হাঁটা ভালো বটে, তবে জীবনের আনন্দবিনাশী
কত মানুষ হাঁটে, আমিও হাঁটি। সেটা অবশ্য প্রেসক্রিপশনের পাল্লায় পড়েই করতে হয়। বাতের ব্যারাম আছে, তাই ডাক্তার অনেক বলেকয়ে হাঁটতে রাজি করিয়েছেন। তার ভাষ্যে, একটু হালকা ব্যায়াম করলে নাকি শরীরটা নিয়ে কষ্ট অনেক কমে যাবে, আরেকটু ভালো থাকা যাবে। পিঠে যে ব্যথাটা ধীরে ধীরে জেঁকে বসেছে, সেটাও নাকি কম সইতে হবে — এমনকি একেবারে সেরেও যেতে পারে।
বসে কাটানো অভ্যাসের জীবন হঠাৎ করে হাঁটা শুরুর পর খাপ খাইয়ে নিতে প্রথম প্রথম একটু প্রতিবাদ করেছিল। প্রথম দিন হাঁটার পর সারা শরীর ব্যথায় কাতর। কিন্তু ডাক্তারের বাণী আর হাঁটা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি পড়া আমার মন তখন আর হাল ছেড়ে দিতে রাজি নয়। নিজেকে বোঝালাম, একটু ধৈর্য ধরে চালিয়ে গেলে কয়দিন পর শরীরে দারুণ সব উন্নতি দেখতে পাব।
সত্যি বলতে কী, ডাক্তারের কথা শুনে ভালোই হয়েছে। এখন হাঁটা আমার জন্য একটা আনন্দের কাজে পরিণত হয়েছে। একদিন না হাঁটলে মনটা আনচান করে। স্নিকার পরে, কানে হেডফোন গুঁজে পার্ক, উদ্যান, ঝরনার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এখন আমার দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজের অংশ।
অস্বীকার করব না: হাঁটা শুরু করার পর থেকে এখন আমি পুরোপুরি ভিন্ন একজন মানুষ। আগের চেয়ে আরও সুস্থ। আমার ওজন কমেছে, শরীর এখন আগের চেয়ে অনেক দ্রুত নাড়তে পারি, অনেক শারীরিক ব্যথাও এখন আর অনুভূত হয় না। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় শরীর নিয়ে অনেক স্বস্তিকর পরিস্থিতিতে থাকি এখন। কিন্তু এতকিছুর পরও বলতে হচ্ছে: আমার জীবন আগের চেয়ে ভালো বইকি, তবে এটা আগের তুলনায় জঘন্যও।
এর কারণ সম্ভবত আমি পডকাস্ট শুনতে শুনতে একা একা হাঁটি বলে। কয়েক কদম হাঁটার পর থেকেই আমার মনের ভেতর ভাবনাগুলো উঁকি দিতে শুরু করে। দিনের যে সময়টাতে আমি হাঁটি, তখন আমার আশপাশে আরও অনেকেই শরীরচর্চা করে বেড়ান। তাদের আবার জাতভাগ করে নিয়েছি আমি।
ব্যায়ামকারীদের তালিকায় সবার আগে থাকবে যারা দৌড়ায় তাদের নাম। তারা এ হাঁটার রাজ্যের সম্ভ্রান্ত জাত, অন্যদের চেয়ে একেবারে আলাদা। তাদের গায়ের অ্যাথলেটিক পোশাকগুলো আমার চোখে বর্মের মতো ধরা দেয়। তারা নিজেরাও জানেন, পার্কের রাজা তারা।
পার্কে প্রতিদিন একই পথ ধরে দৌড়ান তারা। যেহেতু তাদের পেছন থেকে আগমন টের পাই না, তাই তারা আমার গায়ের পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে, হালকা ধাক্কাসহ বেরিয়ে যান। মাঝেমধ্যে তাদের ধাক্কায় আমি পড়েও যাই। তারা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে আমার পাশ দিয়ে চলে যান — দেখে মনে হয় কোনো অশ্বারোহী রাজা তার ভূপাতিত শত্রুর দিকে নিতান্ত তুচ্ছ দৃষ্টিপাত করছেন।
এর পরের বনেদি জাতটা সাইক্লিস্টদের। দৌড়বিদদের মতোই তাদের আচরণ, অভ্যাস আর মেজাজ। কোনো পর্বতারোহী একজন হাইকারের দিকে যেভাবে তাকান, সাইক্লিস্টরাও আমাদের মতো হাঁটাপন্থীদের দিকে সেভাবেই কটাক্ষ করেন। তাদের কাছে পার্কে হাঁটা লোকজন খাদ্যশৃঙ্খলের সবচেয়ে নিম্নের স্তরে অবস্থানকারী।
