আজও কেন 'এলিয়েন' স্মৃতি উস্কে দেয়? ৪৪ বছর আগের সায়েন্স ফিকশনের নেপথ্যকথা
আজ থেকে ৪৪ বছর আগে মুক্তি পেয়েছিল রিডলি স্কট পরিচালিত সায়েন্স ফিকশন-ভৌতিক ঘরানার চলচ্চিত্র 'এলিয়েন'। ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি আজও আধুনিক যুগের অনেক সিনেমাকে প্রভাবিত করে চলেছে। ১১ মিলিয়ন ডলার বাজেটের এই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন জন হার্ট, ভেরোনিকা কার্টরাইট, সিগোর্নি উইভার, টম স্কেরিট এর মতো তারকারা। ছবিটি মুক্তির ৪৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে এর অজানা কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে অল দ্য রাইট মুভিস।
'নস্ট্রোমো' নামক একটি মহাকাশযানের ক্রুরা একটি গ্রহ থেকে বিপদসংকেত পায় এবং তদন্ত করতে সেখানে রওনা দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে তারা একটি এলিয়েনের আক্রমণের শিকার হয় এবং এলিয়েনটি তাদের মহাকাশযান দখল করে ফেলে- এমনটাই ছিল 'এলিয়েন' সিনেমার গল্প। কিন্তু এর বাইরেও সিনেমাটি নির্মাণে ক্যামেরার পেছনের গল্পগুলো জানলে অবাক হবেন পাঠকেরা।
১৯৭৬ সালে চিলিয়ান-ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা আলেহান্দ্রো হডোরভস্কির 'ডিউন' প্রজেক্ট ব্যর্থ হওয়ার পর ইফেক্টস সুপারভাইজার ড্যান ও'ব্যানন গৃহহীন হয়ে পড়েন। নিজের লেখক বন্ধু রোনাল্ড শুজের সঙ্গে থাকতে গিয়ে তাদের দুজনের মাথায় একটা সায়েন্স ফিকশন/হরর ফিল্মের গল্প লেখার আইডিয়া আসে। তারা চেয়েছিলেন এমন একটি চিত্রনাট্য লিখবেন যা তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। আর হয়েছিলও তাই।
ড্যান ও'ব্যানন এবং শুজে মিলে প্রথমে 'মেমোরি' শিরোনামে একটি চিত্রনাট্য লেখেন। পরে এটির নাম বদলে রাখেন 'দে বাইট' এবং তারপরে নাম দেন 'স্টার বিস্ট'। কিন্তু কোনো শিরোনামই তাদের পছন্দ হচ্ছিল না। বরং চিত্রনাট্য পড়ার পর তারা বুঝতে পারলেন যে তারা 'এলিয়েন' শব্দটাই কত বেশি ব্যবহার করেছেন সেখানে। তাই শেষ পর্যন্ত নাম দিলেন 'এলিয়েন'। কিন্তু মুশকিল হলো, কেউই তাদের এই চিত্রনাট্য কিনতে চাইলো না।
ওয়াল্টার হিল এই চিত্রনাট্য নিলেন এবং সিনেমা বানাতে চাইলেন। ১৯৭৭ সালের মে মাসে 'স্টার ওয়ারস' মুক্তি পায় এবং হুট করেই সায়েন্স ফিকশন সিনেমা তুমুল জনপ্রিয় হতে থাকে। তাই টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি স্টুডিওস আবার লেখকদ্বয়ের কাছে ফিরে গেল এবং 'এলিয়েন' নির্মাণের সবুজ সংকেত দিয়ে দিল।
'এলিয়েন' সিনেমার প্রযোজক ডেভিড গিলার এবং ওয়াল্টার হিল চিত্রনাট্যে কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন। তারা চরিত্রগুলোর নাম পাল্টে নতুন নাম দেন এবং 'অ্যাশ' নামক চরিত্রটি নিয়ে আসেন। সিনেমার পরিচালক হিসেবে অনেক খ্যাতনামা পরিচালকের নামই উঠে এসেছিল। রবার্ট অল্টম্যান এবং পিটার ইয়েটস 'না' বলে দেন এবং রবার্ট অলড্রিচ এ প্রজেক্টটি এড়িয়ে যান।
'দ্য ডুয়েলিস্ট' সিনেমাটি দেখে প্রভাবিত হয়ে শেষ পর্যন্ত রিডলি স্কটের কাছে যায় টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি স্টুডিওস। স্কট 'স্টার ওয়ারস' দেখেছিলেন এবং তার মাথায় কিছু আইডিয়া ছিল যে একটা সায়েন্স ফিকশন সিনেমা বানানোর সুযোগ এলে তিনি কিভাবে বানাবেন। তাই 'এলিয়েন' নির্মাণের প্রস্তাব আসামাত্রই তা লুফে নেন তিনি।
