ্যার পরে এর প্রভাবে চট্টগ্রাম বিভাগ ও কক্সবাজারে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আজকে রাত থেকে জোয়ার এবং ভাটায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব বুঝতে পারবো। সমুদ্র প্রচণ্ড উত্তপ্ত।"
তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ পাওয়া তথ্যচিত্র মতে এ ঘূর্ণিঝড়টি সম্পূর্ণ বাংলাদশের উপর ও মায়ানমারের উপর দিয়ে অতিক্রম করবে।
এদিকে মোখার কবল থেকে বাঁচাতে শুক্রবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ উপকূলীয় এলাকা থেকে কয়েক লাখ মানুষকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা ইউএনবি।
বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান ইউএনবিকে বলেছেন, উপকূলীয় এলাকার মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ৫৭৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তূত রয়েছে। শনিবার থেকে প্রায় ৫ লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রপরিচালিত গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার সংবাদপত্র জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যের পশ্চিম উপকূলে বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, যেখানে দিয়ে ঝড়টি বয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এর আগে জানা গিয়েছিল, আজ (১২ মে) সমুদ্রে ২৮ ফুট উচ্চতার ঢেউ সৃষ্টি করেছে ঘূর্ণিঝড় 'মোখা'।
আমেরিকার নৌবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত জায়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের সূত্র থেকে এ তথ্য জানা যায়।
এ সেন্টার ঘূর্ণিঝড় মোখার সুপার-সাইক্লোনে পরিণত হওয়ার পূর্বাভাস দেয়। যেখানে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ২২১ কিলোমিটারের বেশি থাকবে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, "ঘূর্ণিঝড়টি সেন্টমার্টিনে পুরোপুরি আঘাত হানবে তাই এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আমরা আশঙ্কা করছি সেন্টমার্টিনে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ দ্বীপটি প্রচণ্ড হুমকির সম্মুখীন। এ দ্বীপের মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানাবো।"
তিনি বলেন, কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১০ থেকে ১২ ফুট, বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে ৮ থেকে ১২ ফুট ও খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে ৭ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হওয়ার হুমকির সম্মুখীন।
তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখা যখন সেন্টমার্টিন দ্বীপ অতিক্রম করবে সেই সময় কোনো ভবনের ৩ তলার নিচে আশ্রয় নেওয়া মানুষের জীবন নিরাপদ নয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপটি সম্পূর্ণ সমুদ্রের পানির নিচে থাকার সম্ভাবনা ৯০% এর বেশি।
বঙ্গোপসাগরে জন্ম নেওয়া মোখা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে বলে জানায় আবহাওয়া অধিদপ্তর।