কিন্তু হাঁটা শুরুর পর আমার জীবন জঘন্য হওয়ার জন্য তাদের এসব অবজ্ঞাভরা ভ্রুকুটি দায়ী নয় আসলে। এসব হবে বলেই ধরে নিয়েছিলাম, তাই এ শ্রেণীবাদকে মেনেও নিয়েছি। আর তাদের এ অবজ্ঞা আমার প্রাপ্যই, কারণ তারা যা কিছু অপছন্দ করে, আমি যেন সে সবেরই প্রতিনিধিত্বই করি। আমরা যদি একটা জাতপাত প্রথার সমাজে বাস করতাম, তাহলে তাদেরকে আমার মতো অধমের সঙ্গে এক রাস্তায় চলতে হতো না। হতচ্ছাড়া গণতন্ত্রটাই সব গুবলেট করে দিয়েছে — তাদের আর আমার পথটাকে এক করে দিয়েছে। তবে আমি সব সময় সতর্ক থাকি তাদের পথ না মাড়াতে।
অন্যদিকে হয় কী, আমার মতো অন্য হণ্টনকারীরা আমাকেই ছোট করে দেয়। আমাদের সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয় — বেশিরভাগই আমার চেয়ে বয়স্ক। ৪৩ বছর বয়সী আমি এ দলের তরুণতম সদস্য। অন্যরা আমার চেয়ে গড়ে ১৫-২০ বছর বেশি বয়সী।
এই বুড়োদের বেশিরভাগকে দেখলেই বোঝা যায় তারা বিষণ্ণ, ভেতরে ভেতরে বিধ্বস্ত। বন্ধুরা যখন তাদের দৈনিক এ শরীরচর্চার প্রশংসা করে, তখন তারা ওই বন্ধুদের কী বলেন সেটা আমি জানি না, কিন্তু এ পার্কের ভেতরে হাঁটতে এসে তখন আর কারও পক্ষে তাদের মনের ভাব লুকানো সম্ভব হয় না। হেডফোনে শস্তকোভিশের সেভেন্থ সিম্ফোনি শুনতে শুনতে তাদের মুখ দেখে আমি সে মুখের ওপর স্পষ্ট হয়ে থাকা মনোভাবটি স্পষ্ট বুঝতে পারি। 'এটা বিচ্ছিরি' — তাদের মুখমণ্ডলে এমনটাই ফুটে ওঠে।
হয়তো মোজার্ট বা টোসকা শুনতে শুনতে হাঁটলে তাহলে তাদের মুখটা বাইরে থেকে আরেকটু আনন্দিত মনে হতো আমার কাছে। কারণ হাজার হোক, শস্তকোভিশের সেভেন্থ সিম্ফোনি লেনিনগ্রাদ অবরোধকে উৎসর্গ করা — এখানে মৃত্যু আর কানিবালিজমের কথা আছে। কিন্তু ঠিক এ কারণেই এটি আমাকে সত্যের ঠিক-ঠিক পরিমাপটা বুঝতে দেয়।
আমি ধারণা করতে পারি, পার্কে হাঁটতে আসা এ মানুষগুলো ইতোমধ্যে একবার হৃদরোগের শিকার হয়েছেন, এখন দ্বিতীয়বারেরটার আশঙ্কায় রয়েছেন। জীবনে তাদের চাওয়া একটাই — আরও কয়েকটা দিন বেশি বাঁচা। তারা বুঝতে পারেন, তাদের এখন যে পরিস্থিতি, সেখানে নিয়িতর সঙ্গে দরকষাকষি করার কোনো উপায় তাদের নেই। তাদের নতুন কিছু আর অর্জনের সুযোগ নেই, বরং যা আছে, তা যদি আরও কয়েকটা দিন উপভোগ করে ওঠা যায়, তা-তেই সই।
এই যে এখন যেমন আমি পিঠে ব্যথা না পেয়েই শরীর ঝোঁকাতে পেরেই সন্তুষ্ট, তাদের মনোভাবটাও সে রকমই। এ অনুভূতিটাই আমাদের যাবতীয় দুঃখবোধের উৎস — সমাপ্তি নিয়ে এই স্পষ্ট ধারণাটা। কিন্তু 'মানুষ মরণশীল' — এ কথা ভুললে চলবে কেন!
কিন্তু আমি তাদের রহস্য প্রকাশ করতে চাইনা। আমার সুশৃঙ্খল, নির্মেদ এ জীবন আমাকে আগের চেয়ে একটু ভালো থাকতে দিয়েছে বটে, কিন্তু আমি যখন ভালো থাকার এসব নিয়মকানুন মেনে চলিনি, তখন জীবনটা আরও বেশি আনন্দময় ছিল। আমার হণ্টনসঙ্গীদের বিষণ্ণ চোখের দিকে তাকালে আমি তাদের মধ্যেও এ অনুভূতিটাই দেখতে পাই। সিগারেটের ধোয়া, সেইসব সুস্বাদু ওয়াইন — সবই হয়তো আরেকটু আগে কবরে যাওয়ার কারণ হতো, কিন্তু সে মৃত্যুটাও হতো খুব সমৃদ্ধ, নিগূঢ় আর অভ্যর্থনাজ্ঞাপক। মনে কোনো দ্বিধা না রেখেই বলতে হয়, সুস্বাস্থ্যের ন্যায়নিষ্ঠ জীবনযাত্রার এ চর্চার চেয়ে অতীতের কিণ্বস্রাবী জীবনটাই বেশি আনন্দের ছিল।