স্কট জানিয়েছিলেন, তার এই সিনেমাটি নির্মাণের পেছনে আরও তিনটি সিনেমার প্রভাব রয়েছে: ডিজাইনগুলো ছিল স্টার ওয়ারস থেকে প্রভাবিত, ২০০১: আ স্পেস ওডিসি'র 'হ্যাল-৯০০০' থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নস্ট্রোমোর কম্পিউটার মাদারের ডিজাইন তৈরি করেছেন এবং টেক্সাস চেইন স ম্যাসাকার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি তিনি এলিয়েনের ভৌতিক আবহ তৈরি করেছেন।
প্রথমে সিনেমাটির বাজেট ৪.২ মিলিয়ন ডলার ধরা হয়, কিন্তু পরিচালক চেয়েছিলেন আরও বেশি। তাও রিডলি স্কট পুরো সিনেমার স্টোরিবোর্ড তৈরি করেন, দৃশ্যগুলো একে একে বুঝান। স্টোরিবোর্ড দেখে চমৎকৃত হয়ে ফক্স এই সিনেমার বাজেট বাড়িয়ে ৮.৪ মিলিয়ন ডলার করে দেয়। কিন্তু সিনেমাটি এত বিশাল একটি প্রজেক্ট ছিল যে মাঝপথে তাদের টাকা ফুরিয়ে যায়। এসময় তাদের একটি মিটিং হয় যেখানে স্টুডিওর একজন নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন যে তারা এই প্রজেক্টটি থামিয়ে দিতে চান। একথা শুনে পরিচালক রিডলি স্কট এত জোরে টেবিলে থাবা মেরেছিলেন যে তার একটি আঙুল ভেঙে গিয়েছিল। তিনি রাগতস্বরে তর্ক করতে থাকেন এবং আরও ২.৬ মিলিয়ন ডলার আদায় করেন।
তৎকালীন সময়ের হিসেবে এই বিপুল পরিমাণ বাজেট সত্ত্বেও বেশিরভাগ সেটই ছিল ছোট, অর্থাৎ বেশিরভাগ শটই ছিল হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরায় ধারণ করা। সিনেমার এগ চেম্বার সিকোয়েন্সের শ্যুটিং যখন হচ্ছিল, পাশেই একটি জায়গায় রক ব্যান্ড 'দ্য হু' তাদের স্টেজ শো'র জন্য লেজার টেস্ট করছিল।
স্কট তাদের গায়ক রজার ডালট্রিকে অনুরোধ করলেন যে তারা এই আলোগুলো ধার নিতে পারেন কিনা। আর এই আলোর মাধ্যমেই ভূতুড়ে নীল ইফেক্ট তৈরি করা হয়েছিল যা এই সিকোয়েন্সে দেখা যায়।
সিনেমাজুড়ে টানটান উত্তেজনার আবহ তৈরি করতে স্কট অভিনেতা ইয়াফেট কোটোকে বলেছিলেন সিগোর্নি উইভারকে ক্ষেপিয়ে তুলতে। ইয়াফেট শট নেওয়ার আগে অভিনেত্রীকে উস্কে দেওয়ার মতো কথা বলতেন যাতে করে তিনি সেই অঙ্গভঙ্গি নিয়েই পারফেক্ট শট দিতে পারেন।
সিনেমার রিপ্লি চরিত্রটির জন্যও অনেক বড় বড় তারকার নামে উঠে এসেছিল আলোচনায়। জেনেভিয়েভ বুজোলদ এবং ক্যাথেরিন রসকে এ চরিত্রের জন্য ভাবা হয়েছিল। হেলেন মিরেন এবং মেরিল স্ট্রিপ দুজনেই অডিশন দিয়েছিলেন। কিন্তু রিডলি স্কট বলেছিলেন, "মেরিল একজন দারুণ অভিনেত্রী হবে এটা সত্যি, কিন্তু সিগোর্নিই এই সিনেমার রিপ্লি।"
স্কট একজন নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি ফক্স স্টুডিও থেকে ১২ জন সেক্রেটারিকে নিয়ে আসেন সিগোর্নির স্ক্রিন টেস্টের সময়। তিনি জানান, একটা আলোচনা ছড়িয়ে পড়েছিল যে সিগোর্নি দেখতে জেইন ফন্ডা নাকি ফাই ডোনাওয়ের মতো দেখতে। কিন্তু স্কট নিশ্চিত ছিলেন যে সিগোর্নিই তার সিনেমার প্রধান নারী চরিত্র।
টম স্কেরিট 'এলিয়েন' সিনেমায় ক্যাপ্টেন ডালাসের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ঠিকই, কিন্তু আপনি কি জানেন এই চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন হ্যারিসন ফোর্ড? তখন সবেমাত্র স্টার ওয়ারস সিনেমায় হান সোলো চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফোর্ড, তাই আবারও একটি সাই-ফাই সিনেমায় অভিনয়ের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। প্রযোজকরা টমি লি জোনসের সাথেও আলাপ করেছিলেন, কিন্তু তিনি বলেন যে তিনি এলিয়েন চরিত্রটি করতে চান, তাই পরে তার নামও বাদ দেওয়া হয়।
