ঘূর্ণিঝড় মোখা: সেন্টমার্টিনে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কায় সাড়ে ৮ হাজার বাসিন্দা
'নামাজের পর ইমাম সাহেব যখন মোনাজাত ধরলেন। সবাই জোরে জোরে কান্না শুরু করে দিল। বয়োবৃদ্ধরাও বাচ্চার মতো কাঁদছিলেন। স্বাভাবিকভাবে আমার সহজে কান্না আসে না। কিন্তু, জুমার নামাজে এতগুলো মানুষের আর্তচিৎকারে চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন ছিল' - কথাগুলো বলছিলেন সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা তায়েব উল্লাহ।
অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়া 'মোখা' সর্বোচ্চ গতি নিয়ে কক্সবাজার উপকূলের দিকে এগুচ্ছে। যে কারণে কক্সবাজার বন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, অতিপ্রবল এই ঘূর্ণিঝড় প্রথম ও শক্তিশালী আঘাতটি হানবে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। মাত্র ৩.৬ মিটার দ্বীপটির গড় উচ্চতার এই দ্বীপে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসেরও শঙ্কা করা হচ্ছে। যেখানে এই মুহুর্তে জীবনশঙ্কা নিয়ে অবস্থান করছেন নারী-শিশুসহ প্রায় সাড়ে ৮ হাজার মানুষ।
যদিও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে ইতোমধ্যে আড়াই হাজার মানুষকে টেকনাফে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন প্রশাসন নয়, স্থানীয়দের মধ্যে যারা বিত্তশালী রয়েছেন তারাই গতকাল পর্যন্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে ট্রলার বা স্পিডবোট যোগে দ্বীপ ছেড়েছেন। এ সংখ্যাও দেড় হাজার জনের বেশি নয়।
এদিকে সমুদ্র গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টির পর থেকে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে সকল নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা রয়েছে। ফলে দ্বীপে আটকে পরা প্রায় সাড়ে ৮ হাজার মানুয়ের মূল ভূখণ্ডে ফেরার আর কোনো উপায় নেই।
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ জানিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মডেল ও মার্কিন নেভির জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের পূর্বাভাস মডেল অনুসারে, ঘুর্নিঝড় মোখা স্থলভাগের যে অংশটিতে প্রথম আঘাত করবে, সেটি সেন্টমার্টিন। ঘূর্ণিঝড়টি যখন দ্বীপ অতিক্রম করবে তখন বাতাসের গড় গতিবেগ থাকবে ১৮০ থেকে ২০০ কিলোমিটার। এ সময় ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের কারণে সেন্টমার্টিন তলিয়ে যাবে।
সেন্টমার্টিনের ব্যবসায়ী ও পরিবেশ গবেষক মোহাম্মদ আরিফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় পুরো সেন্টমার্টিন এক কোমর পানিতে তলিয়ে গিয়েছিলো। আমি গতকালই দ্বীপ থেকে চলে এসেছি। কিন্তু, সেখানে রয়েছে আমার প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্পদ। পূর্বাভাস যা পাচ্ছি, বুঝতে পারছি না ফিরে গিয়ে দ্বীপে আর কিছু দেখতো পাবো কিনা। আমার কেয়ারটেকারসহ দ্বীপের অনেক গরীব মানুষ আছে, যারা দ্বীপ ছেড়ে আসতে চাইলেও এখন আর আসতে পারছে না'।
তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপের ছোট ব্যবসায়ীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। জলোচ্ছাসে দোকানগুলো ভেসে যেতে পারে।
সেন্টমার্টিনের ৬ ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইয়ামিন টিবিএসকে বলেন, 'দ্বীপে দুইতলা সাইক্লোন সেন্টারটির অবস্থা খুব নাজুক। সেখানে মানুষ যেতে চাইছে না। এছাড়া তিনতলা হাসপাতালেও বেশি মানুষ আশ্রয় নিতে পারেনি। আবহাওয়া ভবনে বিজিবি ও পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করছে। দ্বীপের সব হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টকে জেলা প্রশাসন আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করলেও, এর অধিকাংশই একতলা। ফলে দ্বীপে আটকে যাওয়া বিপুল মানুষকে আশ্রয় দেওয়া কঠিন হবে'।
প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে ২২০টি। স্থানীয় বহিরাগত মিলে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার লোকের বসবাস।
দ্বীপে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'সেন্টমার্টিনে আমাদের একটি ফাঁড়ি রয়েছে। যেখানে ১৫ পুলিশ সদস্য কর্মরত আছেন। তারা স্থানীয়দের সাইক্লোন সেন্টারসহ নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠাতে কাজ করছেন। আমাদের ভবনটি একটি দুইতলা পাকা স্থাপনা। ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলে ভবনটি কোমর-সমান পানিতে তলিয়ে যাবে। এ কারণে আমরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।'
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, 'দ্বীপে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নেই। নেই টেকসই বেড়িবাঁধ। প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ বালিয়াড়ি, কেঁয়াবন ও পাথরের বাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। আবহাওয়ার পূর্ভাবাসে ২০০ কি.মি বেগে ঝড়ের সঙ্গে যে উচ্চতার জলোচ্ছাসের কথা বলা হচ্ছে, এমনটা হলে দ্বীপের ৮০ শতাংশ বাড়িঘর ও স্থাপনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবমিলিয়ে সেন্টমার্টিন এখন 'অরক্ষিত জনপদ!'
সাবেক এই জনপ্রতিনিধি বলেন, 'দ্বীপের মানুষের মনে ভয় ঢুকেছে 'সিত্রাং' এর সময় থেকে। সামান্য ঘূর্ণিঝড়ের সময় যেভাবে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। এক্সট্রিমলি সিভিয়ার সাইক্লোন মোখা যে আরো ভয়াবহ ক্ষতি করবে তা সাধারণভাবেই অনুমেয়। আমরা স্থানীয়দের বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্ট ও স্কুলে আশ্রয় নিতে বলছি। কিন্তু অনেকে এখনই ঘর ছাড়াতে চাইছেন না। প্রশাসনের আরও আগে থেকে উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল'।
সেন্টমার্টিনের ৪ ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নাজির হোছেন বলেন, 'সকাল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, সাগর উত্তাল আছে। গত তিনদিন ধরে ট্রলার, স্পিডবোট করে হাজারের উপর মানুষ জন্মভূমি সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফ চলে গেছে। যারা যেতে পারে নাই, তারা যথেষ্ট আতঙ্কে আছে। অনেকের মতো আমিও পরিবার নিয়ে সেন্টমার্টিন রয়ে গেছি। এখান থেকে ফেরার আর কোনো পথ নেই'।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় মোখা যেহেতু কক্সবাজারমুখী, সেহেতু কক্সবাজারসহ সেন্টমার্টিন দ্বীপ ঝুঁকিতে রয়েছে। এ জন্যই সেন্টমার্টিনের সব হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। তবে দ্বীপ থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা আমরা নেইনি'।