এমনকি স্কেরিটের কাছে গেলে তিনিও 'না' বলে দেন। অভিনেতা ভেবেছিলেন চিত্রনাট্যটি বোধহয় দুর্বল এবং মাত্র ২ মিলিয়ন ডলার বাজেটে এটি একটি বি-গ্রেড ছবি হবে। কিন্তু যখন রিডলি স্কট পরিচালনার দায়িত্বে আসেন তখন তিনি মত পরিবর্তন করেন এবং বলেন, দ্য ডুয়েলিস্ট' সিনেমাটা ছিল আমার কাছে একটা পেইন্টিং এর মতো। কেউ যদি এটা করতে পারে তাহলে রিডলিকে দিয়েই সম্ভব।
আরও মজার তথ্য হলো, মিল্কি রোবট অ্যাশের শরীরের ভেতরটা ছিল স্প্যাগেটি, দুধ এবং ওনিয়ন রিংস দিয়ে তৈরি! মডেল স্যুটের ভিতরে ৩ দুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার একজন অভিনেতাকে ঢুকিয়ে তার একটি দৃশ্য শ্যুট করা হয়েছিল।
দুই লেখক কীটপতঙ্গের উপর গবেষণা চালিয়েছিলেন এবং ব্র্যাকোনিড ওয়াসপ (ভিমরুলের মতো এক ধরনের পোকা) থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন, যারা শুঁয়োপোকার ভিতরে তাদের ডিম পাড়ে। ধীরে ধীরে এই ধারণাটি থেকেই 'ফেসহাগার' সৃষ্টি হয়।
'এলিয়েন' সিনেমায় মূল এলিয়েনের ডিজাইন করেছিলেন সুইস শিল্পী এইচ. আর. গিগা, যিনি সেসময় অখ্যাতই ছিলেন। ড্যান ও'ব্যানন 'ডিউন' প্রজেক্টে গিগার সঙ্গে কাজ করেছিলেন, তাই তাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। স্কটের কাছেও গিগার কাজ ভাল লেগে যায়, তাই তিনি সিনেমায় তাকে কাজ দেন।
মজার ব্যাপার হলো, গিগা যখন ফেসহাগার-এর ডিজাইন নিয়ে এলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমসের কর্মকর্তারা এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন এটি দেখে যে তারা তাকে বন্দি করেন। পরে ড্যান নিজে গিয়ে তাদেরকে বোঝান যে এটা একটা ভৌতিক সিনেমার জন্য বানানো।
প্রথমে ভাবা হয়েছিল এলিয়েনগুলো হবে স্বচ্ছ এবং তাদের মাথাভর্তি থাকবে পোকা। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গিগা যেই এলিয়েনের ডিজাইন দিয়েছিলেন, সেটার চোখও ছিল। কিন্তু ইফেক্টস টিম এলিয়েন বানাতে শুরু করার পর তিনি চোখগুলো সরিয়ে দিতে বলেন।
এলিয়েনের মাথার সামনের অংশটি সত্যিকারের মানুষের মাথার খুলির কাস্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এলিয়েনের মুখ থেকে যে আঠালো পদার্থ পড়ে তা ছিল কে-ওয়াই জেলি। আর ছেঁড়া কনডম ব্যবহার করে এলিয়েনের চোয়ালের টিস্যুর অংশ তৈরি করা হয়েছিল।
স্টার ওয়ারস-এ চুবাকা চরিত্রে অভিনয় করা পিটার মেহিউকে প্রথমে আনা হলেও, শেষ পর্যন্ত বোলাজি বাডেজো নামের ৭ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা এক গ্রাফিক আর্টিস্ট জেনোমরফ চরিত্রে অভিনয় করেন। রিডলি স্কট নিজেই তাকে লন্ডনের এক পাবে খুঁজে পেয়েছিলেন।
'এলিয়েন' ছবির গল্প চুরি করে নেওয়া- এই অভিযোগে ফক্স স্টুডিওর বিরুদ্ধে মামলা করেন এ.ই. ফন ফোগট নামের এক লেখক। তিনি দাবি করেছিলেন, ১৯৩৯ সালে ডিসকর্ড ইন স্কারলেট নামের একটি সায়েন্স ফিকশন ছোটগল্প লিখেছিলেন তিনি, যেখানে প্রায় একই গল্প ছিল। এই বিবাদ পরে আদালতে নিষ্পত্তি করা হয়।
এত ঝক্কি-ঝামেলা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন রিডলি স্কট, যা আজও বিশ্বনন্দিত। আধুনিক অনেক সিনেমা নির্মাণের পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে এই ছবি। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জেমস ক্যামেরনও এই সিনেমা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে এর সিক্যুয়েল 'এলিয়েনস' নির্মাণ করেন যা বক্স অফিসে প্রায় ১৩১.১ থেকে ১৮৩.৩ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে।